গ্যাস সংকটের সমাধান হচ্ছে না শিগগির

গ্যাস থাকবে না ঢাকার যেসব এলাকায়

তীব্র গ্যাস সংকটে শিল্পখাত ও বাসাবাড়ির দুর্দশা শিগগির সমাধান হচ্ছে না। পরিবহণ খাতের একটি অংশ গ্যাসের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। সিএনজিচালিত যানবাহনে গ্যাস সরবরাহে ফিলিং স্টেশনগুলো হিমশিম খাওয়ায় তারাও এসব যানবাহন মালিক ও যাত্রীরাও সমস্যায় পড়ছে।

কর্মকর্তারা এটিকে গ্যাসের সরবরাহ ও চাহিদার বিশাল ব্যবধান হিসেবেই দেখছেন।

জুলাইয়ে সরকার যখন ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধির কারণে আন্তর্জাতিক স্পট মার্কেট থেকে তরল প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) কেনা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়, তখন পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে শুরু করে।

এরপর থেকে বাসাবাড়ি ও বাণিজ্যিক গ্রাহকদের গ্যাস সরবরাহে রেশনিংয়ে বাধ্য হয়েছে কর্তৃপক্ষ।

গত ১৬ অক্টোবর রাষ্ট্রায়ত্ত পেট্রোবাংলা ৩ হাজার ৭৬০ মিলিয়ন ঘনফুট চাহিদার বিপরীতে জাতীয় গ্রিডে প্রতিদিন ২ হাজার ৬২১ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করেছে। গত কয়েক মাসে গ্যাস সরবরাহে গড় ঘাটতি প্রায় ১ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট।

সেইসঙ্গে বাড়ছে ভোগান্তি। উদাহরণ হিসেবে রাজধানীর গেণ্ডারিয়া এলাকার জুম্মাতুল বিদার কথাই ধরা যাক।

বিদা বলেন, 'গত ২ মাস ধরে সকাল ৮টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত কোনো গ্যাস পাচ্ছি না। গ্যাস বন্ধ থাকায় সকালের নাস্তা ও দুপুরের খাবার রান্না করতে ভোর ৫টায় ঘুম থেকে উঠতে হয়।'

তিনি জানান, গ্যাসের এই সংকট তার দৈনন্দিন রুটিন বিপর্যস্ত করে দিচ্ছে।

তিনি বলেন, 'ভোরে উঠতে না পারলে হয় না খেয়ে থাকতে হবে, আর না হয় হোটেল থেকে কিনে খেতে হবে।'

শুধু বিদা নন, মোহাম্মদপুর, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, জিগাতলা, বনশ্রী, বাড্ডা, পোস্তগোলা, হাজারীবাগ, কেরানীগঞ্জ, গাজীপুর, সাভার ও মানিকগঞ্জে তীব্র গ্যাস সংকটের অভিযোগ করেছেন অনেকে।

বিদ্যুৎ খাত দেশের মোট গ্যাস সরবরাহের ৪২ শতাংশ ব্যবহার করে। গত জুলাইয়ে গ্যাস সংকটের কারণে প্রায় ৩০টি গ্যাসচালিত প্ল্যান্টে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমাতে হয়েছে।

গ্যাসচালিত প্ল্যান্টে বিদ্যুৎ উৎপাদন দৈনিক ১১ হাজার ১৬২ মেগাওয়াট থেকে কমে ৫ হাজার থেকে ৫ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট হয়েছে। বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশে লোডশেডিং বেড়ে দৈনিক ৬ ঘণ্টা হয়েছে।

ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প

গত ৩ মাসে গ্যাস সংকটের কারণে আশুলিয়ার লিটল স্টার নামে একটি স্পিনিং মিলের উৎপাদন অর্ধেকেরও বেশি কমে গেছে। এই কারখানা দৈনিক ১২ টন সুতা তৈরিতে সক্ষম।

আশুলিয়াভিত্তিক লিটল স্টার স্পিনিং মিলস লিমিটেডের চেয়ারম্যান মো. খোরশেদ আলম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমাদের উৎপাদন ৫৫ শতাংশ কমে গেছে। এই পরিস্থিতি কবে স্বাভাবিক হবে জানি না। আমরা এখন ক্রেতা হারানোর ঝুঁকিতে আছি।'

তিনি জানান, তাদের ২টি স্পিনিং মিল রয়েছে। একটি আশুলিয়ায় এবং অপরটি ভুলতায়। কাপড় রং ও ছাপার জন্য উভয় মিলের বয়লার চালাতে গ্যাসের প্রয়োজন হয়।

তিনি বলেন, 'ভুলতা কারখানায় দেড় মাস আগে গ্যাস সংকট দেখা দেয়। অনেক সময় গ্যাসের চাপ এত কমে যায় যে মেশিনই বন্ধ হয়ে যায়।'

'অনেক সময় উৎপাদন শুরু করতে প্রয়োজনীয় গ্যাসের চাপ পেতে ৪ থেকে ৫ ঘণ্টা লাগে। এই পরিস্থিতি দীর্ঘস্থায়ী হলে ব্যবসা চালানো কঠিন হবে' যোগ করেন তিনি।

বাংলাদেশ সিরামিক ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিএমইএ) তথ্য মতে, গ্যাসের চলমান সংকটের কারণে এই শিল্পের উৎপাদন ১০ থেকে ৩০ শতাংশ কমেছে।

এফএআরআর সিরামিকের পরিচালক ইরফান উদ্দিন বলেন, 'সিরামিক পণ্য তৈরির জন্য আমাদের বার্নারে গ্যাসের প্রয়োজন। গ্যাসের সংকট আমাদের উৎপাদন ব্যাহত করছে। এ ছাড়া, হঠাৎ গ্যাসের চাপ কমে গেলে বার্নারের ভেতরের বেশিরভাগ পণ্যই নষ্ট হয়ে যায়।'

মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের সিনিয়র সহকারী মহাব্যবস্থাপক তসলিম শাহরিয়ার জানান, গ্যাস সংকটের কারণে নারায়ণগঞ্জে তাদের কারখানায় উৎপাদন ৫০ শতাংশ কমে গেছে।

সিএনজি সরবরাহের ঘাটতি

সরকার গ্যাস রেশনিংয়ের অংশ হিসেবে গত বছরের সেপ্টেম্বরে দিনে ৪ ঘণ্টা সব সিএনজি স্টেশন বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। এ বছরের মার্চ থেকে বন্ধ থাকার সময় আরও ১ ঘণ্টা বাড়ানো হয়েছে।

বাংলাদেশ সিএনজি ফিলিং স্টেশন অ্যান্ড কনভার্সন ওয়ার্কশপ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ফারহান নূর বলেন, ৫ ঘণ্টা সিএনজি স্টেশন বন্ধ রাখার সরকারি সিদ্ধান্তে ব্যবসায়িক ক্ষতি হচ্ছে।

তিনি বলেন, 'এ ছাড়া, এই ৫ ঘণ্টার বাইরেও ফিলিং স্টেশনগুলোতে পর্যাপ্ত গ্যাসের চাপ থাকছে না।'

৩ মাসের মধ্যে পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলে সরকার আশ্বাস দিলেও পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছে বলে জানান তিনি।

গ্যাস সংকট সার উৎপাদনেও প্রভাব ফেলেছে। ৪টি রাষ্ট্রায়ত্ত ইউরিয়া সার কারখানার মধ্যে ৩টি জুনের শেষ সপ্তাহ থেকে বন্ধ রয়েছে।

সরকার অবশ্য বেশ কয়েকবার আশ্বাস দিয়েছে যে সারের কোনো ঘাটতি হবে না। সারের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে এবং ইতোমধ্যেই সার আমদানির জন্য বেশ কয়েকটি দেশের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে।

অপেক্ষা শীতের

পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান জানান, বিশ্ববাজারে ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধির কারণে সরকার স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি বন্ধ করার পর থেকে জাতীয় গ্রিডে গ্যাস সরবরাহে ১০ শতাংশ ঘাটতি রয়েছে।

তিনি বলেন, 'পুরো বিশ্ব এখন সংকটের মধ্যে রয়েছে। এর থেকে বেরিয়ে আসার জন্য আমাদের একসঙ্গে কাজ করতে হবে।'

আগামী শীতে পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি বলেন, 'শীতকালে বিদ্যুতের চাহিদা কমে যাবে। এ ছাড়া, এ বছরের শেষ নাগাদ কিছু কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হবে। এতে কিছু গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদন কমাতে পারবে এবং শিল্প ও অন্যান্য খাতে আরও গ্যাস সরবরাহ করা সম্ভব হবে।'

Comments

The Daily Star  | English

Public Service Act: Ordinance out amid Secretariat protests

The government last night issued an ordinance allowing dismissal of public servants for administrative disruptions within 14 days and without departmental proceedings.

8h ago