বকেয়া নিয়ে সরকার ও বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের ‘দ্বন্দ্ব’

সরকারের কাছে পাওনা ১৬ হাজার কোটি টাকা
স্টার ফাইল ফটো

বকেয়া বিল নিয়ে সরকার ও বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর মধ্যে এক ধরনের স্থবিরাবস্থা বিরাজ করছে। চলমান বিদ্যুৎ পরিস্থিতির কারণে এমনিতেই জনসাধারণের ভোগান্তি অসহনীয় পর্যায়ে রয়েছে। এর মধ্যে সেই স্থবিরাবস্থা যেন 'মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা' হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সরকারের কাছে বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদকদের ১৬ হাজার কোটি টাকা পাওনা বকেয়া রয়েছে। বিদ্যুৎকেন্দ্র মালিকরা বলছেন, বকেয়া না পাওয়ায় তারা বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য জ্বালানি আমদানি করতে পারছেন না।

জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত আমদানির তথ্য বলছে, ২৬টি বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র ১২ হাজার ৫১৭ কোটি টাকার ভারী জ্বালানি আমদানি করেছে।

১৬ হাজার কোটি টাকার বিলে জ্বালানির মূল্য, সরকার কর্তৃক কেনা বিদ্যুৎ ও ক্যাপাসিটি চার্জ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। সরকার কোনো কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ না কিনলেও আইনত বাধ্যবাধকতার কারণে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হয়।

ইনডিপেন্ডেন্ট পাওয়ার প্রোডিউসাররা (আইপিপি) নিজেরাই ভারী জ্বালানি তেল আমদানি করে থাকে। অর্থ প্রদানে বিলম্বের আশঙ্কায় তারা আমদানি বিলের ওপর সরকারের কাছ থেকে ৩ শতাংশ সুদ আদায় করে থাকে।

কিন্তু, তাও এখন আর যথেষ্ট নয় জানিয়ে কেন্দ্র মালিকরা বলছেন, ৫ মাস ধরে তারা বেতন দিতে পারছেন না।

যদিও দীর্ঘমেয়াদি বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো (যাদের মুনাফা-হার উচ্চ নয়) সরকারের কাছ থেকে একটি নির্দিষ্ট ছাড় পেতে পারে, তবে, সংশ্লিষ্টরা বলছেন, উচ্চলাভের হারে পরিচালিত স্বল্পমেয়াদি ভাড়ায়চালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের অপরিশোধিত বিলের কারণে সাধারণ জনগণ ভুক্তভোগী হচ্ছে।

চলমান সমস্যার কথা স্বীকার করে বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান বলেন, 'আমরা সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছি। আমরা মে মাস থেকে বকেয়া পরিশোধের চেষ্টা করছি, যাতে কেন্দ্রগুলো জ্বালানি আমদানি করতে পারে।'

কিন্তু গত বুধবার ৪৮টি বিদ্যুৎকেন্দ্র জ্বালানি ঘাটতি ও ইঞ্জিনের সমস্যার কথা উল্লেখ করে উৎপাদন সম্পূর্ণ বন্ধ রেখেছিল। এর মধ্যে প্রায় এক-চতুর্থাংশ কেন্দ্র ভারী জ্বালানি তেলে চালিত হয় এবং ১০টি ব্যক্তি মালিকানাধীন। আরও ৭টি কেন্দ্র ৩০ শতাংশেরও কম উৎপাদন ক্ষমতা নিয়ে চলছিল।

ভারী জ্বালানি তেলে চালিত বেসরকারি কেন্দ্রগুলো ৩ হাজার ৭২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করে থাকে। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) তথ্য অনুযায়ী, এ মাসে তাদের উৎপাদন প্রায় ৫০০ মেগাওয়াট কমেছে।

বাংলাদেশ ইনডিপেন্ডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসারস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ইমরান করিম বলেন, '(চুক্তিতে) এই শর্ত ছিল যে, সরকার ৪৫ দিনের মধ্যে বিল পরিশোধ করবে। কিন্তু, তা না করায় জ্বালানি আমদানি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। অপরিশোধিত বিলের কারণে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ছোট ও মাঝারি আকারের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো। কারণ ইতোমধ্যে তাদের ব্যাংকিং লাইন শেষ হয়ে গেছে এবং তারা আর ক্রেডিট লাইন খুলতে পারবে না।'

'এমনকি যদি সরকার এখন অর্থ প্রদানের বিষয়টির নিষ্পত্তিও করে, তবে তা বর্তমান বিনিময় হারের (ডলার) প্রতিফলন ঘটাবে না, তাই ঘাটতি দেখা দেবে', বলেন তিনি।

গত শনিবার দ্য ডেইলি স্টারকে পিডিবির সদস্য (জেনারেশন) মোহাম্মদ আশরাফুল ইসলাম বলেন, 'আমরা সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি এবং আমি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের উৎপাদন করতে বলছি।'

বাংলাদেশ ওয়ার্কিং গ্রুপ অন এক্সটারনাল ডেবট বিভাগের সদস্য সচিব হাসান মেহেদী বলেন, 'বেশিরভাগ আইপিপি এখন এ সংকটকে ব্যবহার করে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। ছোট বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে সমস্যা হতে পারে। তবে, বড় সংস্থাগুলো? বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন থেকে যে কেউ জ্বালানি কিনতে পারে।'

জ্বালানি আমদানির তথ্যে দেখা গেছে, গত মাসে ভারী জ্বালানি তেল আমদানি আগের মাসের তুলনায় ১৯ শতাংশ কমেছে।

চলতি মাসের ১৩ দিন কেটে গেলেও জ্বালানি ঘাটতির কথা বলে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো উৎপাদন বন্ধ রেখেছে। কিন্তু, এ সময় পর্যন্ত যা আমদানি হয়েছে, আগস্টের তুলনায় তা মাত্র ১০ শতাংশ।

এ মাসে ৪টি বিদ্যুৎকেন্দ্র ভারী জ্বালানি তেল আমদানি করেছে। কেন্দ্রগুলো হলো অ্যাকর্ন ইনফ্রাস্ট্রাকচার সার্ভিসেস, অ্যানলিমা এনার্জি লিমিটেড, বারাকা শিকালবাহা পাওয়ার লিমিটেড ও কাঞ্চন পূর্বাচল পাওয়ার জেনারেশন। তারা প্রায় ৮ কোটি টন জ্বালানি আমদানি করেছে, যার মূল্য প্রায় ৪৯৫ কোটি টাকা।

গত ১০ অক্টোবর জ্বালানির চালানে পেলেও কাঞ্চন পূর্বাচল পাওয়ার জেনারেশন এখনো উৎপাদন শুরু করেনি।

সিনহা পিপলস এনার্জির আওতাধীন ২টি কেন্দ্র দ্য রেন্টাল অ্যামনুরা ৫০ মেগাওয়াট ও দ্য আইপিপি কাটপট্টি ৫২ মেগাওয়াট কেন্দ্র গত বুধবার উৎপাদন বন্ধ রেখেছে। গত জুলাই থেকেই সংস্থাটি জ্বালানি আমদানি করছে না।

এ বিষয়ে জানতে সিনহা পিপলস এনার্জির মুখপাত্র আরিফুর রহমান সিনহার নম্বরে একাধিকবার ফোন করলেও তা বন্ধ পাওয়া যায়।

বিশেষজ্ঞরা প্রশ্ন তোলেন, ভারী জ্বালানি তেলে চালিত স্বল্পমেয়াদি কেন্দ্রগুলোর মধ্যে যেগুলো উৎপাদন কম করছে এবং জ্বালানি আমদানি করছে না, তাদের খুঁটির জোরটা আসলে কোথায়?

নকশা অনুযায়ী স্বল্পমেয়াদি ভাড়ায়চালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো ৩ থেকে ৫ বছরের জন্য বোর্ডে নেওয়া হয় এবং সেই সময়ের মধ্যে তাদের বিনিয়োগ পুনরুদ্ধার করার কথা। তবে কয়েক দশক ধরে একাধিক পুনর্নবীকরণের মাধ্যমে বোঝা যায় যে, তারা তাদের বিনিয়োগের অর্থ ইতোমধ্যে বেশ কয়েকবার পুনরুদ্ধার করেছে এবং বিনিময়ে তারা ব্যয়বহুল বিদ্যুৎ সরবরাহ করেছে।

সম্প্রতি পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসেন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'যে ইউনিট মূল্যে বিদ্যুৎ কেনা হয়, তা নির্ধারণ করার সময় ভাড়ার চার্জ ভাড়ার চুক্তির বছর কত হবে, তা দিয়ে ভাগ করা হয়।'

বছরের পর বছর ধরে একাধিক পুনর্নবীকরণের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট প্ল্যান্টগুলো ইতোমধ্যে বেশ কয়েকবার তাদের বিনিয়োগের অর্থ পুনরুদ্ধার করতে পেরেছে।

সিনহার দ্য অ্যামনুরা পাওয়ার প্ল্যান্ট গত বুধবারও উৎপাদন করেনি। এই কেন্দ্রটিই এ ধরনের পরিস্থিতির উদাহরণ। সবশেষ চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে কেন্দ্রের সঙ্গে নো-এনার্জি-নো-পে চুক্তি করা হয়েছিল। কেন্দ্রটি ভাড়ায়চালিত ও স্বল্পমেয়াদি হলেও এক দশক ধরে তা চলছে।

কয়েক দশক ধরে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো কীভাবে অগ্রাধিকারমূলক, অতিরিক্ত মূল্যের চুক্তি পেয়েছে, তা বিশ্লেষণ করে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন এসওএএস ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের অর্থনীতির অধ্যাপক মুশতাক খান। তিনি বলেন, 'জরুরি ব্যবস্থা হিসেবে ভাড়ায়চালিত বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলো স্বল্প সময়ের জন্য উপযোগী সিদ্ধান্ত ছিল। তবে, তাদের পুনর্নবীকরণের সিদ্ধান্তটি অদূরদর্শী ছিল এবং এর খেসারত এখন আমাদের দিতে হচ্ছে।'

Comments

The Daily Star  | English

What if the US election ends in a Trump-Harris tie?

While not highly likely, such an outcome remains possible, tormenting Americans already perched painfully on the edge of their seats ahead of the November 5 election

3h ago