ইতালির জাতীয় নির্বাচনে কেন বাম জোটের পরাজয়

ইতালির জাতীয় নির্বাচনে ভোট দিচ্ছেন একজন ভোটার। ছবি: সংগৃহীত

ইতালীয় অভিবাসীদের কাছে বাম জোটভুক্ত দলগুলো সবচেয়ে পছন্দের। এর মধ্যে পিডি বা পারতিতো দেমোক্রেতিকোর জনপ্রিয়তা সবচেয়ে বেশি। দেশটির এবারের জাতীয় নির্বাচনে দলটি এককভাবে ১৯ দশমিক ৪ শতাংশ ভোট পেয়েছে। নির্বাচনের আগ পর্যন্ত পিডি অন্য কয়েকটি দলের সঙ্গে কোয়ালিশন করে সরকারে ছিল। কিন্তু এবারের নির্বাচনে তারা ভালো ফল করতে পারেনি।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, বামপন্থী দলগুলো জোট গঠনের সময়ে অধিক সতর্ক ছিল না। জোটের নেতা এনরিকো লেত্তা'র কোনো ক্যারিশমাটিক পরিচিতি নেই। তিনি ডান জোটের নির্বাচনী পরিকল্পনার বিপরীতে কোনো চমক সৃষ্টি করা পরিকল্পনা উপস্থাপন করতে পারেননি। বামপন্থী একাধিক জনপ্রিয় নেতা এবং দলকে জোটের বাইরে রেখে তারা জোট গঠন করেছেন।

অন্যদিকে ডানপন্থীদের জোটভিত্তিক ঐক্য ছিলো বামপন্থী জোট থেকে বেশি সংগঠিত। তারা জনভাষা বুঝে কর্মসূচি বা পরিকল্পনা ঘোষনা করেন। পর্দার আড়ালের রাজনীতিতেও পিছিয়ে ছিলেন বামপন্থীরা।

ইতালির সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং ফরছা ইতালিয়ার নেতা সিলভিও বারলুসকোনি দুর্নীতির দায়ে দণ্ডিত হওয়ায় নির্বাচন করার স্বাভাবিক যোগ্যতা হারিয়েছেন। এতে ডান জোট ক্ষমতায় গেলেও বারলুসকোনি প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে বসতে পারবেন না বুঝতে পেরে পর্দার আড়াল থেকে জর্জা মেলোনির দল এফডিআইকে সহযোগিতা করেছেন। আর্থিক এবং রাজনৈতিক সকল প্রকারের সহযোগিতা দিয়েছেন। এতে তরতর করে এগিয়ে গিয়েছে মেলোনির দল এফডিআই। ৪ শতাংশ থেকে এক লাফে ২৪ দশমিক ৬ শতাংশ ভোট পেয়ে ডানপন্থীদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় দলে পরিণত হয়েছে দলটি।

ডানপন্থী নতুন সরকারের প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন জর্জা মেলানি। সঙ্গে সাবেক প্রধানমন্ত্রী সিলভিও বারলুসকোনি ও অন্য নেতারা। ছবি: সংগৃহীত

অন্যদিকে ডানপন্থীদের সব থেকে বড় দল বেরলুসকোনির ফরছা ইতালিয়া মাত্র ৮ শতাংশ ভোট পেয়ে চতুর্থ শ্রেণির দলে পরিণত হয়েছে।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, সিলভিও বারলুসকোনি ভোটের রাজনীতিতে নিজের দলকে পেছনে ফেলে মেলোনির দলকে সামনে এগিয়ে দিয়েছেন নিজের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিশ্চিৎ করার জন্য। তিনি যখন বুঝে ফেলেন তার ব্যক্তি ইমেজ এবং দলীয় ইমেজ ব্যবহার করে প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে বসা আর সম্ভব হবে না, তখন নিজের দলকে পেছনে ফেলে মেলোনিকে সহযোগিতা করেন। বিনিময়ে তাকে হয়তো ইতালির পরবর্তী কাপো দেল্লো স্তাতো বা রাষ্ট্রপতির চেয়ারে বসতে দেখা যাবে।

অভিবাসীরা কেন আতঙ্কিত?

সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রী জর্জা মেলোনিসহ ডান জোটের নেতারা সব সময় ইতালীয় অভিবাসীদের বিরুদ্ধে কড়া ভাষায় কথা বলেন। তারা নির্বাচনের আগে বলেছিলেন, সাগরপথে আর কাউকে ইতালিতে ঢুকতে দেওয়া হবে না। তারা ইতালির সীমান্তে নৌ-অবরোধ তৈরি করবেন। সব জায়গায় ইতালীয় নাগরিকদের সুযোগ-সুবিধার বিষয়ে অগ্রাধিকার দেবেন। অভিবাসী সংশ্লিষ্ট আইন আরও কঠোর করবেন। প্রয়োজনে নতুন আইন তৈরি করবেন।

এর আগে ডান জোটের অন্যতম নেতা মাত্তেয়ো সালভিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালে ইতালির অভিবাসীরা নানাভাবে নিগৃহীত হয়েছিলেন। কর্মস্থলসহ বিভিন্ন জায়গায় বৈষম্যের শিকার হয়েছিলেন। ইতালীয় নাগরিকত্ব গ্রহণের আইন এবং পেরমেচ্ছো দি সোজর্ণ বা স্টে-পারমিট নবায়নের আইন শক্ত করেছিলেন।

এবারও নির্বাচনের আগেও তারা অভিবাসীদের বিরুদ্ধে বেশ কড়া কথা বলেছেন। বিশেষ করে মুসলিম কম্যুনিটিকে নিয়ন্ত্রণের কথা বলেছেন। মুসলমানদের ইবাদতের জায়গাগুলো (ভাড়া করা নামাজের ঘর) নিয়ন্ত্রণের কথা বলেছেন, যা অভিবাসীদের মধ্যে কিছুটা হলেও আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে।

জর্জা মেলানি হবেন ইতালির প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী। ছবি: সংগৃহীত

এছাড়া ইতালীয় শ্রমিক সংস্থাগুলোর নেতৃত্ব দেন সাধারণত বামপন্থীরা। সেখান থেকেও অভিবাসীদের মধ্যে ডান রাজনীতি বিষয়ে আতঙ্ক বা বিভ্রান্তি ছড়ানো হতে পারে।

অভিজ্ঞদের অভিমত, ভোটের আগে ইতালীয় জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে ডান নেতারা অনেক কথা বলেছেন, কিন্তু বাস্তবে তা প্রয়োগ করবেন না। অনেক ক্ষেত্রে তারা ইচ্ছা করলেও অভিবাসীদের বিরুদ্ধে যে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারবেন না। কারণ অভিবাসীরা এখন ইতালীয় অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশে পরিণত হয়েছে। অনেক অভিবাসী ইতোমধ্যে ইতালীয় নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছেন। অভিবাসীদের একটি প্রজন্ম ১৮ বছর পার করেছে। এর ফলে অভিবাসীদের মধ্যে একটা বড় ভোট ব্যাংক তৈরি হয়েছে।

অন্যদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং মানবাধিকার সংস্থাগুলোরও কড়া দৃষ্টি থাকবে ইতালির নতুন সরকারের উপর। কারণ হবু প্রধানমন্ত্রী জর্জা মেলোনির অতীত কর্মকাণ্ড এবং কথাবার্তায় ইউনিয়নের নেতারা খুশি নন।

জর্জা মেলোনিকে যদি সুষ্ঠু ভবে দেশ পরিচালনা করতে হয় তবে ইউনিয়নের কথা শুনতে হবে। কারণ ইউনিয়ন থেকে বড় ঋণ নিয়ে ইতালির আর্থিক মেরুদন্ড সোজা রাখতে হয়।

নতুন সরকারকে যে যে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে

ইতালির নতুন সরকারকে সবচেয়ে বড় যে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে তা হলো, জ্বালানিসহ অন্যান্য দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অভিঘাত সামলানো।

জর্জা মেলোনি নির্বাচনের আগে বলেছেন, ট্যাক্স কমাবেন। সবার জন্য সরকার গঠন করবেন। কিন্তু রুশ-ইউক্রেইন যুদ্ধের ক্ষেত্রে ডান জোটের অন্যতম ২ নেতা বেরলুসকোনি এবং সালভিনি সরাসরি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের পক্ষে কথা বলেছেন। যা ইউরোপীয় ইউনিয়নকে ভাবিয়ে তুলেছে। কারণ এখন পর্যন্ত এই যুদ্ধের ব্যাপারে ইউনিয়ন তাদের ঐক্য ধরে রাখতে পেরেছে। কোন ভাবেই এই ঐক্য নষ্ট হোক তারা তা চান না।

ইতালিতে জ্বালানির দাম ভায়াবহ মাত্রায় বেড়েছে। ব্যবসায়ীরা বলেছেন, সরকার বিদ্যুৎ বিল, গ্যাস বিল নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে তাদের পেশা পরিবর্তন করতে হবে।

অন্যদিকে স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমগুলোর জরিপ বলছে, নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য মূল্য বৃদ্ধির কারণে প্রতি ৩ জন ইতালীয় নাগরিকের অন্তত ১ জন গত বছরের তুলনায় এ বছর মাসে প্রায় সাড়ে ৪০০ ইউরো কম খরচ করছে।

Comments

The Daily Star  | English

Economic expectations: Did govt fall short?

When an interim government was sworn into office following the ouster of the Awami League regime just 100 days ago, there was an air of expectation that the Prof Muhammad Yunus-led administration would take steps to salvage a scam-ridden financial sector and rescue an ailing economy.

6h ago