আকবর আলি খানের নির্বাচিত ১০ বই

আকবর আলি খান লিখেছেন সমাজ, সাহিত্য, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিষয়ে। ইতিহাসের ছাত্র হিসেবে ঘুরেছেন ইতিহাসের গলি-ঘুপচিতে। সুললিত বাংলা গদ্য ও ইতিহাসের দর্শন তার লেখাকে করেছে সহজবোধ্য ও শক্তিশালী। লেখনীর ধরন ও ভাষা কারুকাজের জন্য তাকে মনে করা হয় বাংলা মুলুকের উইল ডুরান্ট। তার কাজের ব্যাপ্তি ও গভীরতার শুলুক-সন্ধান করতে গেলে লেখক উইল ডুরান্টের কথা আসে। আরও মজার ব্যাপার হলো আকবর আলি খানের বইয়ে বিভিন্ন কোটেশনেও উঠে এসেছে এই মার্কিন পণ্ডিতের  কথা।

তার লেখা কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়; সাহিত্য, অর্থনীতি, ইতিহাস ও রাজনীতি। বিশেষ করে কবি জীবনানন্দের কবিতা বিশ্লেষণ পাঠককে চমকে দিয়েছেন। অর্থশাস্ত্রের জটিল বিষয়কে সহজ ও সরলভাবে উপস্থাপনার মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন। সমকালীন রাজনীতি ও সংকটের ব্যাখ্যা ও তার কার্যকারণ অনুসন্ধানের পাশাপাশি জনবুদ্ধিজীবীর ভূমিকা রেখেছেন। এ কারণে তার মৃত্যু মানুষকে ছুঁয়ে গেছে। আকবর আলি খানের ১০টি নির্বাচিত বই সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হলো।

পুরানো সেই দিনের কথা

'পুরানো সেই দিনের কথা' একজন বহুমাত্রিক ব্যক্তিত্বের উন্মেষ ও বিকাশের আত্মস্মৃতি। বইটি প্রকাশ করছে প্রথমা প্রকাশন। নবীনগরের জলাভূমিতে লালিত সাদাসিধে বালকটি ছিলেন কল্পনাবিলাসী ও অন্তর্মুখী। এক সময় মুখচোরা বালকটি মাঠপর্যায়ের দক্ষ প্রশাসক হন। দায়িত্ব নেন আইনশৃঙ্খলা, ভূমি প্রশাসন, উন্নয়ন প্রশাসন, নির্বাচন, এমনকি চা-বাগানের মতো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান পরিচালনার। এর মধ্যে দেখা দেয় মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহ দিনগুলো। ভূমিকা রেখেছেন অসামান্যভাবে।

অন্যদিকে আত্মজীবনী লিখতে গিয়ে লেখক তার পূর্বপুরুষদের পাশাপাশি নবীনগরের প্রেক্ষাপটও তুলে এনেছেন। আরও জানা যায়, কীভাবে তিনি ছোটবেলা থেকেই বইপাগল ছিলেন। নবীনগরে তেমন ভালো বই পাওয়া যেত না। ঢাকায় এলে বই পড়ার অতৃপ্ত আকাঙ্ক্ষা পূরণের সুযোগ পান। পাঠক থেকেই লেখক হলেন আকবর আলি খান। বহু জায়গায় বলেছেন, কোনো বই-ই দীর্ঘ গবেষণা ছাড়া তিনি লেখেননি। তার প্রথম বই বের হয় ৫২ বছর বয়সে। অনেকটা নীরদ সি চৌধুরীর মতো। ৫৬ বছর বয়সে আত্মজীবনী বের হয়েছিল।

বাংলাদেশের সত্তার অন্বেষা

'ডিসকভারি অব বাংলাদেশ' বইয়ের অনুবাদ বাংলাদেশের সত্ত্বার অন্বেষা। ইংরেজি বইটি বোদ্ধা মহলে সাড়া ফেললেও আরও বিস্তর পাঠক শ্রেণির কাছে পৌছানোর খেয়ালে বাংলায়ন করেন। এতে বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশ ও দেশের গুরুত্ব চিহ্নিতকরণের প্রয়াস রয়েছে। জনসংখ্যাধিক্য থাকলেও জাতিরাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশের আবির্ভাব অনেক দেরিতে। জাতিসংঘের প্রায় দুইশোর মতো সদস্যরাষ্ট্রের মধ্যে অংশগ্রহণের ভিত্তিতে বাংলাদেশ ১৩৩তম। বাংলাদেশের উদ্ভব, বিকাশ, সম্ভাবনা ও সংকট নিয়ে বয়ান করছেন বইটিতে। বাংলায়ন করেছেন আমিনুল ইসলাম ভূঁইয়া। প্রকাশ করেছে বাংলা একাডেমি।

বাংলাদেশের পর যেসব দেশ জাতিসংঘে যোগ দিয়েছে তাদের অধিকাংশই ক্ষুদে রাষ্ট্র। সাম্প্রতিককাল অব্দি ইতিহাসে তাদের স্বতন্ত্র ও প্রভাবশালী অবস্থান নেই। বাংলাদেশের পর যে অর্ধশতাধিক রাষ্ট্র জাতিসংঘে যোগ দিয়েছে (১৯৯৫ সাল নাগাদ) তার মধ্যে ২৫টির জনসংখ্যা দশ লাখেরও কম; ১৭ টির জনসংখ্যা এক কোটির নিচে। অন্যদিকে ১৯৭১ সালে জন্মের সময়ই জনসংখ্যায় পৃথিবীর অষ্টম বৃহৎ দেশ। নিশ্চিত করে বলা যায়, বাংলাদেশ নিজের অস্তিত্ব জানান দেয়া সর্বশেষ বৃহৎ জাতি-রাষ্ট্র।

রাজনৈতিক সত্তা হিসেবে নবীন হলেও বাংলাদেশ নামটি কিন্তু কোনভাবেই নতুন নয়। 'বঙ্গ' শব্দ থেকে বাংলাদেশ শব্দের উদ্ভব। প্রাচীন হিন্দু শাস্ত্র 'ঐতরেয় আরণ্যক' এ বঙ্গ শব্দের সন্ধান মিলে। ভাষাবিজ্ঞানীগণ মনে করেন যে, বঙ্গ শব্দের উৎস প্রতিবেশী ভাষার মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায়। 'বঙ্গ' শব্দটি তিব্বতি শব্দ 'বঙস্' থেকে উদ্ভূত, যার মানে 'ভেজা' ও 'আদ্র'। প্রাচীন সব বয়ানেই বাংলা অঞ্চলকে বৃষ্টিস্নাত ও ভেজা অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ষোড়শ শতাব্দীর ঐতিহাসিক আবুল ফজল আবার  অন্য এক ব্যাখ্যা দাড় করিয়েছেন। তার মতে, বাংলার আদি নাম ছিল 'বাং'। এ অঞ্চলের শাসকগোষ্ঠি সারা প্রদেশে ১০ গজ সমান উঁচু ও ২০ গজ প্রস্থেও মাটির ঢিবি তৈরি করেছিল, যা 'আল' হিসেবে পরিচিত ছিল। 'বাং' এর সঙ্গে 'আল' প্রত্যয় যোগে বাঙ্গালা নাম গড়ে উঠেছে এবং প্রচলিত হয়েছে।

অন্ধকারের উৎস হতে

'অন্ধকারের উৎস হতে' বাঙালির ভুবনের ছয়টি জটিল ও দুর্জ্ঞেয় প্রহেলিকা সম্পর্কে আলোর অন্বেষা। আলোচনা শুরু  বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে রহস্যময়ী 'বনলতা সেন'কে নিয়ে। চূড়ান্ত বিশ্লেষণে বনলতার যে চিত্র ফুটে উঠেছে তার সঙ্গে চিরাচরিত ব্যাখ্যার কোন মিল নেই। মূলত এ প্রবন্ধের সূত্র ধরেই পরবর্তীতে 'চাবিকাঠির খোঁজে' নামে সম্পূর্ণ একটি বই।

দ্বিতীয় নিবন্ধে রয়েছে বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদের বিভিন্ন উপেক্ষিত মাত্রা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা। তৃতীয় নিবন্ধের উপজীব্য হলো রাজনৈতিক অস্থিরতা। রূপসী বাংলার অনির্বচণীয় নিসর্গের পটভূমি টিপাইমুখ বাঁধ একটি নতুন অশনি সংকেত। এই বাঁধের স্বল্পমেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব সমূহের 'অন্ধকারের উৎস হতে' বাঙালির ভুবনের ছয়টি জটিল ও দুর্জ্ঞেয় প্রহেলিকা সম্পর্কে আলোর অন্বেষা। আলোচনা শুরু  বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে রহস্যময়ী 'বনলতা সেন'কে নিয়ে। চূড়ান্ত বিশ্লেষণ করা হয়েছে একটি নিবন্ধে। 'ভিক্ষার ঝুড়ির' অপবাদ নিয়ে যে রাষ্ট্রের জন্ম আজ সে ঘুরে দাঁড়িয়েছে, 'বাংলাদেশের অর্থনীতি : আশা নিরাশার দোলাচলে' শীর্ষক নিবন্ধে বাংলাদেশের অর্থনীতির সাম্প্রতিক সাফল্য ও ব্যর্থতা তুলে ধরা হয়েছে। সর্বশেষ প্রবন্ধে বাংলাদেশ ও বিশ্ব অর্থনীতির প্রেক্ষিতে ব্যাংক ব্যবস্থা ও নৈতিকতাবোধ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। প্রসঙ্গে ক্ষুদ্র ঋণ ও ইসলামী ব্যাক নিয়ে কিছু মূল্যবান তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে।

আপাতদৃষ্টিতে কোন কোন প্রবন্ধের বিষয় জটিল মনে হলেও এই বইয়ের প্রতিটি প্রবন্ধ রম্য রচনার আকারে উপস্থাপন করা হয়েছে। বক্তব্যের স্পষ্টতা ও সরলতা পাঠকদের অন্ধকারের উৎস থেকে আলো পথে টেনে নিয়ে যাবে। হাসতে হাসতে পাঠক নিজের অজান্তেই জড়িয়ে যাবেন বাঙালির জগত ও জীবনের অনেক বিতর্কে ।

চাবিকাঠির খোঁজে-নতুন আলোকে জীবনানন্দের 'বনলতা সেন'

চাবিকাঠির খোঁজে-নতুন আলোকে জীবনানন্দের 'বনলতা সেন': সাবেক আমলা যখন বাংলাসাহিত্যের সবচেয়ে বহুল পরিচিত কবিতার যৌক্তিক অর্থ উদ্ধারে নামার তাড়না অনুভব করে তা দুটো বার্তা দেয়; বাংলাদেশের সাহিত্য সমালোচনার পরিস্থিতি ততটা ভালো নয়। আবার এটাও বলে, অর্থসচিব কিংবা সরকারি আমলাও চাইলে ভূমিকা রাখতে পারেন।

জীবনানন্দের কবিতা পাঠের ক্ষেত্রে কিছু সূত্র জরুরি বলে মনে করেন আকবর আলি খান। এ সূত্রগুলোকে উনি চাবিকাঠি হিসেবে নাম দিয়েছেন। অঙ্কের সূত্রে গোজামিল করলে যেমন অঙ্কের ফল মিলবেনা তেমনি জীবনানন্দের কবিতার চাবিকাঠি উদ্ধার করতে না পারলে অর্থোদ্ধার করা সম্ভব হবে না। কি সেই চাবিকাঠিগুলো?

রবীন্দ্রনাথ, নজরুল বা অন্যান্য প্রধান কবিদের ব্যক্তিগত জীবন সমকালে যেভাবে আলোচনায় ছিল বা তারা যেভাবে লোকচক্ষুর সামনে থেকেই সাহিত্যচর্চা করে গেছেন সেখানে জীবনানন্দ ব্যতিক্রম। তিনি অনেকটা নিভৃতে কাব্যদেবীর সাধনা করে গেছেন। কিন্তু কবি তো তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, প্রতিবেশ ও পরিবেশ ছাড়িয়ে কবিতা লিখতে পারেন না। জীবনানন্দের সঙ্গে ব্যক্তিগত পরিচয় না থাকাতে বা ব্যক্তি পরিচয় শুরুর দিনগুলোতে না উঠে আসাতে তার কবিতার পাঠোদ্ধারে অনেক সাহিত্য সমালোচকগণ ভুল করেছেন।

বইয়ের শুরুতে গবেষক তুলে এনেছেন জীবনানন্দ গবেষকরা যে তার সাধু-সন্ত ইমেজ দাঁড় করিয়েছেন তা কীভাবে দুর্বল ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে আছে। ভূমেন্দ্র গুহ সম্পাদিত জীবনানন্দের দিনলিপি এক্ষেত্রে আকবর আলি খানকে অনেক রসদ জুগিয়েছে। ওই দিনলিপির বরাতে জীবনানন্দেও মানুষের যে রূপ দেখা যায় তা গৎবাঁধা ভাবমূর্তিও সঙ্গে মোটেও খাপ খায় না:

:         দিল্লিতে পতিতালয়ে গমনের ইঙ্গিত পাওয়া যায়

:         মনিয়া নামে একটি কিশোরী মেয়ের কথা উঠে আসে

:         কাজিন বা শোভনার প্রতি একতরফা প্রেম নিবেদেন এবং তাকে না পাওয়ার অতৃপ্তি।

জীবনানন্দের জীবনে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হচ্ছে ব্রাহ্ম ধর্ম। পারিবারিক ও সাংস্কৃতিক বলয়ে ব্রাহ্ম ধর্মের অনুসারীদের সঙ্গে উঠাবসা থাকলেও তিনি এই ধর্ম গ্রহণ করতে পারেনি। আবার ততটা সাহসী না হওয়ায় ওই ধর্মমতের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েও কিছু বলতে পারেননি। ব্রাহ্ম ধর্মের অনুসারীদের পরিবারের সদস্য হওয়ায় প্রথমদিকে চাকরি পেতে সুবিধা হল তার বেশিরভাগ চাকরি টিকেনি একটা বড় কারণ ব্রাহ্ম ধর্ম। বিভিন্ন লেখায় অশ্লীলতার অভিযোগ তুলে তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। বিভিন্ন রূপকে কথা বলতে হয়েছে তাকে।

বাংলা সাহিত্যের পাঠকপ্রিয় কবিতার তালিকায় বনলতা সেন অন্যতম। এর রহস্যময়তার খোঁজে বাংলা কবিতার মোনালিসা হিসেবে অভিহিত করেন কেউ কেউ। আকবর আলি খান তার 'চাবিকাঠির খোঁজে'তে যেভাবে বনলতা সেনের ব্যবচ্ছেদ করেছেন তা পুরনো সব তত্ত্ব পাল্টে দিয়েছে। এর প্রতিটি বাক্য ও শব্দগুচ্ছ ধরে ধরে ব্যবচ্ছেদ করেছেন এবং দক্ষ শল্য চিকিৎসকের মতো নিজস্ব অভিমত ব্যক্ত করেছেন।

অনেক মতামত গ্রহণে কেউ কেউ ইতস্তত করতে পারেন কিন্তু আকবর আলি খানের যুক্তিকে হেসে উড়িয়ে দেয়া অসম্ভব। হাজার বছর ধরে পথ হাঁটার মাধ্যমে তিনি যে বৌদ্ধ ধর্মের জন্মের চক্র বুঝাতে পারেন, নাটোরের বনলতা সেন বলতে ওই অঞ্চলের কোন এক রূপজীবীর সঙ্গে স্বল্প সময়ের সান্নিধ্যকে বুঝাতে পারেন। এতদিন কোথায় ছিলেন? এ প্রশ্নের মাধ্যমে নাটোরের বনলতা সেনের সম্পর্কে জড়াতে অনিচ্ছা আবার মৃদু টিপ্পনীও রয়েছে। বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে আলোচিত এ কবিতা নিয়ে আকবর আলি খানের মতামত ও বিশ্লেষণ সব ধরণের পাঠককে মুগ্ধ করবে।

আজব ও জবর-আজব অর্থনীতি

যেকোনো জটিল বিষয়কে সহজে ও রসিয়ে লেখার পারঙ্গমতা প্রদর্শনের উৎকৃষ্ট উদাহরণ 'আজব ও জবর-আজব অর্থনীতি'। অর্থনীতি এত রসালো হতে পারে বাংলা ভাষায় খুব সম্ভব তার আগে কেউ দেখাতে পারেননি। সমাজবিজ্ঞানের শাখা হিসেবে অর্থশাস্ত্র একসময় হতাশাগ্রস্ত বিজ্ঞান নামে পরিচিত ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক দশকগুলোতে বেশ অগ্রসর হয়েছে এ ডিসিপ্লিনটি। এখন তার আওতায় শুধু চাহিদা-জোগান বা রুটি-রোজগারের মতো আটপৌরে সমস্যায় সীমিত নয়। অর্থনৈতিক পদ্ধতি ব্যবহৃত হচ্ছে রাষ্ট্রবিজ্ঞান, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, আইনশাস্ত্র, ইতিহাস, সংগঠন ও সিদ্ধান্ত তত্ত্বে। সমাজতত্ত্বের সব শাখায় তার সরব পদচারণাতো রয়েছেই। জন্ম, মৃত্যু, বিবাহ, ধর্ম, এমনকি ভাষা নিয়ে গবেষণায়ও প্রয়োগ করা হচ্ছে অর্থশাস্ত্রের বিভিন্ন সূত্র।

বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য এসব আলোচনা বাংলা ভাষায় দেখা যায় না। এখানে অর্থনীতির আলোচনা সেই মান্ধাতা আমলের বিষয় ও বাম-ডানের তর্কে সীমাবদ্ধ। গতানুগতিক গণ্ডি বাইরের কিছু অর্থনৈতিক তত্ত্বের সঙ্গে এ মুল্লুকের পাঠককে পরিচয় করে দেয়ার মিশন ছিল আকবর আলি খানের। স্টিভেন ডি লেভিট ও স্টিফেন জে ডুবনারের লেখা দুটি বই ফ্রিকোনমিকস ও সুপারফ্রিকোনমিকস  বইগুলোতে যে বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে তা অত্যন্ত সরল বাংলায় প্রকাশ করেছেন আকবর আলি খান। প্রাত্যহিক জীবনের বিভিন্ন মজার মজার ঘটনা, দেশ-বিদেশের বিভিন্ন ঘটনাকে অর্থশাস্ত্রের ছাঁচে ফেলে চমৎকার ব্যাখ্যা দিয়েছেন।

পরার্থপরতার অর্থনীতি

বইটিতে অর্থনীতির মতো জটিল ও দুর্বোধ্য বিষয়টি যে রম্যরচনার ঢঙে ও বৈঠকী মেজাজে তুলে এনেছেন। এতে একেবারে সাধারণ পাঠকের জন্যও হয়েছে সহজবোধ্য। বাস্তব জীবনের অর্থনৈতিক সমস্যা সম্পর্কে মূলধারার অর্থনীতির বক্তব্য তুলে ধরার লক্ষ্যে এই গ্রন্থে লেখকের পনেরটি প্রবন্ধ সন্নিবেশিত করা হয়েছে। বইটির শুরু দানখয়রাতের অর্থনীতি নিয়ে। আরও রয়েছে দুর্নীতির অর্থনীতি, সংস্কারের রাজনৈতিক অর্থনীতি, মেরামত ও পরিচালনার অর্থনীতি, বাংলাদেশে বন্যা নিয়ন্ত্রণের রাজনৈতিক অর্থনীতি,স্বাস্থ্য অর্থনীতি ও লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্যের অর্থনীতির মনোজ্ঞ বিশ্লেষণ। অর্থনীতির সবচেয়ে জটিল সমস্যা অর্থনৈতিক অসাম্য সম্পর্কে রয়েছে দুটি নিবন্ধ।

'অন্ধকারের উৎস হতে' বাঙালির ভুবনের ছয়টি জটিল ও দুর্জ্ঞেয় প্রহেলিকা সম্পর্কে আলোর অন্বেষা। আলোচনা শুরু  বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে রহস্যময়ী 'বনলতা সেন'কে নিয়ে চূড়ান্ত বিশ্লেষণ। অর্থনীতির সবচেয়ে জটিল সমস্যা অর্থনৈতিক অসাম্য সম্পর্কে রয়েছে দুটি নিবন্ধ।

লেখকের দৃষ্টি শুধু বর্তমানেই সীমাবদ্ধ নয়। ভবিষ্যতের অর্থনৈতিক প্রবণতা সম্পর্কে বিশ্লেষণ রয়েছে 'আজি হতে শতবর্ষ পরে' শীর্ষক প্রবন্ধে। অতীতের প্রসঙ্গ এসেছে দুটি নিবন্ধে- 'সোনার বাংলা: অর্থনৈতিক ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত' এবং 'ভারতীয় অর্থনীতির উত্থান ও পতন'। তিনটি মূল্যবান রচনা রয়েছে অর্থনীতিবিদদের সম্পর্কে। গ্রন্থকারের সবচেয়ে পছন্দের অর্থনীতিবিদ ছিলেন মোল্লা নসরুদ্দীন। 'মোল্লা নসরুদ্দীনের অর্থনীতি' শীর্ষক নিবন্ধে গ্রন্থকার সুন্দরভাবে দেখিয়েছেন যে, মোল্লার গালগপ্প ও কৌতুক-চুটকির মধ্যেই আধুনিক অর্থনীতির অনেক মূল্যবান সূত্র লুকিয়ে রয়েছে। ইংরেজিতে একটি প্রবাদ রয়েছে, যুদ্ধ এতই গুরুত্বপূর্ণ যে তা শুধু সেনানায়কদের কাছে ছেড়ে দেওয়া যায় না। অর্থনৈতিক সমস্যাও এতো জরুরি যে, এ সব সমস্যার সমাধানের জন্য শুধু অর্থনীতিবিদদের উপর নির্ভর করা বাঞ্ছনীয় নয়। তাই অর্থশাস্ত্রকে সাধারণ পাঠকের কাছে পৌছে দেওয়ার ইচ্ছা ছিল আকবর আলি খানের।

দারিদ্রের অর্থনীতি অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যৎ

দারিদ্র্য এ অঞ্চলের প্রধানতম সমস্যা। যুগ যুগ ধরে অসংখ্য প্রকল্প তৈরি হয়েছে দারিদ্র্য কমানোর লক্ষ্য নিয়ে। খরচ করা হয়েছে কয়েক হাজার কোটি টাকা। কিন্তু বাংলা ভাষায় কেবলই দারিদ্র্য নিয়ে একমাত্র বইটি আকবর আলি খানেরই লেখা। 'দারিদ্রের অর্থনীতি অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যৎ' এর ভূমিকায় তিনি লিখেছেন, 'দীর্ঘ ৫২ বছর ধরে দারিদ্র্য নিয়ে পড়াশোনা করেছি, কোথাও নিরীক্ষা করেছি, কোথাও সরাসরি কাজ করেছি।

এসব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই আমি এই বই লিখেছি। আশা করি, এই বইয়ের মাধ্যমে দারিদ্র্য সম্পর্কে আমার চিন্তাভাবনা বর্তমান প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে পারব।' দারিদ্র্যের সঙ্গে একান্ত ব্যক্তিগত পরিচয়ের কথা তুলে ধরেছেন একেবারে ভূমিকার শুরুতে। তিনি লিখেন, 'বিশ্বের একটি চরম দারিদ্র্যের গহ্বর ব্রিটিশ ভারতে আমার জন্ম। ১৯৫৪-১৯৫৫ সালে স্মরণাতীতকালের সবচেয়ে প্রলয়ঙ্করী বন্যা দেখেছি। বাল্যকালে গ্রামে বিদ্যুৎ ছিল না, হারিকেনের আলোয় পড়াশোনা করে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছি। ছাত্রজীবন থেকেই দরিদ্রদের সমস্যা নিয়ে অনেক ভেবেছি'। তাই প্রসঙ্গত এসব নিয়ে লিখেছেন।

অবাক বাংলাদেশ: বিচিত্র ছলনাজালে রাজনীতি

'অবাক বাংলাদেশ: বিচিত্র ছলনাজালে রাজনীতি' বইটিতে অর্থনৈতিক অগ্রগতির প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকটের বিশ্লেষণ করেছে। ভূমিকায় বলেছেন, 'বাংলাদেশের অনেক অর্জনের জন্য আমি গর্বিত। তবু রাজনৈতিক অবক্ষয় ও সুশাসনের ক্রমাগত অধোগতি আমার প্রজন্মের যারা আমার মতো গণতান্ত্রিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল, তাদের জন্য দৈহিক যন্ত্রণার চেয়েও মর্মান্তিক মানসিক যন্ত্রণার সৃষ্টি করেছে। এই গ্রন্থের জন্ম এই যন্ত্রণাবোধ থেকেই।' আমলাজীবনের অভিজ্ঞতার সঙ্গে গভীর তত্ত্ব ও তথ্যের মিশ্রণে লেখা বই বাংলাদেশের প্রশাসন নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রকাশনা।

ইংরেজি ভাষায় লেখার সম্যক সক্ষমতা সত্ত্বেও এ দেশের মানুষের জন্য বাংলা ভাষায় লেখার মাধ্যমে তার দরদ প্রকাশ পেয়েছে। ভূমিকায় আরও বলেন, 'প্রথমে ইচ্ছে ছিল ইংরেজি ভাষায় বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে একটি গবেষণাগ্রন্থ লিখব। পরে ভেবে দেখলাম ইংরেজিতে বই লিখে হয়তো কিছু পণ্ডিতের সাধুবাদ পেতে পারি কিন্তু তাতে আমার উদ্দেশ্য সাধিত হবে না। আমি চাই বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ রাজনৈতিক সমস্যা নিয়ে চিন্তা করুক এবং নিজেরাই সংস্কারের পথ বেছে নিক। তাই সাধারণ পাঠকদের জন্য বইটি বাংলায় লেখা হয়েছে।'

অন্য সব বইয়ের মতো রাজনীতি নিয়ে লেখা এ বইটিও গবেষণার ভিত্তিতে লেখা হয়েছে বলে দাবি আকবর আলি খানের। তবে গবেষণার ফলাফলকে সাধারণ মানুষের উপযোগী করে উপস্থাপনের চেষ্টা করেছেন তিনি। গবেষণার বক্তব্য চটুল ভঙ্গিতে অনেক সময় রম্যরচনার শৈলীতে পেশ করেছেন। এ বইটি লেখার উদ্দেশ্যও লেখক স্পষ্ট করে দিয়েছেন। বাংলাদেশের মানুষের রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধিই এ বইয়ের একমাত্র উদ্দেশ্য। চার্লস দ্য গলের উক্তি প্রাসঙ্গিকভাবে বলছেন- Politics is too serious a matter to be left to the politicians।

বাংলাদেশে বাজেট অর্থনীতি ও রাজনীতি

অর্থশাস্ত্র নিয়ে আকবর আলি খানের বইগুলো একে অন্যের সঙ্গে যুক্ত। এ বইটি যেমন ২০১৩ সালে প্রকাশিত আজব ও জবর আজব অর্থনীতি বইয়ের পরম্পরা। এ লেখকের একই বই পড়ার পর পাঠকের অনেক প্রশ্ন তৈরি হয়, আরও জানার আগ্রহ জন্মায়। পাঠকের এ আগ্রহ নিভৃত করতে পরবর্তী বইয়ে হাত দিতেন তিনি। 'বাংলাদেশে বাজেট অর্থনীতি ও রাজনীতি' বইয়ের ভূমিকাতে লিখেন, 'আজব জবর আজব অর্থনীতি' বইয়ে 'সরকারের অপচয়: রাজনৈতিক অর্থনীতি' শীর্ষক একটি প্রবদ্ধ ছাপা হয়।

এই প্রবন্ধে সরকারের অপচয়ের নৈতিক, আইনগত ও অর্থনৈতিক দিক সম্পর্কে আলোচনা করা হয়। যেহেতু সরকারের আয়-ব্যয় বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে সরকারি অপচয়ের সংজ্ঞা একান্ত জরুরি, সেহেতু এই নিবন্ধ সামান্য পরিবর্তনসহ এই বইয়ে পুনর্মুদ্রণ করা হয়েছে।'

বাংলাদেশে কীভাবে বাজেট প্রণয়ন হয়, সংসদে যায় এবং তার উপরে সরকারী ও বিরোধী দল কত ঘণ্টা আলোচনার সুযোগ পায় তা উঠে এসেছে বইটিতে। ১৯৯৬ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত সংসদে বাজেট আলোচনায় গড়ে সময় ব্যয় হয়েছে ৩৫ দশমিক ১০ ঘণ্টা। বইটিতে শেয়ার অপর একটি সারণিতে দেখা গেছে, ১৯৯৬ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত সংসদে বাজেট আলোচনায় ক্ষমতাসীন দলের গড় সময় ছিল ২৩ দশমিক ৪৩ ঘণ্টা। এবং বিরোধী দলের গড় সময় ছিল ১১ দশমিক ৬৩ ঘণ্টা। ১৯৯৬ সালে বাজেট আলোচনায় বিরোধী দলের সময় ছিল ৪৯ দশমিক ১ শতাংশ। ২০০০ সালে সর্বনিম্ন ৪ দশমিক ৬ শতাংশ সময় বরাদ্দ পেয়েছিল বিরোধী দল। সংসদীয় গণতন্ত্রের সবচেয়ে সক্রিয় দিনগুলোতে বাজেট আলোচনার এ সকল উপাত্তের পাশাপাশি গত দুই সংসদের উপাত্ত উপস্থাপিত হলে পাঠকের জন্য আরও লাভজনক হতো। 

কিন্তু বই দুটিতে গত শতকের গুরুত্বপূর্ণ অর্থনীতিবিদ জে এম কেইনসের একটি উক্তি ব্যবহৃত হয়েছে। তিনি বলেছিলেন, `পিরামিড নির্মাণ, ভূমিকম্প এমনকি যুদ্ধ সম্পদ সৃষ্টি করতে পারে।'

বাংলায় ইসলাম প্রচারে সাফল্য

বিশাল ভারতবর্ষের ছোট্ট একটি অংশ পূর্ববাংলা। এখানে কেন মুসলমানদের সংখ্যাধিক্য তা ঐতিহাসিক ও সমাজ বিশ্লেষকদের জন্য বিশাল একটি ধাঁধাঁ। বিভিন্ন জনের মতে মিলের চেয়ে অমিলই বেশি। কেউ কেউ বলেন, তলোয়ারের জোরে বা মুসলমান শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় এ দেশে ইসলাম প্রচার হয়েছে। কিন্তু যুক্তি ও তথ্য তার স্বপক্ষে যায় না। আবার কেউ কেউ মনে করেন, আরব দেশ ও মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসা সুফি-দরবেশরাই এ দেশে ইসলাম প্রচার ও প্রসারে ভূমিকা রেখেছেন।

এ প্রস্তাবনাটিতেও শতভাগ একমত হওয়া যায় না। কারো কারো মত, এ দেশের মুসলমানদের বড় অংশটাই নিম্ববর্ণেও হিন্দুদের মধ্য থেকে ধর্মান্তর প্রক্রিয়ায় মুসলমান হয়েছে। বাংলাদেশে ইসলামের প্রচার ও বিস্তার নিয়ে এমনতর পারস্পরিক সাংঘর্ষিক মতামতের নিঁখুতভাবে বিশ্লেষণ করেছেন আকবর আলি খান তার এই বইয়ে।

Comments

The Daily Star  | English
Anti-Discrimination Students Movement

Students to launch political party by next February

Anti-Discrimination Student Movement and Jatiya Nagorik Committee will jointly lead the process

10h ago