‘হাওয়া’ ও বন বিভাগের ‘খই ভাজা’

সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত আলোচিত চলচ্চিত্র 'হাওয়া'র পরিচালকের বিরুদ্ধে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন-২০১২ লঙ্ঘনের অভিযোগে মামলা করেছে বন বিভাগ। অভিযোগ, তারা (বন বিভাগ) নাকি একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত চলচ্চিত্রটির রিভিউয়ে পড়েছে, এই সিনেমায় একটি পাখিকে (শালিক) হত্যা করে চিবিয়ে খেয়েছেন অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী।

এই অভিযোগে ২০ কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ মামলা করেছেন বন্যপ্রাণি পরিদর্শক নারগিস সুলতানা। শুধু তাই নয়, 'হাওয়া'র সেন্সর ছাড়পত্র বাতিল করে বাংলাদেশের বাইরে প্রচার, সম্প্রচার ও প্রদর্শন বন্ধ করতে আইনি নোটিশও পাঠিয়েছেন একজন আইনজীবী। নোটিশে বলা হয়, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডের ছাড়পত্র পেয়ে ২৯ জুলাই মুক্তিপ্রাপ্ত 'হাওয়া' সিনেমায় ট্রলারে থাকা একটি খাঁচায় শালিক পাখি বন্দি অবস্থায় দেখা যায়। একপর্যায়ে সেটিকে হত্যা করে খাওয়ার দৃশ্য দেখানো হয়েছে—যা বণ্য প্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন, ২০১২-এর সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।

সঙ্গত কারণেই বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ প্রতিক্রিয়া দিচ্ছেন, সমালোচনা করছেন। প্রশ্ন হলো, বন বিভাগের মতো একটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান কী করে এমন একটি মামলা করলো? তাদের আর কোনো কাজ নেই? বাস্তব জীবন ও সিনেমার মধ্যে যে পার্থক্য, সেটি তাদের অজানা? কোনো একটি পত্রিকায় প্রকাশিত রিভিউ পড়ে মামলা করে দেওয়া যায়?

গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, চলচ্চিত্রটির রিভিউতে লেখা হয়েছে, 'মাছ ধরা বোট নয়নতারার সরদার চান মাঝি একটা পাখি পোষে। নিজে পানি পানের সময় পাখির খাঁচায়ও সে পানি ঢেলে দেয়। নিয়ম করে খেতে দেয় পাখিটিকে। আবার পথ হারিয়ে এই শালিককে উড়িয়ে দেয় সে। পোষা পাখি ফিরে না আসায় আশা খোঁজে। তারপর পাখি ফিরে আসে। সেটিকে পুড়িয়ে উদরস্থ করতেও সময় লাগে না চানের। হলভর্তি দর্শক চোখমুখ কুঁচকে চঞ্চল চৌধুরীর চিবিয়ে চিবিয়ে পোষা পাখির হাড়-মাংস খাওয়া দেখেন। তীব্র রোমাঞ্চ আর ঘৃণা নিয়ে তাকান। দৃশ্যটি তাদের মাথায় গেঁথে যায় অনেক দিনের জন্য।'

এই রিভিউ প্রকাশের পর হাওয়া চলচ্চিত্রে একটি শালিক পাখিকে খাঁচায় আটকে রাখা ও এক পর্যায়ে হত্যা করে খাওয়ার দৃশ্য দেখানোর মাধ্যমে বন্যপ্রাণী আইন লঙ্ঘন হয়েছে বলে বিবৃতি দেয় দেশে পরিবেশ ও প্রকৃতি নিয়ে কাজ করা ৩৩টি সংগঠনের সমন্বিত প্রয়াস বাংলাদেশ প্রকৃতি সংরক্ষণ জোট (বিএনসিএ)।

এর পরদিন প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে চলচ্চিত্রটি দেখে আইন লঙ্ঘনের প্রমাণ মিলেছে বলে জানান বন অধিদপ্তরের গঠিত তদন্ত কমিটির সদস্যরা।

কী অদ্ভুত! সিনেমায় একটি পাখি হত্যার দৃশ্য দেখে উদ্বেগ জানিয়েছে পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর জোট! এই সংগঠনগুলোর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা কোনো দিন সিনেমা দেখেনেনি? বাস্তবতা ও সিনেমার পার্থক্য তারা বোঝেন না? সম্ভবত আলোচনায় আসার জন্য, সংবাদ শিরোনাম হওয়ার জন্য তারা এমন একটি সময়ে এই বিষয়ে বিবৃতি দিয়েছেন, যখন 'হাওয়া' সিনেমাকে কেন্দ্র করে অনেক দিন পরে বাংলা চলচ্চিত্রে একটি ইতিবাচক হাওয়া বইতে শুরু করেছে। হলভর্তি দর্শক। এমন একটি সময়ে সিনেমাটিকে বিতর্কিত করা কিংবা বাংলা চলচ্চিত্রকে প্রশ্নের মুখে ফেলার পেছনে অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে কি না, সেটিও খতিয়ে দেখা দরকার।

সিনেমার দৃশ্যে যে পাখি হত্যা করে চিবিয়ে খাওয়ার দৃশ্য দেখানো হয়েছে, সেটি যে আসলেই শালিক পাখি ছিল না, এটি বোঝার জন্য সিনেমাবোদ্ধা হওয়ার দরকার হয় না। সিনেমায় যে ধর্ষণের দৃশ্য দেখানো হয়, সেটি কি আসলেই ধর্ষণ? সিনেমায় যে খুন দেখানো হয়, সেটি কি আসল খুন? সিনেমায় যে বন্দুক দিয়ে বাঘ ও হরিণ শিকার দেখানো হয়, সেখানে কি আসলেই বাঘ ও হরিণ হত্যা করা হয়?

একটি পাখিকে খাঁচায় পুরে রাখা এবং চিবিয়ে খাওয়ার অভিযোগে যদি সিনেমার পরিচালকের বিরুদ্ধে মামলা হয়, তাহলে সারা দেশের চিড়িয়াখানায় যে বণ্যপ্রাণি আটকে রাখা হয়েছে, সেজন্য কি এখন বন বিভাগ প্রাণিসম্পদমন্ত্রীর বিরুদ্ধে মামলা করবে? রাজধানীর কাঁটাবনসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে খাঁচায় রেখে যে বণ্যপ্রাণি ও পাখি বিক্রি করা হয়, সেগুলো কি অবৈধ? প্রাণি অধিকারের ধোঁয়া তুলে এইসব প্রাণি ও পাখি বিক্রি বন্ধ করা হবে?

সিনেমায় পাখি হত্যা দেখানো হয়েছে বলে যদি পরিচালকের বিরুদ্ধে মামলা হয়, তাহলে এ যাবৎ পৃথিবীতে যত সিনেমায় ধর্ষণের দৃশ্য দেখানো হয়েছে, যত খুনের দৃশ্য দেখানো হয়েছে, সেইসব ঘটনায় ভিলেনের চরিত্রে অভিনয়কারীদের বিরুদ্ধে কি ধর্ষণ ও হত্যা মামলা করা হবে?

সিনেমায় পাখি খাঁচায় পুরে রাখার দৃশ্য যদি অপরাধ হয় তাহলে এ যাবৎ পৃথিবীতে যত নারীর নগ্ন শরীরের ছবি আঁকা হয়েছে, সেইসব শিল্পীর বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করা হবে?

সুন্দরবনসহ সারা দেশের বন যে উজাড় হয়ে যাচ্ছে; প্রতিদিন যে বন বিভাগের চোখের সামনে বনজসম্পদ ধ্বংস হচ্ছে এবং এই বিভাগের অসাধু কর্মকর্তা কর্মচারীরাই বনের সম্পদ লুটপাট করে শত কোটি টাকার মালিক হচ্ছেন (উদাহরণ ওসমান গনি), সেগুলোর বিরুদ্ধে বন বিভাগ কয়টা মামলা করেছে?

প্রবাদ আছে 'নেই কাজ তো খই ভাজ'। এইসব করে সংবাদ শিরোনাম হওয়া যায়, কিন্তু তাতে বন বিভাগের মতো একটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান নিয়ে মানুষ হাসাহাসি করে। এমনিতেই সরকারি কর্মচারীদের অনিয়ম-দুর্নীতি-লুটপাট নিয়ে প্রতিনিয়ত সংবাদ প্রকাশিত হয়; মানুষ তাদের ওপরে ভয়াবহ রকমের ক্ষুব্ধ। তার ওপর এইসব হাস্যরসের জন্ম দিয়ে তারা নিজেদের আরও বিতর্কিত করছেন।

সিনেমা আর বাস্তবের মিল-অমিলের বিষয়গুলো না বুঝে তারা যে মামলা করলেন, তাতে ভবিষ্যতে নাটক-সিনেমা-ছবিসহ অন্যান্য শিল্পমাধ্যমে, শিল্পের প্রয়োজনে বন্যপ্রাণি নিয়ে কোনো ধরনের কাজ করার কেউ সাহস দেখাবেন না। এর মধ্য দিয়ে শিল্পের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হবে।

স্মরণ করা যেতে পারে, ২০২০ সালের ডিসেম্বরে 'আই থিয়েটার' নামক একটি অ্যাপে আংশিকভাবে মুক্তি পায় 'নবাব এলএলবি' নামে একটি সিনেমা—যার একটি দৃশ্যে যে নারীকে ধর্ষণ করা হয়েছে, তিনি থানায় মামলা করতে যান। যেখানে পুলিশের একজন এসআই ওই নারীকে ধর্ষণ বিষয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন করেন। এ নিয়ে আপত্তি জানায় পুলিশ। পরে সিনেমার পরিচালক অনন্য মামুন ও অভিনেতা শাহীন মৃধাকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। তাদের বিরুদ্ধে পর্নোগ্রাফি আইনে মামলা করা হয়। তখনও বাস্তবতা ও সিনেমার মধ্যে পার্থক্য এবং শিল্পীর স্বাধীনতার প্রশ্নটি সামনে আসে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো যদি এভাবে নির্মাতা ও শিল্পীদের বিরুদ্ধে মামলা করে, গ্রেপ্তার করে, তাহলে এই দেশে তো কোনো শিল্পের চর্চা হবে না।

বস্তুত, চলচ্চিত্রে পুলিশের উপস্থাপন নতুন কিছু নয়। বিভিন্ন অপরাধ সংশ্লিষ্ট ঘটনা নিয়ে নির্মিত সিনেমায় পুলিশের একাধিক চরিত্র থাকে। প্রেম-ভালোবাসার ছবিতেও থাকে। এটা সব দেশের, সব ভাষার চলচ্চিত্রেই থাকে। তাই বলে একজন এসআই ধর্ষণের ঘটনায় নারীকে নানাবিধ প্রশ্ন করায় পুলিশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে বা পর্নোগ্রাফি আইনে অপরাধ হয়েছে—এই অভিযোগে মামলা করা যায়? গ্রেপ্তার করা যায়?

প্রচুর সিনেমার সংলাপে গালাগাল আছে, বিশেষ করে নায়ক ও খলনায়কের মধ্যে যখন বাহাস হয়। সেই হিসেবে ওইসব সিনেমার বিরুদ্ধেও অশ্লীলতার অভিযোগ তুলে পর্নোগ্রাফি আইনে মামলা করা যায়। সিনেমার প্রচুর গানে নারীর শরীর যেভাবে প্রদর্শন করা হয়, তা কি অশ্লীল? যদি তা-ই হয়, তাহলে বাংলাদেশের অধিকাংশ সিনেমার বিরুদ্ধেই এই আইনে মামলা করা যায়। তারচেয়ে বড় কথা, স্বাভাবিক জীবনের অশ্লীলতা আর শিল্পের অশ্লীলতা এক নয়। শিল্পী অনায়াসে একজন নগ্ন নারীর ছবি আঁকতে পারেন, কিন্তু চাইলেই একজন মানুষ নগ্ন হয়ে রাস্তায় হাঁটতে পারেন না।

কিন্তু এইসব মামলা ও গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো আসলে যে বার্তা দিতে চায় তা হলো, তাদের নিয়ে কিছু বলা যাবে না, লেখা যাবে না। তারা আইনের প্রয়োগ করবেন, কিন্তু আইনের ঊর্ধ্বে থাকবেন। তারা জনমনে এমন ভীতিটা ছড়িয়ে দিতে চান, যাতে তাদের কোনো কর্মকাণ্ড নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলার, এমনকি রসিকতা করারও সাহস না পায়। যেমন আলোচিত ইউটিউবার হিরো আলম পুলিশের পোশাক পরে কেন গান গেয়েছেন, সে কারণেও তাকে জবাবদিহির মধ্যে পড়তে হয়েছে।

সবশেষ প্রশ্ন, সেন্সর বোর্ডের ছাড়পত্র নিয়েই 'হাওয়া' সিনেমা হলে প্রদর্শন করা হচ্ছে। যদিও আপত্তিকর হয়, তাহলে সেন্সর বোর্ড কী করে সিনেমাটির ছাড়পত্র দিয়েছে? তারা শালিক পাখি খাঁচায় পুরে রাখা কিংবা পুড়িয়ে খাওয়ার যে অভিযোগ আনা হয়েছে, সেই দৃশ্য দেখেনি?

আমীন আল রশীদ: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন

Comments

The Daily Star  | English
tax collection target for IMF loan

Talks with IMF: Consensus likely on exchange rate, revenue issues

The fourth tranche of the instalment was deferred due to disagreements and now talks are going on to release two tranches at once.

11h ago