দুর্নীতি দমন ও বিদেশে টাকা পাচার রোধে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ

অর্থপাচার

১৭৫৭ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাংলার দেওয়ানী গ্রহণের পূর্বে, ভারত সমগ্র বিশ্বের জিডিপির ২৭ শতাংশ যোগান দিত। তখন বাংলাদেশ (সুবা-ই-বাঙ্গাল) পৃথিবীর সর্বোচ্চ সম্পদশীল স্থানের একটি বিবেচিত হতো। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ এদেশ ছেড়ে যায়, তখন বাংলাদেশ পরিণত হয় পৃথিবীর দরিদ্রতম একটি স্থানে। দেশের সম্পদ লুট এবং তার একতরফা পাচারই ছিল এর মূল কারণ। এই প্রক্রিয়াটি এখনও চলমান। আমাদের নিজেদের লোকেরাই বর্তমানে প্রতিবছর প্রায় ৭ দশমিক ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিদেশে পাচার করে যার ৮৭ শতাংশ ঘটে আমদানি-রপ্তানির মাধ্যমে, যাকে বলা হয় 'ট্রেড বেইজড মানি লন্ডারিং (টিবিএমএল)'।

দুর্নীতি ও বিদেশে টাকা পাচার পরস্পর সম্পর্কিত। প্রক্রিয়াটি অনেকগুলো সংস্থার মাধ্যমে ঘটে থাকে। তাই তা দমনে প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট প্রত্যেকটি সংস্থা থেকে প্রাপ্ত তথ্যের বিশ্লেষণ ও পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ণয়। জি-৭ ভুক্ত অনেক দেশেই এখন সরাসরি অপরাধীদের চিহ্নিত না করে উৎস বহির্ভূত সম্পদের পরিমাণ শনাক্ত করে অপরাধীদের আইনের আওতায় নিয়ে আসে। বড় অংকের অর্থ বাসায় লুকিয়ে রাখা সম্ভব নয়, তাই একজন কালো টাকার মালিক তার অর্থ ব্যাংক ব্যালেন্স, শেয়ার, জমি, বাড়ি ইত্যাদিতে রূপান্তর করে অথবা বিদেশে পাচার করে দেয়। যদি দেশের প্রত্যেক ব্যক্তির সম্পদের পরিমাণ ও তার গতিবিধির ওপর নজর রাখা যায়, তাহলে দুর্নীতি ও বিদেশে সম্পদ পাচার রোধ সম্ভব। এখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন তথ্য প্রযুক্তিভিত্তিক একটি সিস্টেমের বর্ণনা দেয়া হলো যা এ কাজটি করতে সক্ষম। একে আমরা 'অ্যান্টি মানি লন্ডারিং (এএমএল) সিস্টেম' বলে অবহিত করতে পারি।

এই সিস্টেমটি তৈরির পূর্বশর্ত হলো সংশ্লিষ্ট প্রত্যেকটি সংস্থার তথ্য ডিজিটাল উপায়ে উন্মুক্ত করা। কোনো কোনো সংস্থা ইতোমধ্যেই তাদের তথ্য অনলাইনে উন্মুক্ত করে উদাহরণ স্বরূপ--ইলেকশন কমিশন (এন আই ডি), ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো এবং বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহ। অন্যান্য সংস্থা যেমন দুর্নীতি দমন কমিশন, আয়কর বিভাগ, গোয়েন্দা বিভাগ, কাস্টমস (আমদানি-রপ্তানি পণ্যের মূল্য তালিকা), ভূমি রেজিস্ট্রেশন, শেয়ার ক্রয়-বিক্রয় এজেন্টস, উন্নয়ন প্রকল্পের দায়িত্বে নিয়োজিত সংস্থা এবং মানি এক্সচেঞ্জ এজেন্টস প্রয়োজনীয় ডাটা ডিজিটাল পদ্ধতিতে উন্মুক্ত করার সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। এটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা নয়, আরও অনেক সংস্থা থাকতে পারে যাদের তথ্য এএমএল সিস্টেমের প্রয়োজন হবে।

সিস্টেমটির দুটি অংশ: (১) একটি ডাটাবেজ যা  বিভিন্ন সংস্থা থেকে আহরিত তথ্য সংরক্ষণ করবে। জনগণ কর্তৃক প্রেরিত তথ্য, অনলাইন পত্রিকা এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকেও সিস্টেমটি তথ্য সংগ্রহ করে ডেটাবেজে রাখবে। বিভিন্ন সংস্থার তথ্যের আন্তঃসম্পর্ক নির্ধারণের জন্য জাতীয় পরিচয় নম্বর (এনআইডি) অথবা ট্যাক্স আইডেনটিফিকেশন নম্বর (টিন) ব্যবহৃত হতে পারে। 

(২) একটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন (এ-আই) এপ্লিকেশন। এটি মেশিন লার্নিং, নিউরাল নেটওয়ার্ক, রুলস  বেইজড প্রসেসিং ও ন্যাচারাল ল্যাংগুয়েজ প্রসেসিংয়ের মতো প্রোগ্রামিং কৌশলের মাধ্যমে বিভিন্ন তথ্যের বুদ্ধিভিত্তিক বিশ্লেষণ ও আন্তঃসম্পর্ক নির্ধারণ করে সিদ্ধান্তে উপনীত হবে অনেকটা মানবিক মস্তিষ্ক অনুকরণে। প্রক্রিয়াটি হবে সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রীয়, কোনো মানুষের হস্তক্ষেপ ছাড়া। এটি অত্যন্ত জরুরি কারণ বড় বড় দুর্নীতির সঙ্গে সাধারনত বিভিন্ন সংস্থার কর্মচারী জড়িত থাকে।

এএমএল সিস্টেমটি সর্বক্ষণ বিভিন্ন সংস্থার তথ্য বিশ্লেষণ করে দেশের প্রাপ্ত বয়স্ক প্রত্যেক ব্যক্তির ও কোম্পানির সম্পদের পরিমাণ ও  চলাচল পর্যবেক্ষণ করে ট্যাক্স ফাঁকি, দুর্নীতি, টাকা পাচার ও জালিয়াতির মতো অপরাধ সমূহ চিহ্নিত করবে। ব্যাংক ও অন্যান্য সংস্থা কর্তৃক প্রেরিত কেস অনুসন্ধান করে তার ফলাফল সংশ্লিষ্টদের অবহিত করাও সিস্টেমটির আর একটি প্রধান কাজ। তাছাড়া জনগণ, সংবাদপত্র ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে প্রাপ্ত দুর্নীতি ও টাকা পাচারের সংবাদ ও সিস্টেমটি পরীক্ষা করে দেখবে। এখানে তার কাজের একটি নমুনা দেয়া হলো:

'রুটিন পর্যবেক্ষণের সময় সিস্টেমটি লক্ষ্য করে যে একটি ঋণপত্রে পণ্যের দাম অত্যধিক ধরা হয়েছে। ওভার ইনভয়েসিং সন্দেহ করে অ্যাপ্লিকেশনটি গ্রাহকের অর্থনৈতিক বিষয় খাতিয়ে দেখার সিদ্ধান্ত নেয়। বিভিন্ন সংস্থা থেকে প্রাপ্ত তথ্যের আলোকে যা পাওয়া গেল তা হলো-- গ্রাহক কয়েক বৎসর পূর্বে সরকারি একটি বড় প্রকল্পের কাজ পেয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে গ্রাহকের স্ত্রীর ব্যাংক ব্যালেন্স কয়েকশ গুণ বেড়ে যায়। একই সময় তার স্ত্রী ঢাকা শহরে ৫টি ফ্ল্যাট এবং বিরাট অংকের শেয়ার ক্রয় করেছেন। এ সংক্রান্ত কোনো তথ্যই ট্যাক্স রিটার্নে প্রদর্শিত হয়নি। সিস্টেম এটিকে একটি দুর্নীতি, ট্যাক্স ফাঁকি ও অবৈধ টাকা পাচারের কেস হিসেবে চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে পরামর্শ দেয়। তদন্তের জন্য সিস্টেমটি কাস্টমস, সরকারি প্রজেক্টে নিয়োজিত সকল সংস্থা, ভূমি রেজিস্ট্রেশন, ট্যাক্স ডিপার্টমেন্ট ও বিভিন্ন ব্যাংকের তথ্য পরীক্ষা করে দেখেছে।' সম্পূর্ণ তদন্তটি শেষ হতে কয়েক মিনিটের বেশি সময় লাগেনি।

এএমএল সিস্টেমটি একটি বৃহৎ অ্যাপ্লিকেশন যা নির্মাণের জন্য 'এজাইল মেথডলজি' ব্যবহার করা যেতে পারে। এই পদ্ধতিতে প্রথমে ক্ষুদ্র ও স্বল্প ফাংশনসহ একটি অ্যাপ্লিকেশন দ্রুতগতিতে ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। তার পর ধীরে ধীরে এর পরিসর বৃদ্ধি করা হয়। আলোচিত সিস্টেমটির প্রথম ভার্সনে বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরোর তথ্য দিয়ে শুরু করা যায়,  যার মাধ্যমে ব্যাংকগুলো গ্রাহকের উপযুক্ততা যাচাই, তাদের ক্রেডিট রেটিং ও খেলাপি ঋণ গ্রহীতাদের চিহ্নিত করতে পারবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের অবৈধ অর্থপাচার রোধ কল্পে একটি গাইডলাইন প্রকাশ করেছে যা আন্তর্জাতিক ফাইন্যান্সিয়াল টাস্কফোর্সের সুপারিশের আলোকে তৈরি করা হয়েছে। সিস্টেমের পরবর্তী ভার্সনে ওই গাইডলাইনের রুলসগুলো সংযুক্ত করা যেতে পারে যার মাধ্যমে ব্যাংক গ্রাহকের বৈদেশিক বাণিজ্যের তথ্য যাচই করে দেখবে। তারপর পর্যায়ক্রমে অন্যান্য সংস্থাগুলোর তথ্য ও রুলস সিস্টেমটির সঙ্গে সংযুক্ত হতে পারে, যতক্ষণ না কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন একটি পূর্ণাঙ্গ সিস্টেম আত্মপ্রকাশ করে। অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন কালো টাকার প্রধান উৎস হলো খেলাপি ঋণ, ট্যাক্স ফাঁকি ও উন্নয়ন প্রকল্পের দুর্নীতি থেকে লব্ধ অর্থ। এএমএল সিস্টেম অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ওই সব ক্ষেত্রগুলো সর্বপ্রথম পর্যবেক্ষণের আওতায় নিয়ে আসতে পারে।

সাইফুর রহমান: জ্যেষ্ঠ তথ্য প্রযুক্তিবিদ ও সার্টিফাইড প্রফেশনাল অস্ট্রেলিয়ান কম্পিউটার সোসাইটি

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

Over 102,000 annual deaths in Bangladesh linked to air pollution

Study also finds air pollution behind 266 million sick days every year hurting the economy

44m ago