মানুষের হৃদয়ে যেভাবে আছেন তারেক মাসুদ

আক্ষরিক অর্থে আটপৌরে বলতে যা বোঝায়, ঠিক যেন তার অবিকল প্রতিচ্ছবি তারেক মাসুদ। চলচ্চিত্র ছিল তার ধ্যানজ্ঞান। সংসারও পেতেছিলেন সেই চলচ্চিত্রের সঙ্গে। তারেক ও ক্যাথরিনের যৌথ জীবনের নিঃশ্বাসে-বিশ্বাসে, শয়নে-স্বপনে, সুখে এবং দুঃখে চলচ্চিত্রই ছিল বেঁচে থাকার অবলম্বন।

তারেকের চলচ্চিত্রযাপন শুরু হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায়। ক্যাথরিন যুক্ত হয়ে সেই যাপনকে করে তুলেছিলেন আরও বেশি মসৃণ, লক্ষ্যাভিসারী, সৌন্দর্য্যমণ্ডিত ও সার্থক। এমন সঙ্গ ও সঙ্গী পাওয়াকে সৌভাগ্যই বলতে হয় কী! তারেক এই সৌভাগ্যকে বৃথা হতে দেননি। ইহজাগতিকতার পরম এই প্রাপ্তিকে কাজে লাগিয়েছেন দাঁড়ি-কমা-সেমিকোলন পর্যন্ত; এমনকি বিন্দুর ব্যবহারেও ছিলেন সতর্ক ও নিবেদিত।

তারেকের নিবেদনের সবটাজুড়ে ছিল বাংলাদেশ। চলচ্চিত্রযাপনের অভীপ্সাও ছিল এই দেশকে- দেশের জনসংস্কৃতিকে-মুক্তিযুদ্ধকে-রাষ্ট্র সমাজের মানুষগুলোকে ইতিহাসের পরম্পরাকে যথার্থভাবে উপস্থাপন করা। বিশ্বমাঝে বাংলাকে তুলে ধরা। আমরা যদি তার কাজগুলোকে গভীরভাবে বোঝার চেষ্টা করি, তাহলে দেখব তিনি সেলুলয়েডের ফিতায় যে বাংলাদেশকে উপস্থাপন করেছেন- সেই বাংলাদেশ আমাদের গর্বের ধন। তারেক সাধারণ মানুষের চোখ দিয়ে গর্বের জায়গাগুলো ধরার চেষ্টা জারি রেখেছিলেন। এ দেশের ভেতরটাকে নিজে যেমন বুঝতে চেয়েছেন প্রতিটা ফ্রেমে ডিটেইলিংয়ের ভেতর দিয়ে, তেমনি অন্যকেও বোঝাতে চেয়েছেন পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে। এই বোঝাবুঝির জায়গায় কোনো প্রকার খাদ রাখেননি। খাদহীন অলঙ্কার গড়াই ছিল তার চ্যালেঞ্জ ও সর্বস্বজুড়ে চাওয়া। 

এ কারণে লোকেশন খোঁজার সময় ব্যয়ে তিনি যেমন ছিলেন অসীম ধৈর্য্যের অধিকারী। তেমনি চিত্রনাট্যের সঙ্গে বাস্তবের চরিত্রের খাপ খাওয়ানোর কোশেশে ছিলেন রবার্ট ব্রুশের মতো অধ্যবসায়ী। এসব গুণ ও অভ্যস্ততা আটপৌরে তারেককে করে তুলেছিল অসাধারণ। তার চলচ্চিত্রকে দিয়েছিল অভাবনীয় দর্শকপ্রিয়তা আর সার্থক চলচ্চিত্রের বহুল প্রত্যাশিত তকমা ও মর্যাদা। একারণে তারেকও একজীবনের চলচ্চিত্রযাপনে যতটা সফল তার চেয়েও অধিক সার্থক হয়েছিলেন এবং তারেকের প্রার্থিত চাওয়ায় ছিল একজন সার্থক শিল্পী হয়ে ওঠা। যেটা জারি রেখেছিলেন প্রতিটি কাজেই।

তারেকের অসাধারণ এক সৃষ্টি ছিল 'মাটির ময়না'। আন্তর্জাতিকভাবে গৌরবজনক সব পুরস্কারে সম্মানিত এই চলচ্চিত্র জয় করেছিল দেশের মানুষের হৃদয়। চলচ্চিত্রের গতানুগতিক ইতিহাসের বাইরে এটি ছিল মাইলফলক এক ছবি। যেখানে তারেক নিজের কথায় বলেছেন শিল্পের কুশলীপনায়। 'মাটির ময়না' ২০০২-এর মে মাসে যখন কান চলচ্চিত্র উৎসবে প্রশংসিত ও পুরস্কৃত হচ্ছে, বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ড তখন এই ছবির প্রদর্শনী নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। মহৎ শিল্পের এ বুঝি কঠিন বাস্তবতা। সেন্সর বোর্ডের কতিপয় সদস্য এই যুক্তি খাড়া করেন যে, এই ছবি প্রদর্শিত হলে সহিংসতা দেখা দিতে পারে, দেশজুড়ে বিক্ষোভ হওয়ার আশঙ্কা ছাড়াও ভয়ঙ্কর সব যুক্তি হাজির করে।

দ্য ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম এক লেখায় উল্লেখ করেছেন, তারেক মাসুদের অনুরোধে তখনকার তথ্যমন্ত্রী তরিকুল ইসলামকে দিয়ে তিনি কীভাবে অসাধ্যসাধন করেছিলেন এবং সেই যাত্রায় উনার সঙ্গে আরও কারা ছিলেন। মাহফুজ আনাম লিখেছেন, 'মাটির ময়না' ২০০২ এর জুলাইয়ে সেন্সর বোর্ডের ছাড়পত্র পায় এবং সারা দেশে দর্শকদের কাছে তুমুল সাড়া জাগায়। দর্শকদের এই স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতি জানান দেয় যে তারা সেন্সর বোর্ডের তথাকথিত অভিভাবকদের চেয়ে যথেষ্ট উদারমনা ও বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন।'

'মাটির ময়না' কোনো প্রকার অপ্রীতিকর ঘটনা ছাড়াই সারাদেশে প্রদর্শিত হয়। এই চলচ্চিত্রে আনু চরিত্রের মাধ্যমে মাদ্রাসাশিক্ষা ও তার পরিবেশ এবং সীমাবদ্ধতা নিয়ে যে অধ্যায় দেখানো হয়েছে, তা তারেকের জীবনেরই গল্প। অন্যান্য সব চরিত্রও বাস্তবানুগ। যেখানে ব্যক্তিমানসের নানান ধরনের সংকীর্ণতা, নিষ্ঠুরতা, অসহায়ত্ব এবং কর্তৃত্বপরায়ণ দিক হয়েছে প্রতীকায়ত। তারপরও এ দেশের সব শ্রেণির দর্শক একে গ্রহণ করেছেন। কারণ তারেক মাদ্রাসা শিক্ষার নির্দিষ্ট কিছু সীমাবদ্ধতার কথা বলেছেন, দীর্ঘদিন থেকে চলে আসা অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার কথা বলেছেন। মাদ্রাসার শিক্ষার বিরুদ্ধে বলেননি। মাদ্রাসার শিক্ষাকে দোষারোপ করেননি। মাদ্রাসা শিক্ষাকে উপেক্ষা কিংবা খারিজ করার কথাও বলেননি। বলেছেন সীমাবদ্ধতা ও সংকটের কথা। একইভাবে তারেক ধর্মের নামে কিংবা লেবাসে জারি থাকা কিছু অমানবিক, দৃষ্টিকটু, অসংস্কৃত আচার ও ব্যবহারের প্রকৃত পরিস্থিতি তুলে ধরেছেন এবং এটা তুলে ধরতে গিয়ে ধর্ম নামক বৃহৎ প্রতিষ্ঠানকে আঘাত কিংবা আহত করেননি। কারণ তিনি ইতিহাসের ছাত্র হিসেবে জানেন, প্রতিটি ধর্মই সভ্যতাকে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে পালন করেছে অনেক বড় ভূমিকা।

চলচ্চিত্রমাধ্যমে তারেকের প্রথম কাজ 'আদিম সুরত' প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ। আমরা জানি এবং তারেকের বয়ানেও এ কথা উচ্চারিত হয়েছে যে, নির্মাতা তারেকের বৌদ্ধিক অবস্থান তৈরি করে দিয়েছে এই চলচ্চিত্র নির্মাণের অভিজ্ঞতা এবং শিল্পী এস এম সুলতানের দীর্ঘকালীন সাহচর্য পাওয়ার অপার সুযোগ।

তারেক চলচ্চিত্র মাধ্যমে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের লক্ষ্যে ভারত সরকার প্রদত্ত 'পুনা ফিল্ম ইনস্টিটিউট'-এর মেধাবৃত্তি পেয়েছিলেন। পরিস্থিতিগত কারণে এবং সেই সময়ের উটকো বাধায় যাওয়া হয়ে ওঠেনি। নিজের চেষ্টায় আমেরিকা গিয়ে সেই স্বপ্ন পূরণের চেষ্টা করেন এবং সফলতাও পান। কিন্তু বিধিবাম! শেষ মুহূর্তে এসে যাওয়া হয় না এবারও। সিনেম্যাটোগ্রাফার আনোয়ার হোসেনের পরামর্শে সিদ্ধান্ত নেন আমেরিকা যাবেন না। ওই টাকা লগ্নি করবেন সুলতানকে নিয়ে নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণে। তারপর টানা সাত বছর কেটে যায় এ কাজে। নির্মিত হয় 'আদম সুরত'। যার ইংরেজি টাইটেল 'Inner Stregnth'.

সুলতানের এই 'ইনার স্ট্রেন্থ'কে আবিষ্কার করতে গিয়ে তারেক আগ্রহী হয়ে ওঠেন বাংলাদেশের 'ইনার স্ট্রেন্থ'-এর দিকে। এই আবিষ্কার ঘুরিয়ে দেয় তারেক মাসুদ-এর জীবনের মোড়। বায়সের কারণে তিনি মুক্তিযুদ্ধে যেতে পারেননি। মামা মুক্তিযোদ্ধা দেলোয়ার হোসেন যখন তাদের বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নিতেন যুদ্ধ দিনগুলোতে। তারেকের বায়না ছিল যুদ্ধে নেওয়ার- একটা রাইফেল সংগ্রহ করে দেওয়ার। সেই ইচ্ছে পূরণ হয়নি। কিন্তু সেই বাসনা বুঝি সুপ্ত ছিল, হারিয়ে যায়নি এক মুহূর্তের জন্য। স্বাধীন দেশে নতুন প্রজন্মের কাছে তারেক সত্যি সত্যিই হয়ে ওঠে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সঞ্চারী এক যোদ্ধা। চলচ্চিত্র যার একাত্তরের রাইফেল।

ইতিহাসের কী অমোঘ লিখন, তারেকের মাধ্যমে-ক্যাথরিনের সহযোগে আমরা পাই 'মুক্তির গান' ও 'মুক্তির কথা' প্রামাণ্যচিত্র। লেয়ার লেভিনের ফুটেজ সংগ্রহ করে তার সঙ্গে যুক্ত করেন বিভিন্ন দেশ ও জায়গা থেকে প্রাপ্ততালিকা। তৈরি করেন 'মুক্তির গান'। তারেকের এই প্রামাণ্যচিত্র আমাদের মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোকে পুনর্জন্ম দান করে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা-আবেগ, ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে নতুন প্রজন্ম যখন বেমালুম ভুলতে বসেছে, ঠিক তখনি তারেকের এই শ্রমের ধন, প্রেম ও নিষ্ঠার ফসল তরুণ প্রজন্ম আলোড়িত করে মুক্তিযুদ্ধের বিশুদ্ধ আবেগে।

'মুক্তির গান'-এর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নিয়েই নির্মিত হয় 'মুক্তির কথা'। দেশপ্রেম কতটা প্রগাঢ় হলে, শোণিতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কীভাবে প্রবহমান থাকলে এসবে নিজেকে উৎসর্গ করা যায় সকল বাধা-সীমাবদ্ধতা ও ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে তার উজ্জ্বলতম দৃষ্টান্ত তারেক মাসুদ।

চলচ্চিত্রযাপন ছিল যার ধ্যান জ্ঞান, তিনি মারাও গেলেন সেই কাজ থেকে ফেরার পথে। ভয়াবহ এক সড়ক দুর্ঘটনায় ২০১১ খ্রিষ্টাব্দের আজকের তারিখে তারেকের শিল্পসঙ্গী মিশুক মুনীরকেও হারালাম আমরা। উনাদের সঙ্গে আরও ৫ জন চলচ্চিত্রের বিভিন্ন মাধ্যমে যুক্ত কুশলীও দিতে হলো জীবন। যে দুর্ঘটনার কারণে তারেকের মতো গুণী মানুষকে অকালে হারাতে হলো, সেই সড়ক এখনো সেই বিভীষিকায়-হত্যাকারীরূপেই রয়ে গেছে। দুর্ঘটনা কমা তো দূরের কথা, বেড়েছে তার চেয়েও বেশি।  

মাত্র ৫৫ বছরের আয়ুষ্কাল পেয়েছিল তারেক। স্বল্পরেখার এক জীবন, অথচ ছুঁয়ে গেছেন অগণন মানুষকে। ছোট বড়ো সবাইকে নিয়েছিলেন আপন করে। অকৃত্রিম হাসিতে চারপাশকে করে রাখতেন আনন্দময়। অন্যের তরে অপরের কল্যাণে নিবেদনে ছিলেন কুণ্ঠাহীন-উদার হস্ত। সবার গতায়াত ছিল তার ডেরায়। সবাইকে বেঁধেছিল শ্রদ্ধা-স্নেহ ও প্রেমে। স্বপ্ন দেখতেন বড়ো, বিশালতায় ছিলেন সমর্পিত। এই বিশালতা দিয়েই ধারণ করতেন বাংলাদেশকে, এর মূল্যবোধকে। আর এসবের অংশ হিসেবেই একের পর এক নির্মাণ করেছেন মাইলফলক সব চলচ্চিত্র। 'অন্তর্যাত্রা', 'নরসুন্দর', 'রানওয়ে'- প্রতিটি চলচ্চিত্রেই তিনি জারি রেখেছিলেন তার অভীপ্সা। যা আহরিত হয়েছিল এস এম সুলতান থেকে, আহমদ ছফা থেকে। যাদের স্বপ্ন ছিল বাংলাদেশের 'ইনার স্ট্রেন্থ'কে ধরা, বোঝা ও আবিষ্কার করা।

তারেকের ড্রিম প্রোজেক্ট ছিল 'কাগজের ফুল'। সত্যজিতের মতো তিনিও সিক্যুয়েল নির্মাণের স্বপ্ন দেখতেন- যাত্রীও ছিলেন সেই পথের। 'মাটির ময়না' দিয়ে শুরু, 'কাগজের ফুল' প্রিক্যুয়ের আর 'মাটির ময়নার' আনুর চলচ্চিত্র পরিচালক হয়ে ওঠা দিয়ে নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন স্বপ্নের ছবিটি। এভাবেই পূর্ণতা দিতে চেয়েছিলেন সিক্যুয়েলকে। কিন্তু না, যে মানুষটির স্বপ্ন ছিল দেশ ও দশের কল্যাণ। সেই দেশের সড়ক ব্যবস্থা আর পরিবহণে বিদ্যমান অসংস্কৃতি তার স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তা দিতে পারেনি। তার বেদনাহত-মর্মন্তুদ মৃত্যুর মধ্য দিয়েও এ দেশের সড়ককে আমরা নিরাপদ করতে পারিনি।

মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে, গানের দেশ, প্রাণের দেশ বাংলাদেশকে ও তার ইনার স্ট্রেন্থকে জানতে বুঝতে হলে আমাদেরকে যেমন সুলতানের ছবির কাছে ফিরে যেতে হবে, ফিরে যেতে হবে আহমদ ছফার কথা ও প্রবন্ধ সাহিত্যের কাছে, তেমনি অনিবার্যভাবে ফিরে যেতে হবে তারেক মাসুদের কাছে।

 

Comments

The Daily Star  | English

$14b a year lost to capital flight during AL years

Bangladesh has lost around $14 billion a year on average to capital flight during the Awami League’s 15-year tenure, according to the draft report of the committee preparing a white paper on the economy.

12h ago