লন্ডন ভ্রমণে যেতে চান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সৈনিক আব্দুল মান্নান

আব্দুল মান্নান। ছবি: স্টার

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন তিনি। এখনো চলাফেরা ও কথাবার্তায় বেশ সাবলীল। একা একা চলাফেরাও করেন। মনে আছে যুদ্ধের সব স্মৃতি।

এই সৈনিকের নাম আব্দুল মান্নান। বাড়ি কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া উপজেলার চন্ডীপাশা ইউনিয়নের বড় আজলদী গ্রামে। জন্মসনদ অনুযায়ী তার বয়স এখন ১০৭ বছর।

সম্প্রতি দ্য ডেইলি স্টারের প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বৃদ্ধ আব্দুল মান্নানের সঙ্গে।

মান্নান জানান, তিনি কখনো বিদ্যালয়ে পা রাখেননি। তবে ইংরেজিতে কথা বলতে পারেন। সই করেন ইংরেজিতে। ব্রিটিশ আর্মির সঙ্গে কাজ করার সময় ইংরেজি শিখেছেন।

মাতৃভাষা বাংলা ছাড়াও তিনি ইংরেজি, হিন্দি ও উর্দু বলায় পারদর্শী।

ট্রাঙ্কে সযত্নে রেখে দিয়েছেন যুদ্ধকালীন স্মৃতি। যুদ্ধের সময়কার কিছু কাগজপত্র ও ব্রিটিশ রানির পক্ষ থেকে দেওয়া তার চিঠির জবাব। আছে সৈনিকের পোশাক। পোশাকে এখনো ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর দেওয়া মেডেল ঝুলছে।

তিনি জানান, বিশ্বযুদ্ধ শুরুর পর ১৯৪২ সালে সৈনিক সংগ্রহের জন্য কিশোরগঞ্জের বিভিন্ন বাজারে ঢোল পেটায় ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ। তার বাবা আব্দুর রহমান সেই ঘোষণা শুনে এসে তাকে মাঠে যেতে বলেন। বাবার কথা শুনে সৈনিক হিসেবে যোগ দিতে কিশোরগঞ্জের ডাকবাংলো মাঠে লাইনে দাঁড়ান যুবক মান্নান। তখন তার বয়স ছিল ২৭ বছর।

লাইন থেকে সৈনিক বাছাই করতে এক ব্রিটিশ অফিসার এসে সবার বুকে জোরে জোরে আঘাত করতে থাকেন। তখন অনেকে মাটিতে পড়ে গেলেও মান্নান দাঁড়িয়ে থাকেন। এরপর তাকে চূড়ান্ত করা হয়।

পরে প্রশিক্ষণের জন্য পাকিস্তান ও চীনের সীমান্ত এলাকা হাসানাবাদ বর্ডারে নেওয়া হয় চূড়ান্ত বাছাইকৃতদের।

মান্নান জানান, ১ মাসের প্রশিক্ষণ শেষে ওই ব্যাটালিয়নের ক্যাপ্টেন ড. গালিব তাকে ল্যান্স নায়েকের দায়িত্ব দেন। তার অধীনে ছিল ১১ জন সৈনিক।

তিনি জানান, প্রশিক্ষণে তাদের ৪টি কথা বলা হয়েছিল। কাউকে থাপ্পড় দেওয়া যাবে না, সম্পদ লুট করা যাবে না, নারীদের নির্যাতন করা যাবে না ও মিথ্যা বলা যাবে না।

মান্নান জানান, ৪ হাজার সৈনিককে সমুদ্রপথে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে হয়েছিল। সেই দলে ছিলেন তিনি।

বড় জাহাজে করে ৬ মাসের খাবার নিয়ে কলম্বোর দিকে রওনা দেন তারা। অস্ত্র, গোলা-বারুদসহ ৪টা কামান বিভিন্ন দিকে তাক করা ছিল জাহাজে। জাহাজে শুধু ভারতীয় উপমহাদেশের সৈনিকরা ছিল। জাহাজটি টানা ১ মাস রাত-দিন তাদের নিয়ে মহড়া দেয়।

১ মাস পর আবার কলম্বোয় ফিরে যান তারা। কলম্বোর কাছাকাছি জার্মানির একটি জাহাজকে তারা ডুবিয়ে দিয়েছিলেন। পরে সেখান থেকে আবার ভারতের হায়দ্রাবাদ নিয়ে যাওয়া হয় তাদের।

এ সময় ১৫ দিনের ছুটি পান মান্নান। ছুটি শেষে আবারও যোগ দেওয়ার পর করাচি থেকে মিয়ানমারের দিকে পাঠানো সৈনিক দলের সঙ্গে রওনা হন আব্দুল মান্নান।

হিমালয় পর্বতের দুর্গম পাহাড়ি এলাকা হয়ে মিয়ানমারে পৌঁছান তারা।

মিয়ানমার গিয়ে সংবাদ পান, জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে বোমা ফেলা হয়েছে। এরপর যুদ্ধ শেষ।

আব্দুল মান্নান বলেন, 'আমি হালকা থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল চালাতাম। কাঁধে অস্ত্র নিয়ে প্রতিদিন স্থলপথে বেশ কয়েক মাইলের মতো হাঁটতে হতো। হিরোশিমায় পরমাণু বোমা নিক্ষেপের পর ভারতীয় সৈনিকদের কাছে আমাদের রেখে ব্রিটিশ সৈনিকরা চলে যায়।'

'পরে ৫০০ টাকা দিয়ে ১৯৪৬ সালে আমাকে কলকাতা থেকে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়,' বলেন তিনি।

দ্বিতীয় যুদ্ধে অংশ নিয়ে তেমন কিছু পাননি মান্নান। এরশাদ সরকারের সময় ১৯৮৫ সালে ঢাকায় ব্রিটিশ হাইকমিশনের মাধ্যমে ব্রিটেনের রানির কাছে চিঠি পাঠিয়েছিলেন।

লিখেছিলেন, 'দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়ে গেলে আপনার ব্রিটিশ সেনাবাহিনী আমাদের ফেলে কমান্ড ছেড়ে চলে গেল। কিছু বলে যায়নি। আমার অধিকার আমি পাইনি। আমি যে আপনাদের হয়ে যুদ্ধে অংশ নিলাম, আমাকে তো প্রাপ্য সম্মানটুকু আপনারা দেননি। কোনো খোঁজখবরও রাখেননি।'

আব্দুল মান্নান। ছবি: স্টার

চিঠির একটি কপি দেওয়া হয় রাষ্ট্রপতি এরশাদের দপ্তরে।

ব্রিটেনের রানি চিঠির জবাবে জানান, বিষয়টি দেখার জন্য তাদের তরফ থেকে রাষ্ট্রপতি এরশাদকে বলা হয়েছে।

তিনি বলেন, 'ব্রিটিশ অ্যাম্বাসি থেকে আমাকে চিঠিতে বলা হয় আমার বিষয়টি ব্রিটিশ সোলজার বোর্ড থেকে অচিরেই সমাধান করা হবে।'

মান্নান বলেন, ওই সময় ময়মনসিংহে অবস্থিত সশস্ত্র বাহিনী বোর্ডে আমাকে ডেকে নিয়ে ভাতা হিসেবে ৩ হাজার ৫৩৮ টাকা ৭৭ পয়সা দেয়।

এরশাদ সরকারের পতনের পর তার ভাতা বন্ধ হয়ে যায়। তবে এখন তিনি নিয়মিত ভাতা পান।

এদিকে, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধেও নিজের অবদান আছে বলে দাবি করে মান্নান জানান, এলাকার লোকজনকে যুদ্ধের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ দিয়ে ভারতে পাঠান তিনি।

মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে অনেকে মুক্তিযোদ্ধা সনদ পেলেও তিনি কোনো সনদ পাননি বলে জানান।

আব্দুল মান্নান জানান, তার ইচ্ছা ব্রিটিশ সরকার যদি তাকে দেশ ভ্রমণের সুযোগ করে দেন, তাহলে তিনি লন্ডন যেতে চান। বাংলাদেশ সরকারের কাছে চাওয়া, আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তার জন্য কিছু করার থাকলে করা হোক।

মান্নান একাধিক বিয়ে করেছেন। এখনো বেঁচে আছেন এক স্ত্রী। তার সন্তানদের মধ্যে ৬ ছেলে, ৫ মেয়ে এখনো বেঁচে আছেন।

মান্নানের স্কুল শিক্ষক ছেলে রুবেল আহমেদ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমার বাবা ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে প্রায় ৫ হাজার টাকা ভাতা পেয়ে আসছেন এবং তা দিয়েই তিনি চলেন। ভাতার পরিমাণ অপ্রতুল। তবুও বাবার এই অবদানের জন্য আমরা গর্বিত।'

মান্নানের নাতি এনজিও কর্মকর্তা রুকন উদ্দিন রতন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কাহিনি আমরা বইয়ে পড়েছি। আমার দাদা এই যুদ্ধের সৈনিক ছিলেন, জেনে খুব ভালো লাগে। আমরা তার মুখ থেকে বিশ্বযুদ্ধের গল্প শুনি। আমরা তার জন্য গর্বিত।'

Comments

The Daily Star  | English

Nowfel gained from illegal tobacco trade

Former education minister Mohibul Hassan Chowdhoury Nowfel received at least Tk 3 crore from a tobacco company, known for years for illegal cigarette production and marketing including some counterfeit foreign brands.

3h ago