‘আউট অব দ্য বক্স’ সমাধান অর্থনীতিকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনবে: গভর্নর

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। ছবি: সংগৃহীত

মূল্যস্ফীতি যখন বাড়তে থাকে, তখন সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য সুদের হার পরিবর্তন খুবই উপযোগী একটি প্রক্রিয়া। তা সত্ত্বেও, গতকাল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নতুন গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার তার প্রথম সংবাদ সম্মেলনে দৃঢ়তার সঙ্গে জানান, এই প্রক্রিয়াটি ব্যবহার করা হবে না।

মতিঝিলে বাংলাদেশ ব্যাংকের কার্যালয়ে গতকাল অনুষ্ঠিত এই সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, 'মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে অনুসরণ করার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। আমরা আমাদের নিজেদের প্রক্রিয়া অবলম্বন করে মহামারির কারণে সৃষ্ট সংকটের মোকাবিলা করেছি এবং দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে সেরা ফল পেয়েছি।'

গত মাসে মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভ টানা দ্বিতীয়বারের মত মূল সুদহার (পলিসি রেট) শূন্য দশমিক ৭৫ শতাংশ পয়েন্ট বাড়িয়েছে। অর্থনীতিতে মন্দা সৃষ্টি না করে লাগামহীন মূল্যস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণে আনার জন্যই তারা এই উদ্যোগ নিয়েছে।

যুক্তরাজ্যের ব্যাংক অব ইংল্যান্ড পূর্বাভাষ দিয়েছে, খুব শিগগির মূল্যস্ফীতি ১৩ শতাংশে পৌঁছাবে। এর সঙ্গে মোকাবিলা করার জন্য ব্যাংকটি মূল সুদহার শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ বাড়িয়ে ১ দশমিক ৭৫ শতাংশ করেছে, যা গত ২৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ বৃদ্ধি।

একইভাবে ইউরোপের কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাড়তে থাকা মূল্যস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণে আনতে জুলাইতে ১১ বছরের মধ্যে প্রথম বারের মতো মূল সুদ হার বাড়িয়েছে। আগামীতে এ হার আরও বাড়ানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।

ভারতের রিজার্ভ ব্যাংকও আজ মূল সুদ হার বাড়াবে।

বাংলাদেশ ব্যাংক মূল সুদের হার ৩০ দিনের মধ্যে ২ বার বাড়িয়েছে। তবে এতে ভোক্তা পর্যায়ে তেমন কোনো প্রভাব পড়েনি।

২০২০ সালের এপ্রিল থেকে ঋণের ক্ষেত্রে সুদের হার ৯ শতাংশ নির্দিষ্ট করে দেওয়া আছে।

সাবেক জ্যেষ্ঠ অর্থসচিব আবদুর রউফ মনে করেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য সুদের হারের সর্বোচ্চ সীমা প্রত্যাহার করে নেওয়া একটি 'টেক্সটবুক সমাধান।' তিনি বলেন, 'চলতি অবস্থা মোকাবিলায় আমরা একটি "আউট অব দ্য বক্স সলিউশন" বের করেছি। কেননা, সুদ হারের উর্ধ্বসীমা প্রত্যাহার করলে তহবিল খরচ বেড়ে যাবে এবং সাধারণ মানুষ ঋণ নিতে নিরুৎসাহিত হবে। ফলে অর্থনীতি পিছিয়ে পড়বে।'

দেশের বিনিয়োগ কার্যক্রমের কার্যকারিতার মাপকাঠি হচ্ছে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি। তিনি আশংকা করছেন, এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হলে এটি কমে আসবে।

জুনে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল ১৩ দশমিক ৬৬ শতাংশ, যা গত ৪ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। চলমান অর্থবছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই হারকে ১৪ দশমিক ১ শতাংশে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যমাত্রা হাতে নিয়েছে।

গভর্নর রউফ স্বীকার করেন যে, ব্যাংকগুলো তারল্য সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।

২০২১-২২ অর্থবছরে বিনিময় হারকে স্থিতিশীল রাখার জন্য বাজার থেকে ৭৮ হাজার কোটি টাকা তুলে নিয়ে প্রায় ৭ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার বাজারে ছাড়া হয়েছিল। রউফ জানান, গত মাসেও ১ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি অর্থ বাজারে সরবরাহ করা হয়েছে।

তিনি বলেন, 'যদি এই টাকাটা বাজারে ফিরে যায়, তাহলে তারল্য সংকটের সমাধান হবে।'

তবে যে সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা আগের অর্থবছরের তুলনায় কমিয়ে এনেছে, সে সময় কীভাবে এই টাকা বাজারে ফিরে যাবে, সে বিষয়ে বিস্তারিত জানাননি নবনিযুক্ত গভর্নর।

এছাড়াও চলমান অর্থবছরে মূল্যস্ফীতির হার সরকারের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা ৫ দশমিক ৬ শতাংশের চেয়ে বেশ খানিকটা বেশি আছে। জুলাইতে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৭ দশমিক ৪৮ শতাংশ।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর বলেন, 'আমরা এখন মূল্যস্ফীতির সঙ্গে মোকাবিলা করার জন্য কাজ করছি। আমাদের মূল কাজ হচ্ছে বৈশ্বিক বাজার থেকে আসা উচ্চ মূল্যের চাপ কমিয়ে আনা। এটি একবার নিয়ন্ত্রণে চলে আসলে অর্থনীতির সংশ্লিষ্ট খাতগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভালো অবস্থানে চলে আসবে।'

সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক, উভয়ের নেওয়া বিভিন্ন উদ্যোগের ফলে ২ থেকে ৩ মাসের মধ্যেই অর্থনীতির পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে বলেও প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন তিনি। বলেন, 'অর্থনীতি এখন চাপের মুখে আছে এবং এই চাপের জন্য আমদানি পণ্যের কারণে সৃষ্ট মূল্যস্ফীতি দায়ী। এ ক্ষেত্রে আমাদের কিছুই করার নেই, কারণ আমাদেরকে পেট্রোলিয়াম, গ্যাস ও গম সহ নানাবিধ পণ্য আমদানি করতে হয়'।

বর্তমানে আমদানিকারকদের আমদানি বিল মেটাতে প্রতি ডলারের বিপরীতে ১১১ টাকা করে খরচ করতে হচ্ছে। অন্যদিকে ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে ৯৪ দশমিক ৭০ টাকায় ডলার কিনতে পারছে।

এই বড় ব্যবধানের বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, 'এ মুহূর্তে যে পরিমাণ ডলার আসছে, তার চেয়ে বেশি পরিমাণ বের হয়ে যাচ্ছে। আশা করা যায়, ২-৩ মাসের মধ্যে এই ব্যবধান আর থাকবে না। এতে আমাদের বিনিময়ের হারকে চাহিদা ও সরবরাহের ভিত্তিতে নির্ধারণ করা যাবে।'

তিনি জানান, বাংলাদেশ ব্যাংক আমদানি কমানোর জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে এবং এই সিদ্ধান্তের কারণে ইতোমধ্যে অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে।

জুলাই মাসে লেটার অব ক্রেডিট (এলসি) খোলা ও নিষ্পত্তি, উভয়ই উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমেছে।

জুলাই মাসে ৬ বিলিয়ন ডলারের এলসি খোলা হয়েছে। এর আগের মাসে সংখ্যাটি ছিল ৮ বিলিয়ন ডলার।

গতকালের সংবাদ সম্মেলনে গভর্নর রউফ বাংলাদেশের আর্থিক খাতের আরও একটি বড় আকারের সমস্যার কথা স্বীকার করেন, যেটি হচ্ছে ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের (এনবিএফআই) প্রতি ভোক্তাদের আস্থার অভাব।

বাংলাদেশ ব্যাংক দুর্বল আর্থিক পরিস্থিতিতে আছে এরকম ১০টি আর্থিক ব্যাংককে চিহ্নিত করেছে। এগুলোকে নিয়ে কাজ শেষ হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এনবিএফআই খাতকে চাঙ্গা করার জন্য কাজ শুরু করবে।

একই ব্যক্তি বা কয়েকজন ব্যক্তি একাধিক ব্যাংক বা এনবিএফআই'র মালিকানা অধিগ্রহণের বিষয়টি ঠেকানোর কোনো উদ্যোগ নেবেন কী না—এমন প্রশ্নের জবাবে গভর্নর রউফ বলেন, 'ব্যাংকের মালিক কারা, সেটা আমার দেখার বিষয় নয়। আমার দায়িত্ব হচ্ছে সব ব্যাংককে নীতিমালা মেনে চলতে বাধ্য করা।'

অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও বিনিময় মূল্যের ওঠানামাকে স্থিতিশীল রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক উদ্যোগগুলো নিয়ে একটি প্রতিবেদন পরিবেশন করেন।

অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

Comments

The Daily Star  | English

BNP sticks to demand for polls by December

In a meeting with Chief Adviser Prof Muhammad Yunus last night, the BNP restated its demands that the next general election be held by December and the government immediately announce a roadmap to that end.

3h ago