পাথররূপী ৩ কন্যা ও নীল পাহাড়ের কান্না
সারা পৃথিবী থেকে যে সমস্ত পর্যটক অস্ট্রেলিয়ায় আসেন, তাদের ভ্রমণ তালিকার শীর্ষে থাকে 'ব্লু মাউন্টেনস থ্রি সিস্টারস'।
আমাদের বাসা থেকে মাত্র ২৫ কিলোমিটার দূরে দাঁড়িয়ে থাকা এই ঐতিহাসিক পাহাড়ের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা ৩ বোনের করুণ উপাখ্যান পর্যটকদের মত আমাদেরও আচ্ছন্ন করে রাখে। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে হাজার বছর আগের এক রক্তাক্ত প্রেমকাহিনী, যা হৃদয় গভীরে বেদনার সুর তোলে।
এই নীল পাহাড়ের ৩টি পাথর কেবল ল্যান্ডস্কেপের বিস্ময় নয়, এর পেছনে আছে কাটুম্বা আদিবাসী গোত্রের মেহনী, উইমেলা এবয় গুনেন্দু নামের ৩ বোনের কান্নাভেজা গল্প।
৩ বোন বাস করত জ্যামিসন উপত্যকায়। প্রতিবেশী গোত্রের ৩ ভাই জয় করেছিল তাদের হৃদয়। কিন্তু প্রথা অনুসারে ভিন্ন গোত্রের ছেলে-মেয়েদের বিয়ে ছিল নিষিদ্ধ।
তাই ৩ ভাই মেহনী, উইমেলা ও গুনেন্দুকে জোর করে ধরে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এতে ২ গোত্রের মধ্যে শুরু হয় এক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ।
মেহনীদের গোত্রে ছিলেন এক যাদুকর। তিনি ৩ সুন্দরী নাবালিকা বোনের নিরাপত্তার জন্য তাদের জ্যামিসন উপত্যকার উপরে নিয়ে তার অলৌকিক যাদুবিদ্যা দিয়ে পাথরে পরিনত করে রাখেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে সেই যুদ্ধে নিহত হন ওই যাদুকর। তার পক্ষে ৩ বোনকে আর মানুষ রূপে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয় না। সেই থেকে তারা পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে পাহাড়ের উপরে।
অস্ট্রেলিয়া দেশটি হাজার হাজার পাহাড় দিয়ে ঘেরা। কিন্তু ঐতিহাসিক 'থ্রি সিস্টারস'-এর চারপাশের পাহাড়গুলোই কেবল নীল। অস্ট্রেলিয়ার আর কোথাও নীল পাহাড় নেই। বেশিরভাগ অস্ট্রেলিয়ানদের বিশ্বাস, ৩ বোনের বেদনা ধারণ করে নীল হয়েছে ওই পাহাড়গুলো।ৎ
প্রতি বছর ৩ মিলিয়ন মানুষ দেখতে যান 'ব্লু মাউন্টেনস থ্রি সিস্টারস'। এই দর্শনীয় জায়গা থেকে প্রতি বছর অস্ট্রেলিয়ান সরকারের আয় হয় ৩২৬ মিলিয়ন ডলার।
এখানকার সবুজ রেইনফরেস্ট থেকে উঠে আসে রূপালী কুয়াশা। পাহাড়ের নীল চূড়াগুলো যেন হাত বাড়িয়ে কাছে ডাকে। নিচের উপত্যকায় ইউক্যালিপটাস গাছের কোল ঘেঁষে প্রবাহিত জলপ্রপাত, যেন তা ৩ বোনের চোখের পানি।
কেবল অস্ট্রেলিয়াতেই নয়, পৃথিবীর সেরা দর্শনীয় স্থানগুলোর একটি হচ্ছে এই 'ব্লু মাউন্টেনস থ্রি সিস্টারস'। পর্যটকরা কাটুম্বার ইকো পয়েন্টে এমন অস্বাভাবিক গঠনের পাথর দেখে বিস্ময়ে অভিভূত হন।
'ব্লু মাউন্টেনস থ্রি সিস্টারস' নিয়ে আরেকটি গল্প প্রচলিত আছে কাটুম্বার আদিবাসীদের মধ্যে। এই গল্পের ভাষ্য অনুসারে, তায়াওয়ান নামের একজন জাদুকর ছিলেন ওই অঞ্চলে। জঙ্গল আর সমুদ্র থেকে তিনি খাবার সংগ্রহ করতেন। তার ছিল ৩ মেয়ে। জাদুকর যখন খাবার সংগ্রহ করতে যেতেন তখন তিনি তার ৩ কন্যাকে পাথরের দেয়ালের পেছনে একটি পাহাড়ের উপরে রেখে যেতেন। কারণ এখানে বাস করত বুনিপ নামের একটি ভয়ঙ্কর প্রাণী।
একদিন তায়াওয়ান যখন খাবার সংগ্রহের জন্য যাচ্ছিলেন, তখন একটি বড় আকারের বিষাক্ত বিছে তিন কন্যার কাছাকাছি আসে। এতে মেহনি ভয় পেয়ে এর দিকে পাথর ছুঁড়ে মারে। পাথরটি উপত্যকায় ধাক্কা খেয়ে পড়ে একটি বুনিপের গায়ে। এতে বুনিপটি ভীষণ ক্ষেপে যায়। দূর থেকে তা দেখতে পান তায়াওয়ান। তিনি বুঝতে পারেন যে, বুনিপটি তার মেয়েদের হত্যা করবে। তখন মেয়েদের রক্ষায় তিনি তার জাদুর কাঠি দিয়ে দ্রুত ৩ কন্যাকে পাথর বানিয়ে ফেলেন। এরপর বুনিপ তাকে তাড়া করতে শুরু করলে তিনি নিজেকে একটি পাখিতে বদলে ফেলেন। কিন্তু জঙ্গলে হারিয়ে ফেলেন তার জাদুর কাঠিটি। এতে করে তায়াওয়ান যেমন আর মানুষরূপে ফিরতে পারেননি, তেমনি তার কন্যারাও পাথর হয়েই থেকে যায়।
এখানকার আদিবাসীরা এখনো বিশ্বাস করেন যে, সেই পাখিরূপী অসহায় বাবা আজও কেঁদে কেঁদে পাথররূপী ৩ কন্যার চারপাশে উড়ে বেড়ান।
আকিদুল ইসলাম: অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী লেখক, সাংবাদিক
Comments