পেশা ছাড়ছেন রংপুরের মনসামঙ্গল শিল্পীরা

মনসামঙ্গল
লালমনিরহাট সদর উপজেলার উত্তর সাপ্টানা রায়পাড়া গ্রামে মনসামঙ্গল গীতের আসর। ছবি: এস দিলীপ রায়/স্টার

মাত্র এক যুগ আগেও রংপুর অঞ্চলে মনসামঙ্গল গীতের রমরমা অবস্থা ছিল। এই গীতের শিল্পীদের ছিল সন্তোষজনক কদর। সারা বছরই ছিল তাদের ডাক। এখন কদাচিৎ আয়োজন হয় মনসামঙ্গলের আসর।

প্রায় বিলুপ্তির পথে ঐতিহ্যবাহী এ শিল্প। মনসামঙ্গল গীত শিল্পের সঙ্গে জড়িত অধিকাংশ শিল্পীই পেশা ছেড়ে দিয়েছেন। যারা এখনো এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত তাদেরকে করতে হচ্ছে মানবেতর জীবনযাপন।

মনসামঙ্গল শিল্পীরা দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, সাপের দেবী মনসাকে খুশি রাখতে মনসামঙ্গল গীতের আয়োজন করা হয়ে থাকে। অনেকে মনসা দেবীর কাছে মানত করে মনের ইচ্ছা পূরণ করায় মনসামঙ্গল গীত আয়োজন করেন।

প্রতিটি মনসামঙ্গল গীতের আসরে ১২ থেকে ১৫ শিল্পী অংশ নেন। তাদের মধ্যে থাকে মূল গিদাল (গায়ক), ৬ থেকে ৭ জন থাকেন সহশিল্পী, একজন কৌতুক অভিনেতা ও অন্যরা থাকেন বাদ্যযন্ত্র শিল্পী হিসেবে।

মনসামঙ্গল
ছবি: এস দিলীপ রায়/স্টার

মনসামঙ্গল গীতের আসরে মনসা দেবীকে আরাধনা ছাড়াও এ আসরে থাকে কৌতুক, বিয়ের গীত, ভাওয়াইয়া ও খনার বচন। গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী মনসামঙ্গল গীতে পুরুষেরা নারী সেজে নেচে-গেয়ে বিনোদন দিয়ে থাকেন। নারী-পুরুষ সবাই বিমোহিত হয়ে রাত জেগে মনসামঙ্গল গীত উপভোগ করেন।

লালমনিরহাট সদর উপজেলার উত্তর সাপ্টনা রায়পাড়া গ্রামে ৪ দিনব্যাপী আয়োজন করা হয়েছিল মনসামঙ্গল গীতের আসর। গত শনিবার রাতে শেষ হয় এ আসর। সেখানে ১৩ শিল্পী অংশ নিয়েছিলেন। মূল গিদাল (গায়ক) ছিলেন লালমনিরহাট সদর উপজেলার বড়বাড়ী গ্রামের পল্লব চন্দ্র রায় (৪৪)।

সেই আসরের অন্য শিল্পীরা লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা ও রংপুরের বিভিন্ন এলাকা থেকে এসেছিলেন। ৪ দিনের আসরের জন্য শিল্পীদের ২০ হাজার টাকা পারিশ্রমিক দেওয়া হয়। রায়পাড়া গ্রামের নগেন চন্দ্র রায় (৬০) এ আসরের আয়োজন করেন।

নগেন চন্দ্র রায় ডেইলি স্টারকে বলেন, 'মনসা দেবীর কাছে মানত থাকায় মনসামঙ্গল গীতের আয়োজন করেছি। প্রায় ১০ বছর এ আসরের আয়োজন করছি।'

'আমাদের সংস্কৃতি অনেক বদলে গেছে' উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, 'নেহাত প্রয়োজন ছাড়া মনসামঙ্গল গীত আয়োজন করা হয় না।'

মনসামঙ্গল
ছবি: এস দিলীপ রায়/স্টার

মনসামঙ্গল গীতের প্রধান গিদাল (গায়ক) পল্লব চন্দ্র রায় ডেইলি স্টারকে বলেন, 'পরিশ্রম অনুযায়ী পারিশ্রমিক পাই না। যেহেতু এ শিল্পের সঙ্গে আমাদের আত্মার সম্পর্ক, তাই কম পারিশ্রমিকে মনসামঙ্গল গীত পরিবেশন করি।'

তিনি আরও বলেন, 'কয়েক বছর আগেও প্রায় সারা বছরই আমাদের ডাক আসতো। এখন বছরে ৭০ থেকে ৮০ দিন এ গীতের আসর করতে পারি।'

তিনি জানান, অধিকাংশ শিল্পী এ পেশা ছেড়ে দিয়েছেন। বলেন, 'আমরাও এ পেশা ছেড়ে দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি।'

রংপুর থেকে আসা মনসামঙ্গল শিল্পী সুধান চন্দ্র রায় (৩৫) ডেইলি স্টারকে বলেন, 'প্রায় ১২ বছর বয়স থেকে মনসামঙ্গল গীতের সঙ্গে যুক্ত। নারী সেজে নেচে-গেয়ে দর্শকদের আনন্দ দিই। প্রতিদিন ৪০০ টাকা থেকে ৫০০ টাকা মজুরি পাই। এ টাকায় সংসার চলে না। বছরের বেশিভাগ সময়ই কাজ থাকে না।'

'মনসামঙ্গল গীতের সঙ্গে এতই নিবিড়ভাবে জড়িত যে তা ছাড়তে পারছি না,' মন্তব্য করেন তিনি।

গাইবান্ধা থেকে আসা শিল্পী রামচরণ রায় (৩৩) ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এটা ভাবতে খুব কষ্ট হয়, মনসামঙ্গল গীত হারিয়ে যাচ্ছে। পরিচিত অনেক শিল্পী এ পেশা ছেড়ে দিনমজুরি করছেন। আমাদের পেশাকে টিকিয়ে রাখতে কেউ পৃষ্ঠপোষকতা করছেন না।'

তার আশঙ্কা, 'আগামী কয়েকবছর পর মনসামঙ্গল গীতের কোনো শিল্পী খুঁজে পাওয়া যাবে না।'

লোকগীতি গবেষক অধীন চন্দ্র বৈরাগী (৭৫) ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কোথাও মনসামঙ্গল গীত হচ্ছে জানলে ছুটে যাই। অনেক মানুষ এখনো রাত জেগে মনসামঙ্গল গীত উপভোগ করেন। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা না থাকলে গ্রামবাংলার এই ঐতিহ্যবাহী গীত বাঁচিয়ে রাখা কঠিন হবে।'

'মনসামঙ্গল গীতের শিল্পীরা মানবেতর জীবনযাপন করছেন,' উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, 'সরকারের উচিত তাদেরকে আর্থিক সহায়তা দেওয়া।'

Comments

The Daily Star  | English

Disrupting office work: Govt employees can be punished within 8 days

The interim government has moved to amend the Government Service Act-2018 to allow swift disciplinary action against its employees who will be found guilty of disrupting official activities.

7h ago