‘সাদা সাদা কালা কালা’ গানের হাশিম মাহমুদকে সুস্থ দেখতে চান মা

মা জামিলা আক্তার ও ছোট বোন দিলারা মাসুম ময়নার (বামে) সঙ্গে হাশিম মাহমুদ। ছবি: স্টার

মুক্তির অপেক্ষায় থাকা 'হাওয়া' চলচ্চিত্রের 'সাদা সাদা কালা কালা' গানটি দেশজুড়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। খ্যাতি পেয়েছেন গানটির গীতিকার ও সুরকার হাশিম মাহমুদ। তবে পরিবারের সদস্যরা বলছেন, হাশিম মানসিক রোগে ভুগছে। তাকে স্বাভাবিক জীবনে দেখতে চান মা জামিলা আক্তার।

নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার তল্লা সবুজবাগ এলাকার বাড়িতে দ্য ডেইলি স্টারকে এই কথা বলেন জামিলা আক্তার।

তিনি বলেন, 'ছেলে ছোটবেলা থেকেই সব সময় গান-বাজনা নিয়ে থাকত। এখানে সেখানে বসেই গান গাইতে ভালোবাসত। অনেক বলেছি গান-বাজনা নিয়ে থাকলে কি দিন যাবে? চাকরি বা কোনো কাজ কর। আমাকে বলে, আমি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো হব। একদিন আমার অনেক টাকা থাকবে। সারা বিশ্ব আমাকে চিনবে।'

'ওর লেখা গান প্রচারিত হয়েছে। ওকে সবাই চেনে। অনেক খুশি লাগছে, অনেক ভালো লাগছে। কিন্তু, ছেলেটাই এখন অসুস্থ। আমি চাই, শেষ বয়সে হাশিম যেন সুস্থ হয়ে চলাফেরা করতে পারে।'

মা জামিলা আক্তার ও হাশিম মাহমুদ। ছবি: স্টার

জামিলা আক্তার আরও বলেন, 'আমার ছেলে মনভোলা। একটা কথা জিজ্ঞাসা করলে আরেকটা বলে। খাবার সময় খাবার চাইবে। আর সারাদিন শুধু কবিতা, গল্প, গান লিখবে। কাজই ওর এটা। আমি চাই ছেলেটা সুস্থ হোক। ভালোভাবে চলাফেরা করুক। ভালো চিকিৎসা হোক। আগের মতো যেন স্বাভাবিক হয়ে যায়।'

হাশিম মাহমুদের লেখা 'সাদা সাদা কালা কালা' গানটি 'হাওয়া'য় ব্যবহার করেছেন পরিচালক মেজবাউর রহমান সুমন। হাশিম মাহমুদের কথা ও সুরে গানটি গেয়েছেন এরফান মৃধা।

খমক ছাড়া গানটিতে আর কোনো বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করা হয়নি। নৌকার সব কাঠ, বাঁশ, হাঁড়ি, পাতিল বাজিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গানটির সংগীতায়োজন করেছেন ইমন চৌধুরী। এগুলো বাজিয়েছেন মিঠুন।

হাশিম মাহমুদ নোয়াখালীর মৃত মো. আবুল হাশেম ও জামিলা আক্তারের ছেলে। ৯ সন্তানের মধ্যে হাশিম পঞ্চম। উত্তরা ব্যাংকে চাকরি সুবাদে বাবা আবুল হাশেম ১৯৭৩ সালে নারায়ণগঞ্জে আসেন। সেই থেকে নারায়ণগঞ্জ শহরেই বসবাস। পড়ালেখা শুরু হয় শহরের লক্ষ্মী নারায়ণ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।

১৯৮৫ সালে নারায়ণগঞ্জ হাইস্কুল থেকে এসএসসি, পরে সরকারি তোলারাম কলেজ থেকে এইচএসসি ও ডিগ্রি পাস করেন হাশিম। গত ৮ বছর ধরে মা ও ছোট ভাইয়ের সঙ্গে তল্লা সবুজবাগের নিজেদের বাড়িতে থাকছেন।

সরেজমিনে দেখা যায়, একতলা বাড়ির ২ ফ্ল্যাটের মাঝখানে সিঁড়ির পাশের ঘরে থাকেন হাশিম মাহমুদ। আসবাব বলতে বিছানা ও সোফা। টেবিলের ওপর ব্যাগ ভর্তি জামা কাপড়। সোফায় খাতা, লেখার কাগজ, ডায়েরি জমিয়ে রাখা। বিছানায় বালিশের নিচে একাধিক কলম।

সাদা-কালো স্ট্রাইপের টিশার্ট, সবুজ প্যান্ট পরনের পাকা লম্বা চুল আর সাদা দাঁড়িতে হাশিম মাহমুদকে দেখে বোঝার উপায় নেই যে তিনি অসুস্থ। টিভির রিমোট দিয়ে একের পর এক চ্যানেল পাল্টে যাচ্ছেন তিনি।

ছোট বোন দিলারা মাসুম ময়না ও হাশিম মাহমুদ। ছবি: স্টার

কেমন আছেন? উত্তরে হাশিম মাহমুদ বলেন, 'ভালো আছি।' এর পর একাধিক প্রশ্ন করলেও আর উত্তর দেননি। তার ছোট বোন দিলারা মাসুম ময়না 'সাদা সাদা কালা কালা' গানটি শুনতে চাইলে হাশিম কয়েকটি চরণ গেয়ে শোনান।

ময়না ডেইলি স্টারকে বলেন, 'গানটা ভাইরাল হওয়ার পর থেকে বিভিন্ন গণমাধ্যমের কর্মীরা, সাংস্কৃতিক কর্মী, বন্ধুবান্ধব ও স্থানীয় অনেক মানুষ বাসায় আসছেন। সে এতো মানুষের চাপ নিতে পারছে না। সে কারো সঙ্গে কথা বলতে চায় না।'

হাশিম সম্পর্কে ময়না বলেন, 'ভাই সারাদিন ঘরে থাকে। আমরা আসলে ছাদে নিয়ে যাই। নিজেকে ঘরবন্দী করে রেখেছে। নিজে বাইরে যায় না। আমরা কোথাও নিয়ে গেলে যায়। আগে এমন ছিল না। পড়ালেখার পাশাপাশি শাপলা, উদীচীসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনে যাতায়াত ছিল। সে খুব ভালো ছড়া লিখত। তখন "নবারুণ" পত্রিকায় ছড়া ছাপা হতো। ছড়ার পাশাপাশি সে কার্টুন আঁকত।'

তিনি আরও বলেন, '১৯৯০ সালের পর হাশিমের ঢাকায় যাতায়াত শুরু হয়। তখন সে চারুকলা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেত। মেজো ভাই তাকে ছায়ানটে ভর্তি করে দেয়। সেখানে সে প্রায় ৩ বছর পড়ালেখা করে। কিন্তু, শেষ করেনি। সে কোনো জায়গায় স্থায়ী হতে পারেনি। সে ছোটবেলা থেকেই এমন।'

'হাশিম ভালো ছাত্র ছিল। বাবা ব্যাংকার হওয়ায় ব্যাংকের চাকরিতে আকর্ষণ ছিল। একটি বেসরকারি ব্যাংকে চাকরিও হয়। মাত্র ১৭ দিন চাকরি করে। সে বলে, আমার পক্ষে এই চাকরি করা সম্ভব না। আমার পক্ষে কাউকে স্যার বলা সম্ভব না। বিয়ে করতে বললেও আগ্রহ দেখায়নি। এখন মনে হয়, আমরা অবহেলা করেছি। তারও একটা সুন্দর সংসার হতো।'

হাশিমের অসুস্থতা শুরুর বিষয়ে তিনি বলেন, '২০০৪-০৫ সাল থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিতে শুরু করে। গত ৫-৭ বছর ধরে ঢাকা যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। তখন থেকেই নিজেকে আড়াল করতে শুরু করে। তখনই মূলত এলোমেলো ভাবটা বেড়ে যায়।'

হাশিম মাহমুদ। ছবি: স্টার

'২০১৭-১৮ সালে এটা কয়েকগুণ বেড়ে যায়। আমরা সাধারণ কথা বললেও সে খুব রেগে যেত। টিভি দেখলে বা গান শুনলে চিৎকার করত। সে বলত, এগুলো আমার। আমরা ভাবতাম যে হতাশা থেকে এসব কিছু করছে।'

তিনি আরও বলেন, 'এখন দেখি আমার ভাই ভীষণ প্রতিভাবান। ওর জন্য আমাদের কোথাও কোন অপূর্ণতা ছিল। ও বলে যে, আমার অনেক কিছু অনেকে নিয়ে গেছে। তা মনে করতে পারি না। যখন এগুলো হয়েছে তখন সে আরও বেশি একা হয়ে গেছে। আমাদের সঙ্গেও শেয়ার করতে পারত না। ততদিনে আমরা শ্বশুর বাড়ি চলে গেছি। সে নিজের মতো করে আলাদা হয়ে বসবাস করছে। মা তখন ওকে নিয়ে থাকত। হাত খরচের টাকাও সে প্রয়োজন মতো পেত না। তখন থেকেই সে অসুস্থ।'

দিলারা মাসুম ময়না বলেন, 'হাশিম ছোটবেলা থেকেই আত্মভোলা। এখন এটা একটু বেশি হয়েছে। তবে ও সব কিছুই মনে করতে পারে। সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলছে। সে নিজের গান কিন্তু ভুলে না। সারাক্ষণই কোনো না কোনো চরিত্র নিয়ে কথা বলে। তার কথা অসংলগ্ন।'

'হাশিম নিজেকে গুটিয়ে ফেলেছে। গত ৫-৭ বছর ধরে পরিবারের কারো সঙ্গে খুব একটা কথা বলে না। আমরা আসলেও কথা বলতে চাইত না। আমাদের কাছে মনে হয় ওর মনের মধ্যে না পাওয়ার কষ্ট জমে আছে। গান জনপ্রিয় হওয়ার পর আমরা বলেছি যে তুমি কি চারুকলায় যাবে? সে যেতে চায় না।'

ময়না মনে করেন, 'তাকে আমাদের মূল্যায়ন করার দরকার ছিল। সেটা হয়নি।' বলেন, 'এখন ওর কথায় বুঝতে পারি আমার ভাই খুব বেশি অবহেলিত ছিল। এতদিন পর হলেও আল্লাহ তাকে আজকের জায়গায় নিয়ে এসেছে। "হাওয়া" সিনেমার পরিচালক সুমন ভাই তার গানটি প্রচার করেছে।'

'সাদা সাদা কালা কালা' গানটির সৃষ্টির ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'যখন ঢাকায় যাতায়াত করত তখন "বৈরাগী" নামে এক ব্যান্ড দলে ছিল। তারা ৪-৫ জনের একটি গ্রুপ দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াত। লালনের আখড়ায় খুব বেশি যাতায়াত ছিল হাশিমের। তার বন্ধুরা বলত, লালনের আখড়ায় এক মেয়ের প্রেমে পড়ে হাশিম। মেয়েটা লালনকে নিয়ে গবেষণা করত। মেয়েটার চোখগুলো সাদা ছিল আর শরীরের রঙ ছিল কালো। হাশিম তাকে মনের কথা বলতে পারেনি। ওখান থেকেই নাকি গানটা লেখা। ২০১০ সালে এই গানটি প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ের বারান্দায় বসে গায়। তখনই মূলত গানটির সৃষ্টি।'

'ওর প্রায় ৯০টার মতো গান লেখা আছে। কাউকে দেখে গান লিখে তাৎক্ষণিক সেটা সুর করে,' যোগ করেন তিনি।

'হাওয়া' ছবিতে গান ব্যবহারের জন্য চুক্তি হয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, '২ বছর আগে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন ছবির পরিচালক সুমন। আমরা খুব অবাক হই যে ভাইয়ের গানের জন্য অনুমতি চায়। তখন আমরা তাদের গানটা ব্যবহারের জন্য অনুমতি দেই। তিনি আমার ভাইকে দিয়ে গাওয়ানোর চেষ্টাও করেছিলেন। আমরা কোনো আপত্তি করিনি, বরং খুশি হয়েছি। তাদের সঙ্গে আমাদের খুব ভালো সম্পর্ক। গানটার জন্য আমার ভাইকে সম্মানী দেওয়া হবে বলেও কথা হয়েছে।'

হাশিম মাহমুদের চিকিৎসার ব্যাপারে তিনি বলেন, 'তাকে ডাক্তার দেখিয়েছি। ডাক্তার বলেছেন কোনো রোগ নেই। তাকে সময় দিতে। অনেক বেশি হতাশা থেকে এমন হয়েছে।'

'সে যে অসুস্থ এটা বাস্তব। তার চিকিৎসা দরকার। যদি কেউ স্বেচ্ছায় বা ভালোবাসা থেকে ওর জন্য এগিয়ে আসে আমরা তা মেনে নেবো। আমরা তাকে সহযোগিতা করব। এটাই তাকে নিয়ে আমাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা। আমরা চাই সে যেন সুস্থ হয়ে উঠে।'

Comments

The Daily Star  | English

Grim discovery: Five bodies found on vessel in Meghna

The incident had occurred on the Meghna river under Chandpur Sadar upazila in an area adjacent to Shariatpur

1h ago