গ্যাস সংকটে ‘অনির্দিষ্টকালের’ বিদ্যুৎ-বিভ্রাট

স্টার ফাইল ছবি

প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহের ঘাটতির কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গত কয়েকদিন ধরে লোডশেডিং চলছে।

বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ডের (বিপিডিবি) তথ্য অনুযায়ী, দেশের ৫২ শতাংশ বিদ্যুৎকেন্দ্র গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল। আর জ্বালানি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, দেশে মোট গ্যাসের ব্যবহারের ৭০ ভাগই বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজে ব্যবহৃত হয়।

রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান পেট্রোবাংলা জানিয়েছে, আন্তর্জাতিক স্পট মার্কেটে এলএনজির (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) দাম বাড়ায় সরকার সেখান থেকে আমদানি বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ফলে কয়েকদিন ধরে জাতীয় গ্যাস-সাপ্লাই গ্রিডে এলএনজির সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে।

এতে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমেছে, দিনে একাধিকবার বিদ্যুৎ চলে যাচ্ছে। ২০১২ সালের আগে 'লোডশেডিং' শব্দটি খুব পরিচিত ছিল। এরপর তা ধীরে ধীরে কমিয়ে আনা হয়।

২০১৮ সাল থেকে সরকার যেখানে লোডশেডিং শব্দের ব্যবহারই বন্ধ করে দেয়, সেখানে গতকাল ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ডিপিডিসি) এক বিজ্ঞপ্তিতে লোডশেডিংয়ের জন্য দুঃখ প্রকাশ করা হয়।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গ্যাসের স্বল্পতার কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় চাহিদার তুলনায় ডিপিডিসিকে কম বিদ্যুৎ বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। ফলে ডিপিডিসির কিছু কিছু এলাকায় 'অনিচ্ছাকৃত' লোডশেডিং হচ্ছে।

ডিপিডিসির নির্বাহী পরিচালক বিকাশ দেওয়ান বলেন, 'আমরা জরুরি সেবা প্রতিষ্ঠানসহ গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন রাখার চেষ্টা করছি।'

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ গত রোববার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বলেছেন, গ্যাস সরবরাহে ঘাটতির কারণে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।

তিনি বলেন, 'ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে চলমান যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশও বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো জ্বালানি সংকটের সম্মুখীন হচ্ছে।'

তবে, এই পরিস্থিতি কতদিন চলবে, তা উল্লেখ করেননি তিনি।

'গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক হলে বিদ্যুৎ উৎপাদন আগের অবস্থায় ফিরে আসবে', বলেন তিনি।

পেট্রোবাংলার তথ্য বলছে, গত ২৯ জুন গ্যাসের জাতীয় গ্রিডে অন্তত ৮৫৪ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি সরবরাহ করা হয়। গতকাল সোমবার সরবরাহের পরিমাণ ৫০৭ মিলিয়ন ঘনফুটে নেমে এসেছে।

পেট্রোবাংলা ও জ্বালানি বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, দেশে প্রায় ২৫০-৩০০ ঘনফুট এলএনজির চাহিদা আন্তর্জাতিক স্পট মার্কেট থেকে কিনে পূরণ করা হলেও, সম্প্রতি মূল্যবৃদ্ধির পর দাম না কমা পর্যন্ত স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি না কেনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

চলতি বছরের শুরু থেকে সারাদেশে গড়ে ৩ হাজার ১০০ থেকে ৩ হাজার ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট প্রাকৃতিক গ্যাস বিতরণ করা হয়েছে।

কিন্তু, পেট্রোবাংলার দৈনিক উৎপাদন ও বিতরণ প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ৩০ জুন থেকে গড় সরবরাহ কমে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৮০০ থেকে ২ হাজার ৯০০ মিলিয়ন ঘনফুটে।

পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান বলেছেন, দাম কমার পর স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি কেনা হবে।

তিনি বলেন, 'বিশ্বে একটি সংকট চলছে এবং সবাই মিতব্যয়ী হওয়ার চেষ্টা করছে। এ অবস্থায় আমরাও অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে আরও বেশি গ্যাস উৎপাদনের চেষ্টা করছি।'

এদিকে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজি ও অন্যান্য জ্বালানির দাম বাড়ায় সরকার বিপাকে পড়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা সর্বশেষ মে মাসে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি কিনি। তখন প্রতি মেট্রিক মিলিয়ন ব্রিটিশ থার্মাল ইউনিটের দাম ছিল ২৬ মার্কিন ডলার। এখন এর দাম ৩৬ ডলারেরও বেশি।'

আর এ কারণে গত কয়েকদিনে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ঘাটতিতে লোডশেডিংয়ের দুর্ভোগে পড়েছেন রাজধানীবাসী। দেশের অন্যান্য জেলার পরিস্থিতি আরও খারাপ।

ঢাকায় গত ৩০ জুন থেকে বিভিন্ন এলাকায় দিনে ৩-৪ বার লোডশেডিং হচ্ছে। প্রতিবার তা ৩০-৪০ মিনিট স্থায়ী হচ্ছে।

রাজধানীর বনশ্রী এলাকার বাসিন্দা হাসিনা বেগম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'রাতে অন্তত ৪-৫ বার বিদ্যুৎ চলে যাওয়ায় ঘুমাতে পারিনি। ঘরে শিশু আছে। সারারাত সে ঘামছিল। খুবই কষ্ট হয়েছে।'

অনেক ক্ষেত্রে এক ঘণ্টারও বেশি সময় লোডশেডিং হয়েছে।

আদাবর এলাকার বাসিন্দা হাসানুর রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'রোববার প্রায় এক ঘণ্টা বিদ্যুৎ ছিল না।'

চট্টগ্রামের বাসিন্দাদের অভিযোগ, তারা দিনে প্রায় ৮-১০ বার বিদ্যুৎ-বিভ্রাটের শিকার হচ্ছেন।

বিপিডিবির চট্টগ্রাম জোনের উপপরিচালক শহিদুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে বলেন, বন্দরনগরীতে দৈনিক সরবরাহে ২০০ মেগাওয়াট ঘাটতি হচ্ছে।

'আমরা মূলত বাসাবাড়িতে লোডশেডিং দিয়ে ঘাটতি পূরণ করছি, যেন শিল্প এলাকার ওপর এর প্রভাব না পড়ে', বলেন তিনি।

লোডশেডিং

২০১২ সালে জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিদ্যুতের উৎপাদন ঘাটতি মোকাবিলায় দিনে ২ ঘণ্টা করে লোডশেডিং করার নির্দেশ দেন। এর আগে লোডশেডিংয়ের সুনির্দিষ্ট কোনো সময় ছিল না।

২০১৮ সালে সরকার ঘোষণা করে, দেশে উৎপাদন পর্যায়ে কোনো লোডশেডিং নেই। যেটুকু আছে, সেটা বিতরণ সমস্যা ও সিস্টেম লসের কারণে হয়ে থাকে।

যোগাযোগ করা হলে বিপিডিবির জনসংযোগ পরিদপ্তরের পরিচালক সাইফুল হাসান চৌধুরী ডেইলি স্টারকে বলেন, 'পিক টাইমে সারাদেশে দৈনিক ১৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদা আছে। তবে আমরা এখন ১২ থেকে ১৩ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন করছি।'

তিনি বলেন, 'আগে উৎপাদন ঘাটতি ছিল না, তাই লোডশেডিংও ছিল না। কিন্তু এখন আমরা ঘাটতিতে আছি। যদি কোনো বিকল্প উৎস না পাওয়া যায়, তবে আরও কিছু দিন এ অবস্থা চলবে।'

ডিপিডিসি আওতাধীন এলাকায় দৈনিক ১ হাজার ৩০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদা থাকলেও, গত দুই দিন ১ হাজার মেগাওয়াট দেওয়া হচ্ছে বলে বিদ্যুৎ বিভাগের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন।

ওই কর্মকর্তা আরও জানান, ঢাকায় বিদ্যুৎ বিতরণে আরেকটি প্রতিষ্ঠান ডেসকোর চাহিদা প্রতিদিন ১ হাজার মেগাওয়াট। কিন্তু গত কয়েকদিন ধরে ডেসকো ৮৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাচ্ছে।

বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সিনিয়র ভাইস-প্রেসিডেন্ট শহীদুল্লাহ আজিম বলেন, 'অনেক কারখানার মালিক অভিযোগ করেছেন যে শিল্পাঞ্চলে লোডশেডিংয়ের কারণে তাদের উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অনেক উৎপাদক সময়মতো পণ্য চালান করতে পারছেন না।'

আজিম বলেন, 'বিদ্যুৎ-বিভ্রাটের কারণে অনেক কারখানার মালিকদের উৎপাদন চালিয়ে যাওয়ার জন্য জেনারেটরের জন্য ডিজেল কিনতে হচ্ছে। এমনিতেই কঠিন সময় চলছে। তার ওপর এ কারণে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে।'

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা ডেইলি স্টারকে বলেন, 'গ্যাসের ওপর নির্ভরতা কমাতে আমরা ঢাকা শহরে প্রায় এক ঘণ্টা লোডশেডিংয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এ সময়টায় বিকল্প হিসেবে জ্বালানি তেল-ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো চালানো যেত। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনও সমস্যায় আছে।'

'বড় ধরনের লোকসান এড়াতে তাই বেশিরভাগ তেল-ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র না চালানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে', যোগ করেন তিনি।

বিদ্যুতের এ সংকট দীর্ঘদিন চলবে বলে আশঙ্কা করছেন বিদ্যুৎ বিভাগের আরেক কর্মকর্তা।

তিনি বলেন, 'সংকটময় এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিভিন্ন ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। ঈদের পর রাত ৮টার মধ্যে সব মার্কেট ও শপিংমল বন্ধ রাখার নিয়ম আমরা আবার চালু করব।'

সারাদেশেই সংকট

দেশের অন্যান্য অঞ্চলে লোডশেডিং আরও তীব্র। অনেক এলাকায় দিনে ৭-৮ ঘণ্টা বিদ্যুৎ-বিভ্রাট হচ্ছে বলে ডেইলি স্টারের বিভিন্ন জেলার প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন।

গাজীপুরে আবাসিক গ্রাহকেরা সারাদিনে তিন-চার ঘণ্টা বিদ্যুৎ পাচ্ছেন না। তবে শিল্পক্ষেত্রে এটি এক ঘণ্টার মতো।

একটি পোশাকশিল্প কারখানার পরিচালক নাসির উদ্দিন বলেন, এক ঘণ্টা বিদ্যুৎ না থাকা মানে একজন শ্রমিকের দেড় থেকে দুই কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়।

তিনি বলেন, বিদ্যুৎ না থাকলে গরমের কারণে কর্মীদের ছুটি না দিয়ে উপায় নেই।

উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে লোডশেডিং তীব্র হয়েছে; বিশেষ করে রাজশাহী, বগুড়া, জয়পুরহাট ও গাইবান্ধায়।

বগুড়া ২৫০ শয্যার মোহাম্মাদ আলী হাসপাতালে কর্মরত এক চিকিৎসক বলেন, 'অপারেশন থিয়েটারে অনেক সময় অর্ধেক অপারেশন করে বিদ্যুৎ চলে যাচ্ছে এবং চিকিৎসকদের জেনারেটরের জন্য অপেক্ষা করতে হচ্ছে। আবার কিছু কিছু মেশিন জেনারেটর দিয়ে চালানোও সম্ভব হচ্ছে না। তা ছাড়া এক্স-রে ও প্যাথলজি ডিপার্টমেন্টও ঠিকভাবে কাজ করতে পারছে না।'

রাজশাহী শহরের বাসিন্দা সাবিনা আকতার বলেন, গত কয়েকদিন ধরে দিনে-রাতে সমানতালে বিদ্যুতের সমস্যা হচ্ছে।

নর্দার্ন ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাকিরুল ইসলাম বলেন, রাজশাহী ও রংপুর বিভাগে ২০০ মেগাওয়াট করে বিদ্যুতের ঘাটতি রয়েছে।

Comments

The Daily Star  | English

New Hampshire hamlet tied in first US Election day votes

Kamala Harris and Donald Trump each got three ballots in the tiny community in the northeastern state of New Hampshire

9m ago