গ্রামের মানুষকে কেন এত লোডশেডিং সহ্য করতে হবে?

এ বছর ভিন্নমাত্রার গরম আবহাওয়া দেখেছেন দেশের মানুষ। গ্রাম কিংবা শহর, রাত কিংবা দিন—এবারের গ্রীষ্মকালটা প্রায় অসহনীয় ছিল। সবচেয়ে বড় কথা, ওই সময়ে মানুষ গরম থেকে বাঁচার জন্য যে পরিমাণ নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ প্রত্যাশা করেছিলেন, সরকার সেটা দিতে পারেনি, পারছে না। ফলে দেশের মানুষ অসহনীয় গরমের মধ্যেই দৈনন্দিন কাজ করে চলেছেন।

লোডশেডিংয়ে সবচেয়ে বেশি কষ্ট হচ্ছে দেশের গরিব মানুষের, যারা মূলত গ্রামাঞ্চলে বসবাস করেন এবং যাদের বাড়িতে বিদ্যুতের বিকল্প ব্যবস্থা নেই।

গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড চাহিদার তুলনায় ৩০ শতাংশ কম বিদ্যুৎ পাওয়ায় জুন-জুলাই মাসে দিনে ৮-১০ ঘণ্টা পর্যন্ত লোডশেডিং দিয়েছে, বিশেষ করে গ্রামে। এতে সাধারণ মানুষের, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের মানুষের দৈনন্দিন জীবনে ব্যাপক প্রভাব পড়েছে।

আগের চেয়ে অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলেও এখনো উত্তরাঞ্চলের গ্রামগুলোতে, বিশেষ করে রাতে অনেক বেশি লোডশেডিং হচ্ছে। সরকার বিদ্যুৎ ঘাটতি পূরণ না করতে পারলেও সরকারি ও বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে বসিয়ে রেখে জনগণের করের পয়সায় প্রতি মাসে হাজারো কোটি টাকা ফিক্সড চার্জ বা ক্যাপাসিটি চার্জ দিচ্ছে।

আওয়ামী লীগ সরকারের গত ১৪ বছরের মেয়াদে বিদ্যুৎ উৎপাদন না করেও ৮২টি বেসরকারি এবং ৩২টি রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে পেয়েছে ১ লাখ ৫ হাজার কোটি টাকা। গত ৫ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদে এক প্রশ্নের উত্তরে এ তথ্য দিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ।

শহরের তুলনায় গ্রামে লোডশেডিং অনেক বেশি দেওয়া হচ্ছে। এর বহুবিধ কারণও রয়েছে। শহরে গুরুত্বপূর্ণ মানুষদের আবাসন, শিল্পকারখানা, বড় বড় অফিস-আদালত—তাই শহরে বিদ্যুৎ সরবরাহও বেশি। বড় শহরের কোনো একটি অংশে কয়েক ঘণ্টা বিদ্যুৎ না থাকলে বিদ্যুৎ সরবরাহ অফিসে অনেক জায়গা থেকে ফোন আসে। সরকার দলীয় নেতারাও এসব অফিসে ফোন করেন দ্রুত বিদ্যুৎ দেওয়াও তাগাদা দিতে। অনেক সময় মানুষ প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসেন, বিদ্যুৎ অফিসে হামলার ঘটনাও ঘটে।

বিপরীতে, গ্রামে লোডশেডিং হলে এমন কিছু হয় না। বরং তারা বিদ্যুৎ আসার অপেক্ষায় থাকেন। বিকল্প ব্যবস্থা না থাকায় শহরের তুলনায় গ্রামে লোডশেডিংয়ে দুর্ভোগ অনেক বেশি হয়। বিদ্যুতের বিকল্প হিসেবে শহরের বেশিরভাগ অফিস-আদালত, শিল্পকারখানা, আবাসিক এলাকা, কিংবা বাড়িতে জেনারেটর কিংবা আইপিএস থাকে। কিন্তু গ্রামের বেশিরভাগ বাড়িতে এসব নেই। কারণ, এসব বিকল্প ব্যবস্থা করার সামর্থ্য বেশিরভাগ মানুষের নেই।

গ্রামের মানুষের এমন দুর্ভোগের কিছু উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। যেমন: গ্রামের যে কর্মজীবী নারীর এক-দুই বছরের শিশু আছে, যাকে সকালে রান্না করে কর্মক্ষেত্রে যেতে হয়, তার কথা একবার ভাবুন।

গত কয়েকদিন ধরে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা শহরেও রাতে বেশ কয়েকবার বিদ্যুৎ চলে যাচ্ছে। একবার গেলে ১ ঘণ্টার আগে বিদ্যুৎ আসে না। যে কর্মজীবী নারীর বাড়িতে ফ্যান চালানোর কোনো বিকল্প ব্যবস্থা নেই, তাকে ছোট শিশুকে ঘুম পড়ানোর জন্য মাঝরাতেও হাতপাখা দিয়ে বাতাস করতে হয়। তাহলে, তিনি এভাবে রাত জেগে পরদিন নিজ কর্মক্ষেত্রে সুষ্ঠুভাবে নিজের কাজ সম্পন্ন করবেন কীভাবে?

গত ২০ বছরে গ্রামাঞ্চলের অনেক উন্নয়ন হয়েছে, এ কথা সত্যি। কুপি বা হারিকেনের আলোয় পড়াশুনা করা শিক্ষার্থী, মাটির চুলায় রান্না করা গৃহিণী, ব্যাটারি ব্যবহার করে টেলিভিশন দেখা মানুষ, তেল পুড়িয়ে রাইস মিলে ধান ভাঙানো ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে সবাই এখন বিদ্যুতে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। তাদের ঘরে ফ্রিজ, রাইস কুকারের মতো বৈদ্যুতিক যন্ত্র এসেছে। কৃষিখাত অনেক বেশি বিদ্যুৎ নির্ভর হয়েছে। এমনকি অনেক চরাঞ্চলও বিদ্যুতের আওতায় এসেছে। তারাও ইলেক্ট্রনিক জিনিসপত্রের ওপর নির্ভরশীল হচ্ছেন।

শুধুমাত্র বিদ্যুৎ সংকটের কারণে এই উন্নয়নের সুবিধা গ্রামের মানুষ পুরোপুরি পাচ্ছেন না।

এই মানুষগুলো বিদ্যুতে অভ্যস্ত হলেও তাদের আর্থিক সংগতি এমন পর্যায়ে পৌঁছায়নি যে বিদ্যুৎ না থাকলে তার বিকল্প ব্যবস্থা রাখবে। যাদের অবস্থা একটু ভালো তারা বাড়িতে আইপিএস বা সৌরবিদ্যুৎ লাগাতে পারলেও বেশিরভাগ মানুষের সেই সাধ্য নেই।

ফলে, এখন গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুৎ না থাকলে গরমের রাতে তারা ঘুমাতে পারেন না, জমিতে সেচ দিতে পারেন না, শিক্ষার্থীরা পড়াশুনা করতে পারে না। এমনকি উপজেলা শহরগুলোতে বিদ্যুৎ না থাকলে হাসপাতালে গুরুতর কোনো অপারেশন সম্ভব হয় না, অফিস-আদালতে কাজের ব্যাঘাত ঘটে।

বিদ্যুৎ না থাকার কারণে এমন দুর্ভোগের পরও তারা কিন্তু কোনো প্রতিবাদ করেন না।

এবার আসি মুদ্রার আরেক পিঠে। এমন অনেক উদাহরণ আছে যে গ্রামের কোনো একটি বাড়িতে যেখানে মাসে সাধারণত বিদ্যুৎ বিল আসে ৩০০-৪০০ টাকা, হঠাৎ কোনো এক মাসে তার বিল এলো ১০ গুণ বা ২০ গুণ বেশি। কোনো দিনমজুর বা গরিব কৃষকের বিদ্যুৎ বিল দুই-তিন মাস বকেয়া থাকলে, তার সংযোগ কেটে দেওয়া হয়।

অথচ শহরের অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তি বা সরকারি অফিসের লাখো টাকার বিদ্যুৎ বিল বছরের পর বছর বকেয়া থাকলেও তাদের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয় না। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ বিল চাওয়ারও সাহস হয় না।

গত ৬ সেপ্টেম্বর দৈনিক প্রথম আলোতে 'সমাজকল্যাণমন্ত্রী এবং তাঁর পরিবারের বিদ্যুৎ বিল বকেয়া ৯ লাখ টাকা' শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশ হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, সমাজকল্যাণমন্ত্রী ও লালমনিরহাট-২ (আদিতমারী-কালীগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য নুরুজ্জামান আহমেদ, তার ছেলে, ভাই ও প্রয়াত বাবার কাছে প্রায় নয় লাখ টাকা বিদ্যুৎ বিল পাওনা নর্দান ইলেক্ট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেডের (নেসকো)। মাসের পর মাস বিল পরিশোধ না করলেও পাওনা আদায়ে উদ্যোগী হচ্ছে না নেসকো।

এ সংবাদ প্রকাশের পর মন্ত্রী তার বকেয়া বিল পরিশোধ করেছেন।

অথচ এই একই প্রতিষ্ঠান সাধারণ মানুষের কাছ থেকে বিদ্যুৎ বিল আদায় করার জন্য প্রতি মাসে উপজেলা শহরগুলোতে মাইকিং করে হুঁশিয়ারি দেয় যে যাদের বিদ্যুৎ বিল দুই মাসের বেশি বাকি থাকবে, তাদের সংযোগ কোনো সতর্কতা ছাড়াই বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হবে।

যদি ধরেও নেওয়া হয় যে নয় লাখ টাকা বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ না করায় মন্ত্রীর বাড়ির বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হবে—তাতেও তার বা তার পরিবারের খুব বেশি অসুবিধা হবে না। কারণ, জেনারেটর, আইপিএসের মতো বিকল্প উপায়ে তার বাড়িতে বিদ্যুতের চাহিদা পূরণ হবে।

কিন্তু যে গরিব কৃষকের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়, তার কোনো বিকল্প থাকে না। অথচ, ওই কৃষক ইচ্ছাকৃতভাবে বিদ্যুৎ বিল বকেয়া করেন না। তিনি অর্থ সংকটে পড়ে বাধ্য হয়েই বিদ্যুৎ বিল পরিশোধে অপারগ হন।

বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধির কথা বলে গরিব মানুষের গাঁটের পয়সা দিয়ে ২৪ হাজার মেগাওয়াটের সক্ষমতা তৈরি করে এর অর্ধেক বিদ্যুৎ উৎপাদনও করতে পারছে না সরকার। বাকি অর্ধেক বসিয়ে রেখে হাজারো কোটি টাকা খরচ করে 'লুটেরা মডেল' কায়েম করা হয়েছে কেবলমাত্র এক শ্রেণীর মানুষের পকেট ভারি করার জন্য।

কিন্তু, অসহায় গরিব মানুষগুলোর ঘরে চলছে লোডশেডিং। বিদ্যুতে অভ্যস্ত হওয়া এই মানুষগুলোর বিকল্প না থাকায় পড়ছেন দুর্দশায়। তাই এই দুর্ভোগকে মেনে নিয়ে, সয়ে নিয়ে দিনযাপন করছেন গ্রামাঞ্চলের নিম্নআয়ের মানুষগুলো। তাদের অভিযোগ করার জায়গা নেই, প্রতিবাদ করারও সাহস নেই। লোডশেডিং গ্রামের মানুষের জন্য প্রায় অসহনীয় হয়ে পড়লেও তাদের কথা কেই-বা ভাবছে? তারা শুধু অপেক্ষায় থাকেন, বিদ্যুৎ কখন আসবে।

মোস্তফা সবুজ দ্য ডেইলি স্টারের বগুড়া প্রতিনিধি

Comments

The Daily Star  | English
Banking sector crisis

Why is the banking sector crisis so deep-rooted?

The regime-sponsored immorality to protect or pamper the financial gangsters not only eroded the future of the banking sector, but also made the wound too difficult to recover from.

5h ago