মালদ্বীপের ভাসমান শহর

মালদ্বীপের ভাসমান শহর
মালদ্বীপের ভাসমান শহরের মাস্টার প্লান। ছবি: ওয়াটারস্টুডিওর ওয়েবসাইট থেকে

ভারত মহাসাগরে দৃশ্যমান হচ্ছে একটি শহর। সম্পূর্ণ নতুন একটি শহর। মালদ্বীপের রাজধানী মালে থেকে নৌকায় সেখানে যেতে লাগবে মাত্র ১০ মিনিট।

না, চর জেগে নয়। ভাসমান এই শহরটি তৈরি করা হচ্ছে। মানুষের মস্তিষ্কের মতো দেখতে এই শহরটি যৌথভাবে তৈরি করছে ডাচ ডকল্যান্ডস ও মালদ্বীপ সরকার। এর ডিজাইন করেছে ২০০৩ সালে শুরু হওয়ার স্থাপত্য সংস্থা 'ওয়াটারস্টুডিও'।

গত দুই দশকে ওয়াটারস্টুডিও ৩০০টিরও বেশি ভাসমান বাড়ি, অফিস, স্কুল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্র ডিজাইন করেছে।

মাস্টার প্লানে মালদ্বীপের ভাসমান শহর। ছবি: ওয়াটারস্টুডিওর ওয়েবসাইট থেকে

সিএনএনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই শহরটিতে অন্তত ২০ হাজার মানুষ বসবাস করতে পারবেন।

ভাসমান এমন শহরের কথা শুনলেই চোখের সামনে ভাসতে থাকে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ের মানবসৃষ্ট ভাসমান শহর পাম দ্বীপের কথা। মূলত অবসর ও বিনোদন কেন্দ্র হিসেবে এই দ্বীপটি তৈরি হলেও মালদ্বীপের নতুন ভাসমান শহরের উদ্দেশ্য একটু আলাদা।

ভারত মহাসাগরের বুকে এক হাজার ২০০টিরও বেশি ছোট ছোট দ্বীপ নিয়ে গঠিত মালদ্বীপ। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে দেশটি ডুবে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। এই কঠোর বাস্তবতা মোকাবিলা করতেই এই শহর তৈরি উদ্যোগ নেয় মালদ্বীপ সরকার। ভাসমান এই শহরে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা নিয়ে নিশ্চিতভাবেই কমবে আতঙ্ক।

শহরটিতে বাড়ি, রেস্তোরাঁ, দোকান ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ ৫ হাজার ভাসমান ইউনিট থাকবে।

নির্মাতারা আশা করছেন, ২০২৪ সালের শুরুতেই এই শহরে উঠতে পারবেন বাসিন্দারা। ২০২৭ সালের মধ্যে শেষ হতে পারে পুরো প্রকল্পের কাজ।

ওয়াটারস্টুডিওর প্রতিষ্ঠাতা কোয়েন ওলথুইস মনে করেন, এই শহরটি মালদ্বীপের নাগরিকদের জন্য 'নতুন আশা'। তিনি বলেন, 'এটা প্রমাণ করবে যে, সাশ্রয়ী মূল্যে ভাসমান আবাসন তৈরি সম্ভব এবং অনেক মানুষ নিয়ে একটি শহর পানির ওপরে নিরাপদে থাকতে পারে।'

ওলথুইসের জন্ম নেদারল্যান্ডে। দেশটির প্রায় এক তৃতীয়াংশ ভূমি সমুদ্রপৃষ্ঠের নীচে অবস্থিত। ফলে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে পরিস্থিতি কেমন হয় তা তিনি বেশ ভালো ভাবেই জানেন।

এমনকি ভাসমান একটি শহর রয়েছে নেদারল্যান্ডেও। নেদারল্যান্ডের রাজধানী আমস্টারডামের ওয়াটারবুর্টে এমন একটি জনবসতির দেখা পাওয়া যায় যারা ভাসমান শহরেই থাকেন। একে বলা হয় 'ভাসমান মহল্লা'। একটি প্রশস্ত সাদা জেটি এই মহল্লার সীমানা নির্ধারণ করেছে।

মাস্টার প্লানে মালদ্বীপের ভাসমান শহর। ছবি: ওয়াটারস্টুডিওর ওয়েবসাইট থেকে

২০২১ সালে বন্যায় বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রায় ৮২ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি ক্ষতি হয়েছিল। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এই ক্ষতির পরিমাণ আগামী দিনগুলোতে আরও বাড়বে বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। ওয়ার্ল্ড রিসোর্স ইন্সটিটিউটের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০৩০ সালের মধ্যে উপকূলীয় ও নদী তীরবর্তী এলাকায় বন্যার কারণে বছরে ৭০০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি ক্ষতি হবে।

এ ক্ষেত্রে ভাসমান শহর কিছুটা স্বস্তি দিতে পারে। যদিও এর জন্য পাড়ি দিতে হবে আরও অনেকটা পথ।

মালদ্বীপের এই ভাসমান শহরের লক্ষ্য হচ্ছে, ৫ বছরেরও কম সময়ের মধ্যে ২০ হাজার মানুষের জন্য আবাসস্থল তৈরি করা।

এই শহরের ডিজাইন এমনভাবে করা হয়েছে যেন মানুষ তাদের ঘরের বারান্দা থেকে সমুদ্র দেখতে পারে। পুরো শহরটিই যেহেতু পানির ওপরে তাই বাসিন্দারা সেখানে নৌকা নিয়ে ঘুরতে পারবেন। পাশাপাশি রাস্তায় হাঁটতে, সাইকেল চালাতে বা বৈদ্যুতিক স্কুটারও চালাতে পারবেন।

মালদ্বীপের রাজধানী মালে অত্যন্ত জনাকীর্ণ। সমুদ্রের দিকেও শহরটি বাড়ানোর জন্য জায়গা নেই।

রাজধানীর প্রতি শহরটির ৮ বর্গ কিলোমিটারে প্রায় ২ লাখ মানুষ বসবাস করেন। জনবসতি বেশি হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই এই শহরের জমি ও ফ্ল্যাটের দাম আকাশ ছোঁয়া। সেখানে একটি স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্ট কিনতে খরচ করতে হয় প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার ডলার এবং পরিবারের জন্য অ্যাপার্টমেন্ট কিনতে গেলে প্রয়োজন হয় প্রায় ২ লাখ ৫০ হাজার ডলার।

নতুন শহরের জন্য ভাসমান ইউনিটগুলো একটি স্থানীয় শিপইয়ার্ডে নির্মিত হচ্ছে। সেখান থেকে সেগুলো নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ভাসমান শহরে। যে অংশ যেখানে থাকবে সেখানে বসিয়ে পানির নিচের একটি বড় কংক্রিট হালের সঙ্গে সংযুক্ত করা হচ্ছে। এটি টেলিস্কোপিক ইস্পাত স্টিল্টের সঙ্গে স্ক্রু দিয়ে আটকে দেওয়া হচ্ছে। ফলে, সমুদ্রের পানির তরঙ্গের সঙ্গে ইউনিটগুলো ওঠানামা করতে পারবে।

পানির বড় ঢেউয়ের ধাক্কা সামলাতে এই শহরের চারদিকে তৈরি করা হচ্ছে প্রবাল প্রাচীর। ফলে, ঢেউয়ের কারণে সেখানকার বাসিন্দাদের বড় কোনো সমস্যায় পড়তে হবে না। আর এই প্রবাল কৃত্রিমভাবে তৈরি করা হচ্ছে গ্লাস ফোম থেকে। পরবর্তীতে যা প্রাকৃতিক প্রবাল তৈরিতে সাহায্য করবে।

এই শহরের আরেকটি লক্ষ্য থাকবে স্বাবলম্বী হওয়ার। এখানে বিদ্যুৎ থাকবে, তবে তার প্রধান উৎস হবে সৌর শক্তি। সমতলের ভূমির মতো এখানে চাষ হবে। ব্যবহৃত পানি পরিশোধনের ব্যবস্থাও থাকবে। এয়ার কন্ডিশনারের বিকল্প হিসেবে এই শহর ব্যবহার করবে গভীর সমুদ্রের শীতলতা। গভীর সমুদ্র থেকে পাম্প করে ঠাণ্ডা পানি তুলে আনা হবে জলাধারগুলোতে।

মালদ্বীপে এই প্রকল্পটি প্রত্যাশা অনুযায়ী বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলে তা হয়ে উঠবে একটি মাইলফলক। বিশ্বের বেশকিছু দেশ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আংশিক বা পুরোপুরি ডুবে যাওয়ার আশংকায় রয়েছে। এমন প্রকল্প তাদেরও আশার আলো দেখাবে।

একই সঙ্গে মালদ্বীপের পর্যটনেও এই ভাসমান শহরটি নিঃসন্দেহে প্রভাব ফেলবে। একটি ভাসমান শহর দেখতে কিংবা সেখানে কয়েকটি দিন কাটিয়ে আসতে চাইবেন বিশ্বের নানা প্রান্তের ভ্রমণপ্রেমী মানুষ।

Comments

The Daily Star  | English
Govt employees protest at Secretariat May 2025

The right way to reform the public administration

Bangladesh needs a bureaucracy that serves its citizens with professionalism and integrity, not one driven by blind obedience.

10h ago