গোয়া: মেঘ, পাহাড় আর সমুদ্রের আবাস
তৃতীয় দিনে পুরনো গোয়া আর মাডগাও, ভাস্কো দা গামা ঘুরে বেড়াব। তাই স্কুটি না নিয়ে ট্যাক্সি ভাড়া করলাম সারাদিনের জন্য। এর পেছনে অবশ্য বৃষ্টি একটি বড় কারণ। গতকাল সারাদিন ভিজে ভিজে ঘুরেছি। আজ আর তাই ঝুঁকি নিলাম না।
পথে সালিগাও নামে একটা জায়গায় গির্জার সামনে থামলাম। এর বাইরের দিকটা দেখে বোঝার উপায় নেই যে আমি ভারতে আছি। 'মে দা দিস চার্চ' নির্মিত হয়েছিল ১৮৭৩ সালে। অন্যান্য গির্জার মতো পুরনো না হলেও এটা দেখতে একেবারে সাদা আনকোরা প্রাসাদের মতো। এক দেখায় মনে হয় রাজকীয় যাত্রা এখান থেকেই শুরু করা যাবে। গির্জার সামনের দিগন্ত উন্মোচিত হয়ে আছে সবুজ ধানখেতে৷ এর পেছনে সারি সারি নারকেল গাছ আর তারও পেছনে সবুজ পাহাড়।
এরপর চলে গেলাম বিখ্যাত গির্জা 'চার্চ অব সেইন্ট অগাস্টিন' এর দিকে। অবশ্য এসবের চেয়ে আমার কাছে এখনকার নতুন রূপে সবুজ রঙা গোয়া বেশি পছন্দের। আগে এমন রূপে আর দেখিনি। চার্চ অব সেইন্ট অগাস্টিনের বিশেষত্ব ছিল বিশাল এলাকা জুড়ে এটি একাধারে গির্জা, ধর্মীয় শিক্ষালয় ও ছাত্রাবাস ছিল। বিশ্বের পুরনো ও উল্লেখযোগ্য প্রথম ৩টি আইবেরীয় গির্জার মধ্যে এটি একটি। ১৫৯৭ সালে এ গির্জাটির নির্মাণ কাজ শুরু হয়। তখন উঁচু ৪টি ভবন ছিল। এখন মাত্র একটির খণ্ডাংশ অবশিষ্ট আছে।
এই চত্বর আর আশেপাশে ঘুরতেই বিকেল হয়ে গেল।
আমার ট্যাক্সিচালক রউফ খান সকাল থেকে বকবক করে মাথা ধরিয়ে দিয়েছে। কয়েকবার বকা দিয়েও থামাতে পারিনি। তার ধারণা আমি পর্তুগীজদের বংশধর, এ কারণে ভাস্কো দা গামা এসে ঘুরে বেড়াচ্ছি। মাঝখান দিয়ে চট করে বলেও ফেলল, মদিরা কিনতে চাইলে সে আমাকে খুব সস্তায় পাওয়া যায় এমন দোকানে নিয়ে যাবে।
রোববার হলেও কোনো গির্জায় উৎসবের নিশানা দেখলাম না। কোনো গির্জায় আলোকসজ্জাও নেই। খুব হতাশ হলাম। সদ্য লকডাউন তুলে নেওয়া হলেও মানুষের মন থেকে ভয় যায়নি।
ফিরে গেলাম কালাংগুট বীচে। রাতের কালাংগুট এখন ট্যুরিস্টে গিজগিজ করছে। এতো মানুষ সারাদিন ছিল কোথায়! চারদিক কৃত্রিম আলো আর ইংরেজি গানে গমগম করছে। গোয়ায় মানুষ বেড়াতে আসে এ কারণেই—হৈচৈ করবে, ডিসকোতে নাচবে, তারপর ছুটি কাটিয়ে নিজ শহরে ফিরে যাবে।
চতুর্থ ও শেষ দিন। ট্যাক্সি নেইনি। একটা স্কুটি নিয়ে প্রথমে গেলাম কালাংগুট মাছের বাজারে৷ নারী-পুরুষ সব বিক্রেতা বসেছে মাছ নিয়ে। সামুদ্রিক মাছের স্বর্গ এই বাজার। তবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন আর টাইলস বসানো দেয়াল, মেঝেও পরিচ্ছন্ন। বিক্রেতাদের মাঝেও কোনো চেঁচামেচি নেই। আমরা মাছের বাজার বলতে যা বুঝি তা এখানে অনুপস্থিত। তবে সেই পরিচিত গন্ধটা ঠিকই আছে।
সেখান থেকে চলে গেলাম ফোর্ট আগুয়েডায়। এটা আমার রিসোর্ট থেকে কাছেই। আগে অনেকবার এসেছি। ফোর্ট আগুয়েডা নির্মিত হয়েছিল ১৬১২ সালে গোয়া রাজ্যকে ওলন্দাজদের আক্রমণ থেকে ঠেকানোর জন্য। বিশালাকৃতির এই দুর্গ আরব সাগরের তীরে নির্মিত। একটি আধুনিক দুর্গের সবই আছে এতে। মাটির নীচে কুঠুরি থেকে শুরু করে, জেলখানা ও একদম ওপর তলায় উঁচু লাইটহাউজ। ৪ তলা সমান গোলাকার, সাদা লাইটহাউজে জ্বলতে থাকা বাতি দেখে আগের দিনে নাবিকরা পথ চিনে সৈকতে নোঙর ফেলত।
আগে নীচতলার কুঠুরিতে যাওয়ার অনুমতি ছিল। কিন্তু এখন বন্ধ। শুধু ছাদের ওপর সাদা রঙের লাইটহাউজের কাছে যাওয়া যায়। ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় আমাদের ছুটি কাটানোর প্রিয় জায়গা ছিল এই ফোর্ট আগুয়েডা। এই ফোর্টের ছাদ থেকে সমুদ্র দেখা যায়। ছাদের রেলিং এ কয়েকটা জানালার মতো ফাকা জায়গা আছে যেখানে আমরা সারাদিন বসে থাকতাম। রেলিংয়ের ওপাশে নীল আরব সাগর ছলাৎ ছলাৎ করছে। এই মেঘ এই রোদে নীচের সৈকত ধুয়ে যাচ্ছে। উপর থেকে ঘন গাছগুলোকেই মনে হয় সমুদ্রের নিজস্ব দুর্গ।
মূল ভবনে ভিড় দেখে চলে গেলাম নীচের আরেক অংশে, যেখানে দুর্গের দেয়াল ছুঁয়ে আছে সবুজ জল। এই সৈকতের নাম সিকেরিম বীচ। মনে হলো, জল একেবারে পান্না সবুজ হয়ে সোনালী তটের কাছে ছুটে ছুটে আসছে। নীরব সমুদ্র আরও সাবলীল হয়ে দুর্গের পেছনে লুকাতে চাইছে। যেন কেউ দেখে ফেললেই রূপের সব রহস্য ফাঁস হয়ে যাবে।
এখান থেকে কান্ডোলিম বীচ কাছেই। একটা ঢুঁ মেরে চললাম আরামবোল বীচের দিকে।
আরামবোল বীচকে আমার মনে হয় এমন একটা সৈকত যেখানে পাহাড়ের গায়ে হেলান দিয়ে সাগর নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারে। এখানে পাহাড় আর সাগর মুখোমুখি বসে আছে। যখন সাগর ক্লান্ত হয়ে যায় জগতের ভার বইতে বইতে তখন সবকিছু ঝেড়ে ফেলে নির্ভার হয়ে হেলান দেয় সবুজ পাহাড়ের গায়ে, ঘুমিয়ে পড়ে।
সৈকতের এই বিশ্রাম দেখতেই আসা আমার। আরামবোলও অন্যান্য সৈকতের মতো নীরব এখন।
আমি সরাসরি তটে না গিয়ে একটা পাহাড়ের চূড়ায় উঠে বসে বইলাম। এতো নীল সাগর আগে ছিল না। এতো সবুজও প্রকৃতি প্রকাশ পায়নি। তটের বালিতেও বোধহয় সোনা মিশিয়ে দিয়েছে কেউ। আগে তটের আশেপাশে অনেক অস্থায়ী দোকান ছিল। এখন মহামারিতে ব্যবসা নেই বলে সব ফাঁকা। প্রকৃতি রূপ খেলিয়ে যাচ্ছে কোনো বাধা ছাড়াই। এসব কারণেই এই ৩ ভাগ জলের গায়ে পা ডুবিয়ে রাখার ইচ্ছে গাঢ় হয়। এই উজাড় করা নিসর্গ চোখে মেখে আরও কয়েক যুগ ঘুরে বেড়ানোর ইচ্ছে জাগে। এই সাগর, নিসর্গ থেকে পথে পথে ঘুরে বেড়ানোর অনুপ্রেরণা পেয়ে যেতে হয়, আজীবন ঋণী থেকে যেতে হয়।
প্রথম পর্ব: গোয়া: ভারতের বুকেই যেন ছোট্ট এক পর্তুগাল
দ্বিতীয় পর্ব: গির্জার রাজ্য গোয়া
Comments