অরোভিলে এক দিন
সুয্যিমামার ঘুম তখনো পুরোপুরি কাটেনি। হাই তুলতে তুলতে যেন কমলা-কুসুম হয়ে দেখা দিলেন 'লা ক্যাফে'র অমলেটের প্লেটে। সেই সুদূর কক্সবাজার-মোংলাসহ দীঘা-পুরী-ভুবনেশ্বরের পাড় ভেজানো বঙ্গোপসাগরের ঢেউ আছড়ে পড়ছে পন্ডিচেরির সৈকত তথা লা ক্যাফের দেয়ালেও। ঠিক তাই, সমুদ্রতীরবর্তী এই শহর আর ক্যাফের ইতিহাস যেন সমার্থক!
পুদুচেরি (পন্ডিচেরি নামেও পরিচিত) ১৬৭৪ সালে ফরাসি কলোনি হয়। ১৭৯৩ সালের টাউন ম্যাপেও দেখা যাচ্ছে লা ক্যাফের এই বর্তমান স্থাপনা। অবশ্য তখন এটি ব্যবহৃত হতো হার্বার অফিস হিসেবে, পরে কাস্টম ও পোস্ট অফিস। ১৯৫০ সালের দিকে ঐতিহাসিক এই ভবনটি ক্যাফেতে রূপ দেওয়া হয়। যাই হোক, ধানের হাটে শিবের গীত না গাওয়াই ভালো! শহরের সবচেয়ে পুরনো ক্যাফে, কাস্টম হাউস বা পোস্ট অফিস—প্রায় ২৫০ বছর ধরে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে থাকা লা ক্যাফে-কেন্দ্রিক নানা গল্প অন্য কোনো লেখায় করা যাবে!
অক্টোবরের ঝলমলে সকাল। এইসব ভালো লাগে—রেলিঙের ফাঁক দিয়ে ভোরের সোনালি রোদ এসে 'আমার কাতর চোখ, আমার বিমর্ষ ম্লান চুল' নিয়ে খেলা করে। দূরে কয়েকটি কাক, মাঝে মাঝে 'জানালার পাশে উড়ে আসে নীরব সোহাগে'। কোথায় থাকবো-খাব-যাব, এসব নিয়ে ভ্রমণসঙ্গীদের বিরামহীন পরিকল্পনা তো চলছেই। পুদুচেরি ট্যুরিজম আর ট্রিপ অ্যাডভাইজর সাইটের যৌথ বিবৃতি, রক বিচসহ কয়েকটি সৈকত, শ্রী অরবিন্দ আশ্রম, আরুলমিগু মানাকুলা বিনয়গড় মন্দির, কারাইকাল চার্চ, ইমাকুলেট কনসেপশন ক্যাথেড্রাল, ফ্রেঞ্চ ওয়ার মেমরিয়াল, স্যাকরেড হার্ট ব্যাসিলিকা, ভারতী পার্ক, পুদুচেরি মিউজিয়াম প্রভৃতি না দেখে মোটেও যাওয়া যাবে না! তিন-চার দিনের সফর, আমরা জনা চারেকের দল, সেই হিসাবেই পরিকল্পনা হয়ে গেল, কবে-কোথায়-কখন যাব। লা ক্যাফে থেকে 'শ্রী অরবিন্দ আশ্রম' প্রায় ৭০০ থেকে ৮০০ মিটার দূরে। যেখানে ছিলাম সেখান থেকেও হাঁটাপথ। ফিরে আসার দিন দুপুরের পর বেরিয়ে পড়া।
গোটা পুদুচেরি শহরজুড়েই ফরাসি স্থাপত্যের ঘর-বাড়ি-দোকানপাট। আশ্রমটি হোয়াইট টাউনের মেরিন স্ট্রিটে। এই ফাঁকে অরবিন্দ ঘোষ (পরবর্তীতে শ্রী অরবিন্দ) সম্পর্কে কিছু কথা বলে ফেলা ভালো। এখন আর ধানের হাটে নেই, শিব তথা এই লেখার ক্ষেত্রে অরবিন্দর গীতই চলছে। কারণ এই অরবিন্দ থেকেই 'অরোভিল' অর্থাৎ মূল লেখা যেটিকে ঘিরে। তো যা বলছিলাম, অরবিন্দ একাধারে দার্শনিক, আধ্যাত্মিক ও যোগ গুরু, মহর্ষি, কবি, সাংবাদিক এবং ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের একজন পুরোধা। তার জন্ম ১৮৭২ সালের ১৫ আগস্ট পশ্চিম বাংলার হুগলিতে। ইংল্যান্ডের কিংস কলেজে পড়াশোনা শেষ করে ১৮৯৩ সালের দিকে দেশে ফিরে তিনি রাজনীতিতে যোগ দেন। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসেবে তিনি সেসময় সাপ্তাহিক 'বন্দে মাতরম' পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ডকে হত্যার চেষ্টায় ছোড়া বোমা হামলার মামলায় ক্ষুদিরাম বোস ও প্রফুল্ল চাকীদের সঙ্গে তিনিও গ্রেপ্তার হয়ে জেল খাটেন।
রাজনীতি থেকে অবসর নিয়ে তিনি ১৯১০ সালে পুদুচেরি চলে আসেন এবং পুরোপুরি নিজেকে যোগ চর্চায় মনোনিবেশ করেন। ১৯২৬ সালের দিকে তার মধ্যে আধ্যাত্মিক উপলব্ধি আসে এবং সব ধরনের বৈষয়িকতা থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে একজন সাধকের জীবনে প্রবেশ করেন। এর মধ্যে তার বেশ কয়েকজন ভাব-শিষ্যও জুটে যায়। তাদের যোগ ও আধ্যাত্মিকতা চর্চার স্থানটি পরিণত হয় একটি আশ্রমে। অরবিন্দর সাধনসঙ্গীদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একজন ছিলেন সাধক মিরা আলফাসা। সুদূর ফরাসি দেশের মিরা, যিনি পরবর্তীতে পরিচিত হয়ে ওঠেন 'মা' হিসেবে, তার হাতে অরবিন্দ আশ্রমের ভার পুরোপুরি সঁপে দেন। আশ্রমকেন্দ্রিক চর্চা আরও আগে থেকে শুরু হলেও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে ১৯২৬ সালের ২৪ নভেম্বর।
আশ্রমের বিভিন্ন জায়গায় অরবিন্দ ও মায়ের (মিরা) ছবি ও বাণী, তাদের লেখাপত্র, বই এবং স্মৃতিস্মারক। ধ্যানকক্ষে চলছে আধ্যাত্ম চর্চা আর আশ্রমজুড়ে আমাদের মতো উৎসুক ভ্রমণপিপাসুদের পায়চারি। বিস্তৃত বাতাবরণে অদৃশ্য এক শান্তিভাব বিরাজমান। যা চোখে দেখা যায় না কিন্তু অনুভব করা যায়, না দেখার চেয়েও কয়েক গুণ বেশি।
কাকতালীয়ভাবে আশ্রমে মিরার দেশেরই তরুণী ম্যাডেলিনের সঙ্গে দেখা। সে পেশায় একজন জুয়েলারি ডিজাইনার। ২০১৭ সালের ২০ অক্টোবর তার সঙ্গে আলাপ। এর মধ্যে এতোদিন কেটে যাওয়ায় তার নামের শেষের অংশটি ভুলে গেছি। ম্যাডেলিনের ভারতে আসার অন্যতম মূল কারণ 'অরোভিল' পরিদর্শন। গত দুই দিন সে সেখানেই ছিল, ওখান থেকে আশ্রমে। অরোভিল কী, জিজ্ঞেস করতেই সে হড়বড় করে ফ্রেঞ্চ অ্যাকসেন্ট মেশানো ইংরেজিতে বোঝানো শুরু করল, 'ওহ মাই গড! তোমরা এখনো সেখানে যাওনি! তোমাদের অবশ্যই অরোভিলে যাওয়া উচিত'।
জানা গেল, পুদুচেরি থেকে অরোভিল প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে। তখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা। আমাদের রাতেই ফিরে যাওয়ার পরিকল্পনা শুনে ম্যাডেলিন হাসিমুখে ক্ষেপে উঠলো, 'তোমরা কী পাগল, এতো কাছ থেকে অরোভিল না দেখে ফিরে যাবে! দেখো বাডি, আমি মনে করি, এটা না দেখে যাওয়া গ্রেট মিস!'।
এরপর সে নানাভাবেই বুঝিয়েছে। এক লাইনে সারাংশ করলে যা দাঁড়ায়, এটি একটি ইউনিভার্সাল টাউনশিপ বা সর্বজনীন জনপদ যেখানে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার মানুষের বসবাসের উপযোগী করে গড়ে তোলা হচ্ছে। বাকি ভ্রমণসঙ্গীরাও রাজি, আমরা আরও একদিন পুদুচেরি থাকছি। দেখে আসি ভোরের শহর অরোভিল (অরোভিল : দ্য সিটি অব ডন)।
পরদিন ভোরের আলো ফুটতেই অরোভিলের পথে। ভৌগলিক অবস্থানে এটি তামিলনাড়ু রাজ্যের ভিলুপুরাম জেলায় কিন্তু অল্প কিছু অংশ পুদুচেরিতেও পড়েছে। সমুদ্র উপকূল থেকে ৫ কিলোমিটার দূরের প্রায় ২০ বর্গ কিলোমিটারের এই অনুর্বর মরুভূমিসম অঞ্চল কীভাবে সুজলা-সুফলা প্রাণচঞ্চল হয়ে উঠলো, সেই বিস্ময় নিয়ে সকাল সকাল অরোভিলে হাজির।
সারাদিন অরোভিলে কাটানোর প্রস্তুতি নিতে নিতে প্রাসঙ্গিক কিছু তথ্য দিলে আশা করি পাঠক খুব বেশি বিরক্ত হবেন না! অরবিন্দ দেহত্যাগ করেন ১৯৫০ সালের ৫ ডিসেম্বর। অরোভিলের প্রতিষ্ঠাকাল ১৯৬৮ হলেও মিরা এর কাজ শুরু করে দেন আরও আগে থেকে। অরবিন্দর স্মৃতিতে, তার নামের 'অরো' অংশের সঙ্গে 'ভিল' (এলাকা/জনপদ) লাগিয়ে নাম দেন অরোভিল (Auroville)। শহর নিয়ে ১৯৬৫ সালে দেওয়া প্রথম পাবলিক মেসেজে তিনি বলেন, 'অরোভিল এমন একটি সর্বজনীন শহর হতে চায় যেখানে সমস্ত দেশের নারী-পুরুষ সমস্ত ধর্ম-রাজনীতি-জাতীয়তার ঊর্ধ্বে গিয়ে শান্তি-প্রগতি-সম্প্রীতিতে থাকতে পারবে। অরোভিলের উদ্দেশ্য হলো, মানব ঐক্য উপলব্ধি করা'।
হাইওয়ের ঠিক পাশেই অরোভিলের বড় গেট। গাড়ি সরাসরি চলে যায় ভিজিটর'স জোনে। প্রথমে বুঝতে পারিনি! ভিজিটর সেন্টারে সিটি ডায়াগ্রাম দেখে জানা গেল, ফরাসি স্থপতি রজার অ্যাঙ্গারের নকশায় বৃত্তাকার আকৃতির শহরটি ৬টি ভিন্ন ভিন্ন অংশে বিভক্ত। এর মধ্যে কেন্দ্রস্থলটি পিস এরিয়া বা শান্তিক্ষেত্র আর এর প্রায় পাশাপাশি পূর্বদিকে কালচারাল জোন (৯৩ হেক্টর)। বৃত্তের পরিধির দিকটা গ্রিন বেল্ট (৪০৫ হেক্টর) যা জৈব খামার ও বন্যপ্রাণীর জন্য বরাদ্দ। আমরা মূলত সবুজ শ্যামলিমা আর পাখ-পাখালি গুঞ্জরিত গ্রিন বেল্ট পেরিয়ে কালচারাল জোনে এসেছিলাম। গবেষণা, খেলাধুলা আর নানা সৃজনশীল কাজের সঙ্গে সঙ্গে এই জোনের খানিকটা অংশ আমাদের মতো দর্শনার্থীদের জন্য। ভিজিটর'স সেন্টারের পাশাপাশি রয়েছে লাইব্রেরি, পরিবেশবান্ধব হস্তশিল্পের দোকান, সৌর-হেঁশেলে (সোলার কিচেন) রান্না করা খাবারের রেস্তোরাঁ ও ক্যাফে প্রভৃতি। যেখানে যার আগ্রহ অনুযায়ী আট থেকে আশির ভিড়। ভ্রমণসঙ্গীরাও আর এক জায়গায় নেই, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে যে যার মতো ঘুরছে। আনমনে পায়চারির নানা মুহূর্তে কাউকে দেখা গেল হস্তশিল্প কেনায় ব্যস্ত, কেউবা গভীর মনোযোগে অরোভিলের বিভিন্ন কার্যক্রমের ভিডিও দেখছে। কারও দেখা মিললো ধোঁয়াওঠা কফির পেছনে। ক্যাফেতে সবচেয়ে বেশি ভিড় কিন্তু লাইব্রেরিতে ঠিক তার উল্টো।
অরোভিল প্রচারিত একটি ভিডিও থেকে তথ্য মিললো, ১৯৬৬ সালে ইউনেস্কো একটি সর্বসম্মত প্রস্তাব পাস করে অরোভিলকে মানবতার ভবিষ্যতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রকল্প হিসেবে উল্লেখ করে। প্রতিষ্ঠালগ্নে (১৯৬৮) ভারতের সমস্ত রাজ্যসহ বিশ্বের ১২৪টি দেশের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে এর উদ্বোধন করা হয়। প্রতিনিধিরা প্রত্যেকে তাদের দেশ থেকে কিছু মাটি নিয়ে এসেছিলেন। মাটির সঙ্গে সাদা মার্বেল মিশিয়ে সার্বজনীন সম্প্রীতির প্রতীক হিসেবে পদ্ম-আকৃতির একটি কলস বানানো হয়, যা এখন অ্যাম্ফিথিয়েটারের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থিত।
ডায়াগ্রাম অনুযায়ী, আশেপাশের ইন্টারন্যাশনাল (৭৪ হেক্টর), ইন্ডাস্ট্রিয়াল (১০৯ হেক্টর) ও রেসিডেন্সিয়াল (১৮৯ হেক্টর) জোনগুলো ঘুরে দেখার চেষ্টায় জানলাম, সাধারণ দর্শনার্থীদের সেদিকে যাওয়ার অনুমতি নেই। তাদের গেস্ট হাউসগুলোতে থাকলে অবশ্য সুযোগ মেলে। কী আর করা! দূর থেকে ছবি তুলে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর ইচ্ছাতেও দেখি জ্বালা! গলায় ক্যামেরা ঝোলানো দেখে আগেভাগেই নিরাপত্তা কর্মী দৌড়ে আসে, 'স্যার, ছবি তোলার অনুমতি নেই'। কিন্তু অজানা-অচেনা কাউকে ছবি তুলে দেওয়ার অনুরোধ ঠিকই আসে। ছবি তোলার পর কিছুক্ষণ খুঁটিয়ে দেখে বলে, 'প্লিজ, আরেকটা'।
ঘুরতে-ফিরতে বেলা গড়ায়। মধ্যগগন সূর্যের তেজে লালমাটি আরও লাল হয়ে উঠে। চারদিকে গাছ-গাছালির অভাব নেই। ঘন ছায়া দেখে বসে পড়ি। সদ্য মাতৃমন্দির দেখে আসা এক দলের সঙ্গে দেখা হয়। সবার চোখে-মুখে উদ্দীপনা ও উচ্ছ্বাস। এর মধ্যে আমাদের দলেরই একজন হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে। মাতৃমন্দির দর্শনের সময় সকাল ১০টা থেকে ১২টা, মাঝখানে ২ ঘণ্টা বিরতি দিয়ে আবার দুপুর ২টা থেকে বিকেল ৪টা। তার এতো উত্তেজিত হওয়ার কারণ হলো, মন্দিরের ভেতরে ধ্যান করা যায় বলে কারও কাছ থেকে শুনেছে। সে আবার যোগ চর্চা করে। তার খুব ইচ্ছা, মাতৃমন্দিরেও ধ্যান করবে। কিন্তু হেল্প ডেস্কে গিয়ে নিরাশ হতে হলো। মন্দিরের ভেতরের আসন সংখ্যা সীমিত, কমপক্ষে ২-৩ দিন আগে থেকে জানাতে হয়। অগত্যা, সৌর-হেঁশেলের সুস্বাদু ভেজ-থালি খাইয়ে তার দুঃখ খানিকটা উপশমের চেষ্টা করা হলো।
দুপুর ২টা বাজতেই টোকেন নিয়ে মন্দিরের পথে। ঢিমেতালে চললেও বড়জোর আধঘণ্টার পথ। বেশ খানিকটা পথ বোধ হয় গ্রিন বেল্টের মধ্য দিয়েও গেছে। পায়ের তলে বিছানো লালমাটি, দুধারে হাত বাড়ালেই হরেক পত্র-পল্লব আর বাহারি ফুল। মাথার উপরে শারদীয় নীলাভ আকাশ। মন পেজা তুলোর মতো মেঘের সঙ্গে নেচে উঠে। বয়সী বটবৃক্ষের শাখার আড়াল থেকে রোদের লুকোচুরি। পাখিদের কিচিরমিচির আর পথচারীদের আলাপচারিতা বাদ দিলে গোটা পরিবেশজুড়ে সুনসান নিস্তব্ধতা। হাঁটতে হাঁটতে প্রকৃতিতে মিশে যাই। নিজের অজান্তেই মনের মধ্যে অদ্ভুত আনন্দ খেলা করে, যেন জেগে ওঠে অনন্ত!
দূর থেকে বড় সোনার গোলকরূপী মাতৃমন্দিরকে দেখা যায়। ধ্যানের জন্য নির্বাচিত বা অরোভিলের বাসিন্দা না হলে কাছে যাওয়ার উপায় নেই। মন্দিরকে অরোভিলের আত্মা হিসেবে বিবেচনা করা হয় বলে তাকে স্থান দেওয়া হয়েছে শহরের একদম কেন্দ্রে, যা পৃথিবী থেকে উঠে আসা নতুন একটি চেতনার জন্মের প্রতীক। মাতৃমন্দিরের নকশা ও ভেতরের পরিবেশ এমনভাবে তৈরি যেন একজন ব্যক্তি ধ্যান ও নীরবতার মাধ্যমে তার চেতনার খোঁজ করতে পারে।
বিকেল ৪টার মধ্যেই মন্দিরসংলগ্ন অঞ্চল ছেড়ে যেতে হবে। আমাদেরও ফেরার সময় ঘনিয়ে আসে। প্রাসঙ্গিক নানান ভাবনা-চিন্তা মাথায় আসে। মানবসৃষ্ট কোনোকিছুই ত্রুটিমুক্ত নয়। খুঁজলে অরোভিলেও হয়তো মিলবে। সব ধরনের বৈষম্যের ঊর্ধ্বে গিয়ে সত্যিই এমন মানব সমাজ সম্ভব? সম্ভব-অসম্ভব নিয়ে তর্ক চলতে পারে কিন্তু আমাদের সবারই যে এমন সমাজ কাম্য—এ নিয়ে আশা করি কারো দ্বিমত নেই। অরোভিল তাই পুরো ব্যবস্থাটিকে একটি পরীক্ষামূলক প্রকল্প হিসেবে দেখছে। সম্পূর্ণ প্রকৃতিবান্ধব ও টেকসই জীবনযাপনের প্রচেষ্টার পাশাপাশি মানবজাতির ভবিষ্যৎ সাংস্কৃতিক, পরিবেশগত, সামাজিক এবং আধ্যাত্মিক চাহিদা কেমন হতে পারে বা উচিত তা নিয়ে গবেষণাও চালিয়ে যাচ্ছে তারা। ভেদাভেদমুক্ত একটি জনপদের স্বপ্ন নিয়ে শুরু হওয়া অরোভিলে এখন ৫৯ দেশের প্রায় ২ হাজার ৫০০ বিভিন্ন বর্ণ-গোত্র-শ্রেণি-পেশার মানুষের বাস।
অরোভিলে ঘোরার পাশাপাশি রয়েছে স্বেচ্ছাসেবী ও শিক্ষানবিস হয়ে কাজ করা এবং পড়াশোনার সুযোগ। তাদের ওয়ার্কশপ ও থেরাপিগুলোতে যোগ দেওয়ার সুযোগ আছে। পরিবেশবান্ধব পণ্যগুলো কেনা বা সরাসরি অনুদান দেওয়া যায়। কিংবা নিজেই একজন 'অরোভিলিয়ান' বা অরোভিলের স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে থাকতে পারেন সেখানে। এ ছাড়া, রয়েছে নানা কার্যক্রম।
সৃষ্টিলগ্ন থেকেই যোগ ও শান্তির শহর হিসেবে অরোভিলকে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা চলছে। তাদের দর্শন ও কার্যক্রমের মাধ্যমে মানবতা ও ঐক্যের আবহ ছড়িয়ে দিতে চায় তারা, যা এই হিংসা-হানাহানিময় বিশ্বে বড় প্রয়োজন। জন লেননের ইমাজিন গানের দুটো লাইন দিয়ে শেষ করা যাক, 'আই হোপ সামডে ইউ উইল জয়েন আস অ্যান্ড দ্য ওয়ার্ড উইল লিভ অ্যাজ ওয়ান…'।
Comments