ভাসমান শহরই কি আমাদের ভবিষ্যৎ
![](https://tds-images-bn.thedailystar.net/sites/default/files/styles/big_202/public/images/2021/11/18/03-big-sfc-oceanixcity-top-image-by-big-bjarke-ingels-group-1.jpg?itok=9teNOM4N×tamp=1637217014)
দীর্ঘদিন ধরে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিকে একটি বড় আকারের জলবায়ু বিপর্যয় হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে গেলে অনেক দেশের নিম্নাঞ্চল পানিতে ডুবে যাওয়ার আশংকা রয়েছে।
এই সমস্যার দীর্ঘমেয়াদি সমাধান হিসেবে পানিতে আংশিক নিমজ্জিত বা ভাসমান আবাসস্থল আলোচনায় রয়েছে অনেক দিন ধরেই।
বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী মনে হলেও এমন একটি জনবসতির দেখা পাওয়া যায় নেদারল্যান্ডের রাজধানী আমস্টারডামের ওয়াটারবুর্টে। একে বলা হয় 'ভাসমান মহল্লা'। একটি প্রশস্ত সাদা জেটি এই মহল্লার সীমানা নির্ধারণ করেছে।
রাজধানীর পূর্ব প্রান্তে একটি ছোট হ্রদের ওপর নির্মিত ৩ তলা বাড়ির বাসিন্দাদের বিকেল বেলায় মাছ ধরে কিংবা পানিতে ডুব দিয়ে সময় কাটাতে দেখা যায়। হ্রদের প্রশস্ত, সাদা রঙের জেটির রেলিংয়ের পাশে কিছু বেঞ্চ, বাইসাইকেল ও বারবিকিউ করার চুলা সাজিয়ে রাখা আছে। ১০ মিটার পর পর একটি করে কমলা রঙের নিরাপত্তা বেষ্টনী বসানো আছে।
মন্টেফ্লোর নামের একটি প্রতিষ্ঠান এই পানিতে নিমজ্জিত বাসস্থান প্রকল্পের পেছনে কাজ করেছে। প্রায় ১০০টি ভাসমান বাড়ির সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে এই প্রকল্প।
পরিবেশের বিষয় বিবেচনা এবং নির্মাণকাজের ক্ষেত্রে উদ্ভাবনী নকশা ব্যবহারে নেদারল্যান্ডের সুখ্যাতি রয়েছে। এসব কারণে ভাসমান শহরের মতো পরীক্ষামূলক প্রকল্পের জন্য রাজধানী আমস্টারডাম সব দিক দিয়েই উপযুক্ত। এ ছাড়াও ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে নেদারল্যান্ডের উচ্চতা সবচেয়ে কম এবং বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়লে দেশটি ডুবে যাওয়ার ঝুঁকিতে আছে।
শুধুমাত্র ভাসমান শহরই নেদারল্যান্ডের একমাত্র পরীক্ষামূলক প্রকল্প নয়।
আমস্টারডাম থেকে ৫৫ কিলোমিটার দক্ষিণে রয়েছে একটি অত্যাধুনিক খামার। সেখানে দেখা যায় একজন খামারি পায়ে চলার পথ বা গ্যাংওয়ে দিয়ে আস্তাবলের দিকে বেশ কিছু গরুকে হাঁটিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। রটারড্যাম সংলগ্ন ঘাটে বড় বড় ট্যাংকার ও মালবাহী জাহাজের পাশ দিয়ে কৃত্রিমভাবে তৈরি করা এই পথটি পানিতে ভাসমান আস্তাবল পর্যন্ত পৌঁছেছে।
ডাচ খামারি গরুকে মুঠোভর্তি খড় খাওয়াতে খাওয়াতে বিবিসিকে জানান, যেদিন রাতে গরুগুলো প্রথমবারের মতো সেখানে এসেছিল, বিভিন্ন রকমের দুশ্চিন্তায় সে রাতে তার এক ফোঁটা ঘুমও হয়নি। তবে সব কিছুই পরিকল্পনা অনুযায়ী এগিয়েছে এবং সমুদ্র বেষ্টিত পরিবেশের সঙ্গে গরুগুলো খুব সহজেই খাপ খাইতে নিতে পেরেছে।
ভাসমান খামার তৈরির চিন্তার পেছনে অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে নিউইয়র্কে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড় স্যান্ডি। খামারি ভ্যান উইংগারডেন এবং তার সঙ্গী পিটার এই পরিকল্পনার রূপকার।
২০১২ সালে স্যান্ডি আঘাত হানার পর নিউইয়র্কের পরিবহন ব্যবস্থা ও খাদ্য সরবরাহ চরমভাবে বিঘ্নিত হয়েছিল এবং ম্যানহাটন শহরের দোকানগুলোতে সপ্তাহের পর সপ্তাহ পণ্যের সরবরাহ বন্ধ ছিল। সেসময় ডাচ নাগরিক পিটার সিদ্ধান্ত নেন একটি জলবায়ু সহনশীল খামার তৈরি করবেন। নেদারল্যান্ডে ফিরে তিনি এবং তার পার্টনার ভ্যান উইংগারডেন এই ভাসমান খামার নির্মাণের কাজে হাত দেন।
২০১৯ সালে এই অত্যাধুনিক খামারের কার্যক্রম শুরু হয়। এখন সেখানে ৪০টি গরু রয়েছে। গরুগুলোর বিচরণক্ষেত্র হিসেবে জেটির পাশে আছে একটি প্রাকৃতিক তৃণভূমি এবং ভাসমান খামার। এই ২ জায়গায় যাওয়া আসার জন্য তারা একটি মই সদৃশ গ্যাংওয়ে ব্যবহার করে।
বিশ্বে এটাই প্রথম ভাসমান খামার। এই খামার থেকে খাদ্য সামগ্রী হিসেবে দুধ, পনির এবং দই উৎপাদন হয়। এ ছাড়াও এখান থেকে পাওয়া প্রচুর পরিমাণ গোবর জ্বালানি উৎপাদনে ব্যবহার করা যায়। পণ্যগুলো মোটরবাইক অথবা বৈদ্যুতিক ভ্যানের মাধ্যমে স্বল্প দূরত্ব পাড়ি দিয়ে ভোক্তার কাছে পৌঁছায়। শহর থেকে আসা জৈব বর্জ্যকে রিসাইকেল করে গরুর খাবারের ব্যবস্থা করা হয়। এই জৈব বর্জ্যের মধ্যে আছে রেস্তোরাঁর বেঁচে যাওয়া খাবার থেকে শুরু করে স্থানীয় ফুটবল দল ফেয়েন্যুর্ডের নিজস্ব স্টেডিয়ামের মাঠের উদ্বৃত্ত ঘাস পর্যন্ত অনেক কিছু।
ভ্যান উইংগারডেন জানান, ভবিষ্যতে ভাসমান সবজীর ক্ষেত ও মুরগীর খামার তৈরির পরিকল্পনাও তার আছে। তিনি বলেন, 'আমার মতে ভাসমান খামারের জন্য উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে।'
নেদারল্যান্ডের মানুষ ভাসমান বাড়িতে সাফল্যের সঙ্গে বসবাস করছে এবং পানির ওপর খামারও তৈরি করেছে। পরবর্তী প্রশ্ন হচ্ছে, ভাসমান শহর কবে তৈরি করা সম্ভব হবে?
![](https://tds-images-bn.thedailystar.net/sites/default/files/styles/big_202/public/images/2021/11/18/1500x500.jpg?itok=BX23dZ8w×tamp=1637217122)
বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জাতিসংঘের সহায়তায় মার্কিন প্রতিষ্ঠান ওশ্যানিক্স এ ধরণের কিছু উদ্যোগে নেতৃত্ব দিচ্ছে। তারা মানুষের বসবাসযোগ্য, বড় আকারের ভাসমান আবাস নির্মাণ করছে। তারা ৭৫ হেক্টর জায়গায় ১০ হাজার মানুষের জন্য পৃথিবীর প্রথম সহনশীল ও টেকসই ভাসমান বাসস্থান নির্মাণ করবেন বলে জানিয়েছেন।
ওশ্যানিক্সের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মার্ক কলিন্স চেন জানান, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির সমস্যা মোকাবিলায় সমুদ্র তীরের কাছাকাছি অবস্থিত শহরগুলোর হাতে ২টি বিকল্প আছে। প্রথমটি হচ্ছে সমুদ্রের তীরে বড় একটি দেওয়াল বানানো, যা প্রকৃতপক্ষে কোনো কার্যকর সমাধান নয়। জলোচ্ছ্বাস ঠেকানোর মতো উঁচু দেওয়াল কখনোই তৈরি করা সম্ভব নয়। দ্বিতীয় এবং একমাত্র উপযোগী সমাধান হচ্ছে পানিতে ভেসে থাকতে পারে এমন বাসস্থান নির্মাণ।
'ভাসমান শহর' বলা হলেও ওশ্যানিক্সের প্রারম্ভিক পরিকল্পনায় শহর নয়, বরং বড় আকারের ভাসমান 'জেলা' রয়েছে। জাকার্তা ও সাংহাইয়ের মতো বড় বড় শহর, যেগুলো ইতোমধ্যে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে সমস্যায় পড়তে যাচ্ছে, সেসব শহরেরই বর্ধিতাংশ হতে পারে এই ভাসমান জেলাগুলো। এই নতুন শহরগুলো নির্মাণ করা হবে ২ হেক্টর প্রশস্ত, ভেসে থাকতে সক্ষম ত্রিভুজাকৃতির জমির ওপর, যেখানে ৩০০ মানুষ স্বাচ্ছন্দ্যে বসবাস করতে পারবেন। থাকার জায়গার পাশাপাশি চাষাবাদ ও বিনোদন কার্যক্রমের জন্য আলাদা জায়গা থাকবে। একাধিক ত্রিভুজকে একসঙ্গে জুড়ে দিয়ে ছোটখাটো গ্রাম বা মহল্লা তৈরি করা যেতে পারে।
চেন আরও জানান, ওশ্যানিক্সের পরিকল্পনা হচ্ছে বৈরি আবহাওয়ায় সহনশীল অবকাঠামো তৈরি করা। পরিকল্পনা অনুযায়ী, এই বাসস্থানগুলোতে জীবাশ্মভিত্তিক জ্বালানির ব্যবহার হবে না। সব কাজ চলবে নবায়নযোগ্য জ্বালানির মাধ্যমে। এ ছাড়াও, ভাসমান শহরগুলোতে প্রোটিনের সম্পূর্ণ চাহিদা আভ্যন্তরীণ ভাবে মেটানোরও পরিকল্পনা করছে প্রতিষ্ঠানটি।
বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর মতো এসব পরিকল্পনা শুনতে বেশ চমকপ্রদ হলেও, বাস্তবে আমাদের জীবদ্দশায় এ ধরণের শহর কি আদৌ গড়ে উঠবে?
এ প্রশ্নের উত্তরে চেন জানান, ভাসমান শহরের ধারণা ইতোমধ্যে সীমিত আকারে বাস্তবায়িত হয়েছে এবং আগামী কয়েক বছরের মধ্যে আমরা প্রোটোটাইপ শহর দেখতে পাবো।
মজার ব্যাপার হলো, ভাসমান শহরের ধারণাটি বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর পাতা থেকে উঠে এসেছে বলে মনে হলেও বাস্তবে কয়েক শতাব্দী আগে থেকেই মানুষ এ ধরণের বাসস্থানে বসবাস করে আসছে।
ণৃ-গোষ্ঠীর সংস্কৃতি নিয়ে লেখা একটি বইয়ে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক জুলিয়া ওয়াটসন বিভিন্ন ণৃ-গোষ্ঠীর কমপক্ষে ৬৪টি ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন। যেখানে দেখা গেছে প্রাচীন আমলের মানুষও ভাসমান বাসস্থান তৈরি করেছিলেন, যেগুলো টেকসই ও জলবায়ু সহনশীল ছিল।
এখনো কিছু ক্ষুদ্র ণৃ-গোষ্ঠী এ ধরণের বাসস্থানে থাকেন। যেমন বলিভিয়া ও পেরুর সীমান্তে টিটিকাকা হ্রদের ওপর উরু জাতির বানানো নলখাগড়ার দ্বীপ।
আমস্টারডামের ওয়াটারবুর্টের ভাসমান মানব সম্প্রদায়ের সফল ও সুখী জীবন পর্যালোচনা করে বলা যায়, পৃথিবীর যেকোনো দেশেই ভাসমান শহর তৈরি করা সম্ভব। বিশেষ করে যেসব শহর নদী বা সমুদ্রের তীরে অবস্থিত, সে শহরগুলোকে খুব সহজেই সম্প্রসারিত করে ভাসমান শহরে রূপান্তর করা যায়।
তবে ভাসমান শহর বৈশ্বিক জলবায়ু সংকটের স্থায়ী সমাধান নয়। এর মাধ্যমে হয়তো একটি সাময়িক সমাধানে পৌঁছানো যাবে, তবে দীর্ঘ মেয়াদে পরিবেশ দূষণ, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিসহ অন্যান্য জলবায়ু সমস্যার সমাধানে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
Comments