ব্লু হরনেটের মনসুর: বিস্মৃত এক সংগীতশিল্পী

মনসুর হাসান। ছবি: স্টার

আশির দশকের জনপ্রিয় গান 'বাটালি হিলের সেই বিকেল', 'ছোট্ট একটি মেয়ে', ও 'সারাটি রাত'-এর মতো বেশ কিছু গানের গীতিকার, সুরকার ও গায়ক ছিলেন মনসুর হাসান। তখন তার বয়স ছিল মাত্র ১৬ বছর। ১৮ হওয়ার আগেই ১৯৯০ সালে নিজের সুর করা ও এলআরবির আইয়ুব বাচ্চুর কম্পোজে বের হয় তার একক অ্যালবাম। অ্যালবামটির প্রায় সবগুলো গানই শ্রোতাদের মন জয় করে। বাহবা পান তখনকার অনেক প্রতিষ্ঠিত শিল্পীদের কাছ থেকে।

আশির দশকের জনপ্রিয় এই ব্যান্ড তারকা এবং 'ব্লু হরনেট' ব্যান্ডের অন্যতম সদস্য ৫২ বছর বয়সী মনসুর হাসান এখন চট্টগ্রামের জামাল খান এলাকার একটি গণশৌচাগারের তত্ত্বাবধায়ক। গত ৫ বছর ধরে শৌচাগারের পাশের একটি বেঞ্চে থাকছেন তিনি। বেতন পান মাত্র ৯ হাজার টাকা। 

১৯৮৭ সালের শেষের দিকে দল গঠন করার পর ১৯৮৯ সালের মাঝামাঝিতে বাজারে আসে 'ব্লু হরনেট'-এর প্রথম অ্যালবাম। এ অ্যালবামে ১৪টি গানই তখন ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। যার মধ্যে ৩টি গান গেয়েছিলেন মনসুর। তার এক বছর পর ১৯৯০ সালে তার একক অ্যালবাম 'জুয়েল স্বরণে' ১৪টি গানের সবগুলো গানই মৌলিক হওয়ায় সারা দেশে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পান মনসুর। একক অ্যালবামে সেই সময় শ্রোতাদের কাছে জনপ্রিয়তা পাওয়া মনসুরের গানগুলো ছিল, 'ফিরে এসো', 'নিঝুম রাত', 'নীল কাগজে লেখা', 'মনটা তার চোরাবালি', 'চল যাই', 'বাতাসি' ও 'সবাই যখন ঘুমে' ইত্যাদি। 

অবশ্য এসব গানের কোনো কিছুই সংগ্রহে নেই মনসুরের। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত মনসুর ঠিকভাবে মনেও করতে পারছিলেন না তখনকার সোনালি অতীতের স্মৃতি। 

১৯৯১ সালের পর ব্যান্ড দলটির সদস্যরা যে যার মতো ব্যস্ত হয়ে পড়েন। মনসুরও হারিয়ে যান নেশার জগতে। মূলত ৯১-এর ঘূর্ণিঝড়ের কারণে দলটির প্রায় ২০ লাখ টাকার বিভিন্ন যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে যায়। যা তখন তারা আর কিনতে পারেননি। দল ভেঙে যাওয়া এটিই অন্যতম কারণ বলে জানান এক সময়ে জনপ্রিয় ব্যান্ড দলটির সদস্যরা।
  
গত ২২ মে মনসুরের সঙ্গে কথা হয় দ্য ডেইলি স্টারের এ প্রতিবেদকের। জামালখান মোড়ের একটি গণশৌচাগারের পাশের বেঞ্চে বসে ছিলেন। বেঞ্চের পাশেই রাখা কাঁথা-বালিশ। রাতে সেখানেই থাকেন বলে জানান মনসুর। চট্টগ্রামে রহমতগঞ্জের সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান হলেও বাড়িতে এখন তার জায়গা হয় না।  

মনসুন জানান, বাবা-মা মারা যাওয়ার পর আর বাসায় ফিরতে পারছেন না। চাচা ও চাচাতো ভাইয়েরা সম্পত্তি দখল করে রেখেছেন। এ নিয়ে মামলাও চলছে। তবে মামলার বিস্তারিত কিছুই বলতে পারেননি তিনি।  

মানসিকভাবে বিপর্যস্ত মনসুর কথা বলার সময় খেয় হারিয়ে ফেলছিলেন বারবার। অতীতের কিছু স্মৃতি উল্লেখ করলেও সময় বলতে পারছিলেন না। কলেজে পড়ার সময় কয়েক জন সিনিয়র বড় ভাইদের নিয়ে ব্যান্ড দল করেছিলেন বলে জানান। তারা এখন কে কোথায় আছেন সেটাও জানেন না। কারও সঙ্গেই কোনো যোগাযোগ নেই।
 
৮০-র দশকের কিছু জনপ্রিয় গানের কথা বলতেই তিনি বলেন, 'এগুলোতে আমার গান। তখন গলা ভালো ছিল। গিটারও বাজাতে পারতাম। এখন সব ভুলে গেছি।' 

কয়েকটি লাইন গেয়ে শুনাতে বললে তিনি চোখ বন্ধ করে কিছুটা সময় নেন। তারপর হাতে গিটার বাজানোর মতো করে কিছুটা সময় গানও করেন। তবে গানের কথা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল না। মাঝে মধ্যে গানের কথা থেকে সরে যাচ্ছিলেন। তবে সুর ছিল সেই আগের মতোই মায়াবী। 

মনসুন জানান, সারাদিন সেখানেই থাকেন। পাশের একটি হোটেল থেকে খাবার খান। রাতে এ বেঞ্চেই ঘুমান। 

মনসুরের জীবনে বদলে গেছে প্রায় সবকিছুই। তখনকার সময়ের কিছু ছবি পাওয়া যায় ব্লু হারনেট-এর ফেসবুক পেজে। এখন শরীর কিছুটা মুটিয়ে গেলেও ছবিতে লিকলিকে শরীরের মনসুরকে দেখা যায়। ব্লু হরনেট-এর অন্যান্য সদস্য থেকে আলাদা করে চেনা যাবে তার গায়কি ভঙ্গি ও হাসিমাখা মুখ দেখে। জীবনের সবকিছু বদলে গেলেও তার সেই হাসি একটুও বদলাইনি। 

এ প্রতিবেদকের কথা হয়েছে ব্লু হরনেটের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য সেলিম জাহানের সঙ্গে। তিনি বলেন, 'ব্লু হরনেট গঠন করা হয় ১৯৮৭ সালের মাঝামাঝিতে। মনসুরের বয়স তখন ১৫ কি ১৬ হবে। দলের ৭ জন সদস্যের মধ্যে মনসুর ছিল সবার ছোট। আমার চেয়ে ৭-৮ বছরের ছোট হওয়ায় তাকে ছোট ভাইয়ের মতোই দেখতাম। তার বাসাতে তখন আমার নিয়মিত যাতায়াত ছিল। খুবই সম্ভ্রান্ত ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন পরিবার ছিল তাদের। ৩ ভাইয়ের মধ্যে মনসুর ছিল দ্বিতীয়।' 

সেলিম জাহান বলেন, 'মনসুরকে দলে নেওয়ার অন্যতম কারণ ছিল তার গানের গলা। অসাধারণ কণ্ঠ ছিল তার। ওই বয়সে নিজে গান লিখতো, সুর করতো। ১৯৮৯ সালে আমরা প্রথম অ্যালবাম বের করি। অ্যালবাম বের করার কিছুদিন পরেই বিভিটিতে 'বাটালি হিলের সেই বিকেল' গানটি গায় মনসুর। বিটিভিতে গানটি প্রচার হওয়ার পর থেকে শ্রেতাদের কাছে ব্যাপক সাড়া পেতে থাকি।'
 
'কিছুদিন পর সারগাম মিউজিক স্টুডিওর বাদল ভাই মনসুরকে নিয়ে একটি একক অ্যালবাম বের করেন। ওই অ্যালবামের ১৪টি গানই ছিল অসাধারণ। গত কয়েক বছর ধরে অনেক চেষ্টা করেও অ্যালবামটির কোনো গান উদ্ধার করতে পারিনি। এসব গান মনসুরও সংগ্রহে রাখেনি আবার সারগামও বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে গানগুলো কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না।'

তিনি আরও বলেন, '১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ের পর আমাদের দলটা ভেঙে যায়। তখনকার সময় প্রায় ২০ লাখ টাকা খরচ করে বিদেশ থেকে অনেক সরঞ্জাম এনেছিলাম। যা দিয়ে সারা দেশে কনসার্ট করতাম। কিন্তু ঘূর্ণিঝড়ের কারণে এসব নষ্ট হয়ে যায়। পরে যে যার মতো ব্যবসা ও চাকারিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ৩-৪ বছর পর সবাই মিলে আবার গান শুরু করলেও মনসুরকে পাওয়া যায়নি। তখন অনেক চেষ্টা করেও তাকে গানে ফেরাতে পারিনি।'

 

Comments

The Daily Star  | English
Proper audits can ensure social compliance in the RMG industry

US top remittance source in Nov, Dhaka top recipient

The biggest source of all the remittance received by Bangladesh last November was the US, according to the latest report of Bangladesh Bank (BB)..Moreover, Dhaka secured the lion’s share of the foreign currencies..Bangladeshi migrants sent home $2,199.99 million in November. Of it, $

2h ago