'ঠিকানা শুধু এক সমাধি, সাড়ে তিন হাত মাটি’

আইয়ুব বাচ্চু। ছবি: শাহরিয়ার কবির হিমেল/স্টার

১৯৯৮ সালে বাংলাদেশের ব্যান্ড সঙ্গীতের শ্রোতাদের জন্য ঈদ উপহার হিসেবে এলআরবি নিয়ে আসে ডাবল অ্যালবাম 'আমাদের-বিস্ময়'।  এই অ্যালবামের যে গানটি সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা পায় সেটি হচ্ছে 'সাড়ে তিন হাত মাটি'।

বাপ্পী খানের কথায় গানটির সুর ও কণ্ঠ দিয়েছেন আইয়ুব বাচ্চু। বাংলাদেশের ব্যান্ড সংগীতের অবিসংবাদিত প্রাণপুরুষ 'বাচ্চু ভাইয়ের' ষষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকী আজ শুক্রবার।

গানের শুরুর কথাগুলো ছিল এরকম: 

'টাকা-কড়ি ধন-সম্পত্তি অনেক অনেক বাড়ি-গাড়ি

ঠিকানার ছড়াছড়ি আমি তুমি বাড়াবাড়ি

মরলে সঙ্গে যাবে না কোনো কিছু তোমার অংশীদারি

ঠিকানা শুধু এক সমাধি...সাড়ে তিন হাত মাটি।'

দিনটি উপলক্ষ্যে 'সাড়ে তিন হাত মাটি' গানের জন্মকথা নিয়ে দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে আলাপ করেছেন গীতিকার বাপ্পী খান

এলআরবি ও আইয়ুব বাচ্চুর অন্তত ১০০ গানের গীতিকার বাপ্পী তার লেখা নিয়ে যথেষ্ট ভাবতেন এবং রীতিমতো গবেষণা করতেন। আর তাতে উৎসাহ জোগাতেন 'বস' আইয়ুব বাচ্চু।

বাপ্পী খান বলেন, 'সাধারণত লিরিকস নিয়ে গবেষণার কাজটা খুব উৎসাহের সঙ্গে করতাম। বাজারে কী গান চলছে, কী গান করলে নতুনত্ব আসবে, নিছক গানের জন্য না করে সামাজিক বার্তা দেওয়া যেতে পারে, এসব নিয়ে ভাবতাম। আবার আমাদের কোন গান মানুষ পছন্দ করছে, কেন করছে বা কোন গান অনেক যত্ন নিয়ে করার পরেও মানুষ পছন্দ করছে না এসব।'

'এগুলো আমার আর আইয়ুব বাচ্চুর ব্যক্তিগত আলাপ-আলোচনায় থাকত। ব্যান্ডের সবার সামনে এসব নিয়ে আলাপ করতাম না। তবে এস আই টুটুল আমাদের সঙ্গে থাকত, মতামত দিত।'

আইয়ুব বাচ্চু ও বাপ্পী খান। ছবি: বাপ্পী খানের সৌজন্যে

হঠাৎ বাচ্চু ভাই একদিন বললেন চল একটা এক্সপেরিমেন্ট করি। এমন একটা গান লেখ, যেটা একজন রিকশাওয়ালাকেও যেমন ছুঁয়ে যাবে, একজন বিদগ্ধ পণ্ডিত বা পিএইচডি করা কাউকেও একইভাবে স্পর্শ করবে। কথা যেন চটুলও না হয়, আবার দাঁত-ভাঙ্গা না হয়,' বলেন বাপ্পী খান।

শুরু হয়ে গেল ভাবনা, 'বসের' অ্যাসাইনমেন্ট, গীতিকার বাপ্পী খানের চিন্তার জগত তোলপাড়। সপ্তাহখানেক ধরেও এমন কিছু বের হলো না যা সন্তুষ্ট করতে পারে কিংবদন্তি আইয়ুব বাচ্চুকে।

'এর মধ্যে একরাতে আইয়ুব বাচ্চুর গাড়িতে উত্তরা যাচ্ছি। এস আই টুটুল সামনে, আমি পেছনে। বললাম, বস টপিকতো পাচ্ছি না। জিজ্ঞাসা করলেন এ পর্যন্ত কী ভাবলাম। আমি বললাম 'মৃত্যু'। কিন্তু সব ধর্মের ইমোশন তো এক না, তাই মেলাতে পারছিলাম না,' বলছিলেন বাপ্পী খান।

আইয়ুব বাচ্চু: তাহলে কী চাস? দেখিস দাঙ্গা-টাঙ্গা যেন না লাগে। টাইটেল কী করবি?

বাপ্পী খান: সাড়ে তিন হাত মাটি।

আইয়ুব বাচ্চু: (খুশি হয়ে) ওকে।

রাতে লিখতে বসে গেলেন বাপ্পী। পরদিন দেখালেন আইয়ুব বাচ্চুকে। তিনি খুশি হলেন লিরিকস পেয়ে। কয়েকদিনের মধ্যে রেকর্ডিংও শেষ। টেলিভিশনে একটা অনুষ্ঠানের জন্য গানটার শুটিংও হলো।

'যেদিন টিভিতে টেলিকাস্ট হবে সেদিন বাচ্চু ভাই, টুটুল আর আমি আমার বাসায়। বস বললেন, দাদাকে ডেকে আন, গানটা শোনাই। আমার দাদাকে বাচ্চু ভাই অনেক শ্রদ্ধা করতেন। দাদাকে ডাকলাম। আমরা চারজন একসঙ্গে দেখলাম। শেষে দাদা বললেন, "বাচ্চু যা-ই বলো পাগলা (দাদা আমাকে আদর করে ডাকতেন) কিন্তু ভালোই লিখছে।" বস খুশি, একজন আশি বছর বয়স্ক মানুষ গানটা পছন্দ করেছে। এক্সপেরিমেন্ট কাজ করেছে। এ ঘটনার দুই-তিন সপ্তাহের মাথায় আমার দাদা মারা যান।'

'এই গানটা আমার দাদাকেই (আব্দুস সোবহান খান) উৎসর্গ করেছিলাম,' বলেন বাপ্পী।

এর প্রায় ২০ বছর পর ২০১৮ সালের আগস্টে বাপ্পী খানের বাবা মারা যান। তার দুই মাস পর ১৮ অক্টোবর মারা যান বাংলাদেশের অন্যতম সেরা গিটারিস্ট আইয়ুব বাচ্চু।

বাপ্পী খান বলেন, 'আব্বার জানাজার দিনই আইয়ুব বাচ্চুর সঙ্গে আমার শেষ দেখা। লাশের সামনে দাড়িয়ে বস বলছিলেন, "খালু আপনি যান, আমরাও আসছি।" তারপর আমার বড় ভাইকে ধরে খুব কাঁদলেন। শেষ কথা আমাকে বলেছিলেন, ভাইয়ে ভাইয়ে যুদ্ধ করবি না। নিজের লেখা গানের কথা নিজে ভুলে যাবি না।'

'ওই দেখাটাই ছিল আইয়ুব বাচ্চুর সঙ্গে আমার শেষ দেখা', জানান বাপ্পী খান। 

Comments

The Daily Star  | English
shop owner killed in BNP party office

Landlord beaten to death in N'ganj BNP office over rent

Altercation over Ward BNP party office's rent payment at Salmodi Bazar in Araihazar, say police

3h ago