‘হয়তো কোথাও পাবে আমাকে’

আইয়ুব বাচ্চু। ছবি: সংগৃহীত

বাংলা রক সঙ্গীতের অনন্য কিংবদন্তী আইয়ুব বাচ্চু। বাংলা গানের সব পর্যায়ের শ্রোতাদের মাঝে সবচেয়ে পরিচিত শিল্পীদের একজন। নতুন প্রজন্মের শিল্পীদের জন্য তিনি একজন আইকন।

১৯৬২ সালের ১৬ আগস্ট চট্টগ্রামে বাংলার এই অনন্য গিটারিস্টের জন্ম। তিনি একাধারে গীতিকার, সুরকার, কণ্ঠশিল্পী এবং ব্যান্ড এলআরবি'র প্রতিষ্ঠাতা। ২০১৮ সালের ১৮ অক্টোবর 'রূপালী গিটার' ফেলে না ফেরার দেশে চলে যান তিনি। তবে আজও আইয়ুব বাচ্চু প্রাণবন্ত হয়ে আছেন ভক্তদের হৃদয়ে।

কিংবদন্তী এই গায়কের মৃত্যু পরবর্তী বাস্তবতা নিয়ে চিন্তার ছাপ পাওয়া যায় তার বেশ কয়েকটি গানে। গানগুলোতে নিজের মৃত্যু ও মৃত্যু পরবর্তী ভাবনা লক্ষণীয়। মৃত্যু নিয়ে দর্শকদের উদ্দেশেও গানে গানে বার্তা দিয়েছেন তিনি।

ব্যান্ড এলআরবি, বিভিন্ন মিক্সড অ্যালবাম ও একক গান মিলিয়ে যে প্রায় কয়েকশ গান করেছেন আইয়ুব বাচ্চু। কিছু গান নিজে রচনা করেছেন। কিছু গান রচিত হয়েছে প্রিন্স মাহমুদ, কাউসার আহমেদ চৌধুরী, বাপ্পি খান, এঞ্জেল শফিকসহ আরও অনেক খ্যাতিমান গীতিকারের হাতে।

আইয়ুব বাচ্চুর গান নির্বাচন ও পরিবেশনে দুঃখ, একাকীত্ব, বিরহ—পরিচিত প্রসঙ্গ। আইয়ুব বাচ্চুর কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ও কালজয়ী গান নিয়ে এ লেখায় সংক্ষেপে আলোচনা থাকছে। তবে, মনে রাখা প্রয়োজন যে, শ্রোতা হিসেবে সব গানকেই একাধিক আঙ্গিকে ব্যাখ্যা করা সম্ভব। মূল ব্যাখ্যা হয়ত শুধু গীতিকারই দিতে পারবেন।

আইয়ুব বাচ্চু। ছবি: সংগৃহীত

হয়তো কোথাও

"নাহয় সেই আমি নেই বেঁচে

তুমি তবু দেখো খুঁজে

হয়তো কোথাও পাবে আমাকে"

একক অ্যালবাম "কষ্ট" এর গানটি বের হয়েছিল ১৯৯৫ সালে। গানটির গীতিকার মারুফ আহমেদ। আইয়ুব বাচ্চুর বেশ শুরুর দিকের অ্যালবামগুলোর মাঝে এই অ্যালবামের প্রায় সব গানেই দুঃখবোধ ও ব্যক্তিগত অনুভূতির সংমিশ্রণ পাওয়া যায়।

গানটিতে এমন একটি চিত্রকল্প ফুটে উঠেছে, যেখানে শিল্পী ক্যান্সারের কাছে পরাজিত, কিন্তু তিনি আশা করছেন হয়ত দৈনন্দিন জীবনের আনাচে কানাচ বিভিন্নভাবে প্রিয়জনরা তাকে মনে করবেন। বেঁচে না থেকেও মানুষের মনে বেঁচে থাকার এই আকুতি গানটিকে অন্য মাত্রায় নিয়ে যায়।

উড়াল দেব আকাশে

"সবাইকে একা করে চলে যাবো অন্ধ ঘরে

এই শহর গাড়ি বাড়ি কিছুই যাবে না"

২০০০ সালে প্রকাশিত একক অ্যালবাম "প্রেম তুমি কি?" এর গানটি আইয়ুব বাচ্চু নিজেই লিখেছেন। গানটির ভাব অনেকটাই সুফি ধাঁচের। এখানে তিনি মানুষের জীবনের নশ্বরতার বিবরণ দিয়েছেন। একইসঙ্গে তিনি মানুষের মাঝে লোভ, হিংসা ও বিভেদের ওপরেও বেশ সোজাসাপ্টা বিবৃতি দেন।

এই ধাঁচের আরও কিছু গান (যেমন, "রাখে আল্লাহ, মারে কে?") অন্যান্য অ্যালবামেও রয়েছে, যা থেকে ধারণা করা যায় মৃত্যু সম্পর্কিত আধ্যাত্মিক চিন্তা তাকে প্রায়ই ভাবিয়েছে।

কিছু চাইব না

"তুমি ভালোবেসো, আমার ভালোবাসা

যখন কখনো আমি থাকবো না"

১৯৯৬ সালে প্রকাশিত এলআরবি ও ফিলিংসের যৌথ অ্যালবাম "স্ক্রু ড্রাইভার" এর এই গানের গীতিকার এঞ্জেল শফিক। গানটি সম্প্রতি আরও একবার জনপ্রিয়তা পেয়েছে ব্যান্ড ইন্ডালোর "১৯৯৬" গানের মাধ্যমে। ইন্ডালো আইয়ুব বাচ্চুর এই গানটিকে নতুন আঙ্গিকে ও আধুনিক পরিবেশনায় দর্শকদের মাঝে নিয়ে এসেছে।

মৃত্যু বা বিরহের পরেও যে ভালোবাসা শাশ্বত, তারই এক ঘোষণা যেন এই গান। এখানে শিল্পী বলেন, তার চলে যাওয়ার পরেও যেন তার ভালবাসাকে আমরা ভুলে না যাই এবং বিরহে কান্না পেলে যেন তা না লুকাই।

তাজমহল

"খুব বেশি জানতে ইচ্ছে করে,

আমি চলে গেলে কি নিয়ে তুমি থাকবে?

বড় বেশি জানতে ইচ্ছে করে

ভুলে যাবে নাকি আমায় মনে রাখবে?"

প্রিন্স মাহমুদের কথা ও সুরে আইয়ুব বাচ্চু ও জেমসের যৌথ অ্যালবাম "পিয়ানো" এর গান "তাজমহল"। এই গানের মূল বক্তব্য মৃত্যু এবং তার পরবর্তী স্মৃতিচারণ। এখানে হয়ত প্রয়াত কিংবন্দন্তি আমাদের হৃদয়ে যে স্থান করে নিয়েছেন, তারই একটি উপমা এই তাজমহল। তবে এই গানে স্মৃতিচারণ, সঙ্গে বিষণ্ণতা, পাশাপাশি এক ধরনের অনুপ্রেরণা ও আকাঙ্ক্ষার বার্তাও আছে।

আইয়ুব বাচ্চু। ছবি: সংগৃহীত

রূপালী গিটার

"এই রূপালী গিটার ফেলে

একদিন চলে যাব দূরে, বহুদূরে"

গিটার ও আইয়ুব বাচ্চু যেন একই সত্ত্বা। মৃত্যুর আগ পর্যন্তও তার কাছে ষাটের বেশি গিটার ছিল। গিটার ছিল তার কাছে সন্তানের মতো। তিনি নিজে গিটারকে তার জীবনের প্রথম প্রেম বলেছেন। 'রূপালী গিটার ফেলে' গানে তেমনই হাহাকার শুনতে পাওয়া যায়।

গানটিতে শ্রোতাদের সরাসরি সম্বোধন করেই কথা বলেছেন আইয়ুব বাচ্চু। অশ্রু গোপন করে তার ক্লান্তিবিহীন সুর ও আবেগ স্মরণ করার এক মায়াময় আকুতি এই "রূপালী গিটার"। এই গান থেকে অনুপ্রেরণা নিয়েই চট্টগ্রামে আইয়ুব বাচ্চুর স্মরণে রূপালী গিটারের প্রতিকৃতি স্থাপিত হয়েছে।

কাউসার আহমেদ চৌধুরী এর লেখা এই গান প্রকাশিত হয় ১৯৯৩ সালে এল আর বি এর "সুখ" অ্যালবামে ।

আইয়ুব বাচ্চু যেমন সর্বস্তরের মানুষের কাছে পৌঁছাছেন, তেমনি তার গানের ধারাও বহুদিকে বিস্তৃত হয়েছে। তার গানে যেমন তিনি মৃত্যু ও একাকিত্বের বর্ণনা করেছেন, তেমনি উদ্যম নিয়ে জীবনে এগিয়ে যাওয়ার গানও করেছেন। তার গানের প্রভাব ভবিষ্যতের সব প্রজন্মের মধ্যেই ছড়িয়ে পরবে। তিনি বেঁচে থাকবেন আমাদের হৃদয়ে, ঠিক যেমনটি তিনি আশা করেছেন তার গানের মাধ্যমে।

রিফাত আরেফিন হক: সংগীতশিল্পী ও লেখক

 

Comments

The Daily Star  | English

Dengue death toll crosses 500-mark

7 die, 629 hospitalised till this morning

1h ago