লিসবনের মুরারিয়া অঞ্চলে বাংলাদেশি অভিবাসীরা এখন সংখ্যাগরিষ্ঠ
পর্তুগালের রাজধানী লিসবনের ডাউনটাউন মুরারিয়া এলাকায় বাস করেন প্রায় ৬ হাজার মানুষ, যাদের এক চতুর্থাংশই অভিবাসী। বিশ্বের ৫০টি দেশের মানুষের বসবাস লিসবনের এই অংশে এগিয়ে আছে বাংলাদেশ কমিউনিটি।
সম্প্রতি স্থানীয় সংগঠন এসোসিয়েশন রিনোভার এ মোরারিয়ার করা পরিসংখ্যানে এমন চিত্র উঠে এসেছে। তাদের প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যায়, এই অঞ্চলে বসবাসকারীদের মধ্যে সংখ্যায় সবচেয়ে এগিয়ে বাংলাদেশ, ভারত, চীন, ব্রাজিল, নেপাল, মোজাম্বিক ও গিনে অঞ্চলের মানুষ।
লিসবনের এই এলাকাটিতে একসময় মরিশ বা মরক্কোর মানুষের বসবাস ছিল। সেই কারণে এর নামকরণ করা হয় মুরারিয়া। লিসবনসহ ইউরোপের আন্দালুসিয়া অঞ্চল একসময় মুসলিম শাসনের অংশ ছিল। ১১৪৭ সালে যখন রাজা আপোনসো হেনরিক যে ছিল পর্তুগালের প্রথম রাজা লিসবন দখল করেন এবং এখানে বসবাস করার সিন্ধান্ত নেন। সেই সময়ে এই এলাকাটি ছিল লিসবনের সবচেয়ে অবহেলিত অঞ্চল।
লিসবনের এই অংশের রয়েছে ৯০০ বছরের ইতিহাস ও ঐতিহ্য এবং বিগত ৩ দশক থেকে এখানে বাংলাদেশ কমিউনিটি বসবাস করে আসছে। শহরের প্রাণকেন্দ্র এবং প্রাচীন বাণিজ্যিক এলাকা হওয়াতে দক্ষিণ এশিয়ার অভিবাসীদের পছন্দের জায়গা হয়ে ওঠে এলাকাটি। ৯০-এর দশকে শুরু হয়ে এখন পর্যন্ত প্রায় ২৫ হাজার বাংলাদেশির বসবাস রয়েছে মোরারিয়াসহ পুরো পর্তুগালে।
এখানকার বেনফোরমোসো সড়ক এলাকায় অবস্থিত ৯০টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ৪০টির বেশি প্রতিষ্ঠান বা দোকানের মালিক বাংলাদেশি। বর্তমানে এই সড়ক এলাকাটিকে অনেকে 'বাংলা টাউন' হিসেবে আখ্যায়িত করে থাকে। তবে এখানকার বেশিরভাগ রেস্তোরাঁ বাংলাদেশি মালিকানায় পরিচালিত হলেও স্থানীয় কাউন্সিল এই সড়কটিকে বিশেষায়িত ইন্ডিয়ান রেস্তোরাঁ অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করেছে।
এখানে দেশীয় রেস্তোরাঁর পাশাপাশি গ্রোসারি শপ, সেলুন, মোবাইল শপসহ রয়েছে হালাল মাংসের দোকান। তাছাড়া কাছে রয়েছে বাংলাদেশিদের তত্ত্বাবধানে ৩টি মসজিদ যেখানে বিশ্বের নানা দেশের মানুষ নিয়মিত নামাজ আদায়ের সুযোগ পাচ্ছেন। তাছাড়াও গড়ে উঠেছে বাংলাদেশি তরুণদের উদ্যোগে পর্তুগিজ ভাষা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন বাণিজ্যিক কার্যক্রম।
১৪ শতকে লিসবন শহরকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য মোরারিয়ার পাশ ঘেঁষে মাত্র দুবছরে গড়ে তোলা হয়েছিল ফার্নান্দিনহা নামক দেওয়াল যার কিছু অংশবিশেষ এখনো রয়েছে ঐতিহ্য ও নিদর্শন হিসেবে। এই দেওয়ালের ৭০টির বেশি পর্যবেক্ষণ টাওয়ার ছিল যার মাত্র কয়েকটি বর্তমানে অবশিষ্ট আছে এবং মাতৃ মনিজ মাঠের পশ্চিম দিকে টরি ডি পেলা মানে একটির অবস্থান যা এখন পর্তুগালের ন্যাশনাল মনুমেন্ট হিসেবে স্বীকৃত।
মুরায়িয়া এলাকায় মাতৃ মনিজ স্কয়ার খুবই গুরুত্বপূর্ণ কেননা জায়গাটি বিভিন্ন দেশ, সংস্কৃতি ও বিশ্বাসের মানুষের মিলন মেলা হিসেবে পরিচিত। বিশেষ করে এখানে পর্তুগিজ বিভিন্ন উৎসব অনুষ্ঠানের পাশাপাশি মুসলমানদের ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার বিশাল জামাত, হিন্দুদের হলি উৎসব, চাইনিজ নিউ ইয়ার অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে বিগত কয়েক যুগ ধরে।
বর্তমানে লিসবনের এই এলাকাটিতে সবচেয়ে বেশি স্থানীয় বয়স্ক মানুষের বসবাস তাই এখানকার বেশিরভাগ অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক কাজকর্ম পরিচালিত হচ্ছে বাংলাদেশিসহ দক্ষিণ এশিয়ার অভিবাসীদের মাধ্যমে। ১৯৮৯ সালে যাত্রা শুরু করে সেন্টার কমার্শিয়াল মুরারিয়া মার্কেট যেখান থেকে লিসবনের স্থানীয় ব্যবসায়ীরা পাইকারি দামে পণ্য সংগ্রহ করত তার পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ এখন বাংলাদেশিসহ দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের অভিবাসীদের।
মুরারিয়া এলাকায় অত্যধিক অভিবাসী বসবাসের ফলে এখানকার বাসা ভাড়া তুলনামূলক বেশি। তাছাড়া এটি শহরের কেন্দ্রে অবস্থান এবং বাণিজ্যিক এলাকা হওয়াতে এখানে জীবনযাত্রার ব্যয় কিছুটা বেশি। বাংলাদেশি অধ্যুষিত এলাকা হওয়াতে এবং সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থার ফলে বাংলাদেশিসহ বিশ্বের নানা দেশের মানুষ এই এলাকায় বসবাস করতে আগ্রহী তাই মুরারিয়া হয়ে উঠেছে লিসবনের সবচেয়ে ডাইভার্স কমিউনিটি অঞ্চল।
মুরারিয়া লিসবনের আদি শহরের অংশ এবং এখানে এখনো দাঁড়িয়ে রয়েছে ১৭৫৫ সালের ভূমিকম্প, জলোচ্ছ্বাস ও অগ্নিকাণ্ডের শিকার বেশকিছু দালান যেখানে এখনো মানুষ বসবাস করছে পরবর্তী সংস্কারের মাধ্যমে এবং লিসবন সিটি করপোরেশন এগুলোকে তাদের ঐতিহ্য হিসেবে সংরক্ষণ করে আসছে। ফলশ্রুতিতে এলাকাটি পর্যটকে মুখর থাকে সব সময়।
লেখক: পর্তুগালপ্রবাসী সাংবাদিক
Comments