খামারে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার: ওষুধ প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া বাড়াচ্ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি
বাংলাদেশে মুরগির খামারগুলোতে অ্যান্টিবায়োটিকের অত্যধিক ব্যবহারের ফলে ওষুধ প্রতিরোধী জীবাণু বা 'সুপারবাগ' বাড়ন্ত হয়ে উঠছে বলে উঠে এসেছে বিভিন্ন গবেষণায়। যা প্রচলিত চিকিৎসাপদ্ধতিতে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না।
তাই জীবন রক্ষাকারী এই ওষুধের যথেচ্ছ ব্যবহার বন্ধে সরকারের উদ্যোগী হওয়ার সময় এসেছে।
বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএলআরআই) এক গবেষণায় ঢাকার ২৯টি বাজার থেকে সংগ্রহ করা মুরগির নমুনায় বিভিন্ন মাত্রায় ১৭টি অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী সালমোনেলা ব্যাকটেরিয়ার ৩টি ধরন পাওয়া গেছে। যেখানে প্রতিরোধের মাত্রা ৬ দশমিক ৭ শতাংশ থেকে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত।
বিএলআরআই-এর প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মুহাম্মদ আবদুস সামাদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বিষয়টি উদ্বেগজনক। কারণ এটি জনস্বাস্থ্যের জন্য একটি বড় হুমকি।'
গবেষণায় দেখা গেছে, হাঁস-মুরগি ও গবাদিপশুর অন্ত্রে বেড়ে ওঠা এই ব্যাকটেরিয়া মানব শরীরেও বাহিত হতে পারে।
আবদুস সামাদ এমন একটি সময়ে এই মন্তব্য করলেন, যখন রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, প্রায় সব চিকিৎসায় গুরুত্বপূর্ণ ও বহুল ব্যবহৃত অ্যান্টিবায়োটিকগুলো তাদের ৫০ শতাংশ কার্যকারিতা হারিয়েছে। এই তালিকায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তালিকাভুক্ত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ৫টি ওষুধও আছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, সালমোনেলা বিশ্বব্যাপী মানুষের ডায়রিয়াজনিত রোগের ৪টি মূল কারণের মধ্যে একটি।
বিএলআরআই-এর গবেষণায় দেখা গেছে, বিভিন্ন ধরনের সালমোনেলা ব্যাকটেরিয়ার সবচেয়ে বেশি প্রকোপ ব্রয়লার মুরগিতে (৮ দশমিক ৬ শতাংশ)। এর পরে আছে সোনালি মুরগি (৬ দশমিক ৯ শতাংশ) ও দেশি মুরগি (৩ দশমিক ১ শতাংশ)। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে এর নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছিল।
এর মধ্যে ২৯টি ব্যাকটেরিয়া মাল্টিড্রাগ প্রতিরোধী, ১৫টি ব্যাকটেরিয়া ৭টি অ্যান্টিবায়োটিক, ৪টি ব্যাকটেরিয়া ৮টি অ্যান্টিবায়োটিক ও ১টি ব্যাকটেরিয়া ১০টি অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী।
এই গবেষণার জন্য মোট ১৭টি অ্যান্টিবায়োটিক পরীক্ষা করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে- সিপ্রোফ্লক্সাসিন, স্ট্রেপ্টোমাইসিন, টেট্রাসাইক্লিন, জেন্টামাইসিন, নালিডিক্সিক অ্যাসিড ও অ্যামপিসিলিন, মেরোপেনেম, সেফটাজিডিম, সেফট্রিয়াক্সোন এবং সেফোটাক্সিম ও অ্যাজট্রেওনাম।
বিএলআরআই-এর এই গবেষণা প্রকাশিত হয় গত এপ্রিলে। এতে গবেষকরা এই উপসংহারে আসেন যে, অ্যান্টিবায়োটিকগুলো সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয়েছে ব্রয়লার মুরগি উৎপাদনে। এর পরে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়েছে সোনালি মুরগি উৎপাদনে।
আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের একটি গবেষণাও বিএলআরআই-এর এই গবেষণা ফলাফলকে বৈধতা দিয়েছে।
দেশের ২০টি উপজেলায় ছড়িয়ে থাকা ৭৬৮টি পোল্ট্রি ফার্মকে সম্পৃক্ত করা এ গবেষণায় দেখা যায়, যেসব খামারে ব্রয়লার মুরগি পালন করা হয়, সেখানে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার সবচেয়ে বেশি। প্রায় ৯৮ শতাংশ।
এ ছাড়া জরিপ করা ৮৮ শতাংশ সোনালি মুরগির খামারে দেখা যায়, খামার পরিদর্শনের আগের ১৪ দিনে সেখানকার মুরগিগুলোকে অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয়েছে। লেয়ার মুরগির ক্ষেত্রে এই হার ছিল ৭২ শতাংশ।
আইসিডিডিআর,বির এই গবেষণাকর্মটি এখনো প্রকাশিত হয়নি। এতে দেখা গেছে, খামারে ১ দিন বয়সী বাচ্চাকেও অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয়। যা বাজারে বিক্রি হওয়ার আগ পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।
গবেষণার তথ্য অনুসারে, খামারিদের মধ্যে ৫৫ শতাংশ পর্যন্ত ১ দিনের বাচ্চাকে অ্যান্টিবায়োটিক দেন বিনা কারণে। এ ছাড়া প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে বিক্রির দিন ৩ থেকে ৫ শতাংশ খামারি মুরগিকে অ্যান্টিবায়োটিক দেন।
সুস্থ মুরগিকে রুটিন ভিত্তিতে ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়ার ক্ষেত্রে খামারিদের যুক্তি হলো, কাছাকাছি অবস্থানরত মুরগির পালের মধ্যে রোগ ছড়িয়ে পড়া থেকে বিরত রাখা ও মুরগি মোটাতাজা করার জন্য।
গবেষণা অনুসারে, রোগাক্রান্ত হলে প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৮ জন খামারিই মুরগিকে অ্যান্টিবায়োটিক দিয়েছেন।
চিকিৎসার জন্য সবচেয়ে বেশি অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয়েছে সোনালি মুরগির খামারগুলোতে (প্রায় ৩০ শতাংশ)। ব্রয়লার খামারের ক্ষেত্রে এই হার ২৫ শতাংশ ও লেয়ার খামারের ক্ষেত্রে ২০ শতাংশ।
এই গবেষণাকর্মে নেতৃত্ব দেওয়া আইসিডিডিআর,বির সংক্রামক রোগ বিভাগের বিজ্ঞানী সুকান্ত চৌধুরী ডেইলি স্টারকে বলেন, 'প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে যে পরিমাণ অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয়েছে তা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।
পশু চিকিৎসক ও ফিড ডিলাররা কৃষকদের এই অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের পরামর্শ দিয়ে থাকেন। যদিও ফিড ডিলারদের এ ধরনের পরামর্শ দেওয়ার কোনো এখতিয়ার নেই।
ব্যবহৃত অ্যান্টিবায়োটিকগুলোর মধ্যে আছে টেট্রাসাইক্লিন, ফ্লুরোকুইনোলোনস, ম্যাক্রোলাইডস, অ্যামিনোগ্লাইকোসাইডস, পেনিসিলিন ও পলিমিক্সিন। এগুলো অ্যাকসেস ও রিজার্ভ- ২ গ্রুপেরই।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুসারে, অ্যাকসেস গ্রুপের অ্যান্টিবায়োটিকগুলো প্রাথমিক স্তরের সংক্রমণের জন্য নির্ধারিত। বিপরীতে ওয়াচ গ্রুপের অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয় বেশি প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়ার ক্ষেত্রে।
অ্যান্টিবায়োটিকের অত্যধিক ব্যবহার শেষ পর্যন্ত অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স (এএমআর) তৈরি করে। যা ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস এবং প্যারাসাইটের মতো অণুজীবকে মেরে ফেলার জন্য অকার্যকর হয়ে পড়ে।
সুকান্ত চৌধুরীর ভাষ্য, 'তাই খামারগুলোতে স্বাস্থ্যসম্মত ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করলে অ্যান্টিবায়োটিকের পেছনে ব্যয় অনেকাংশে কমানো যেতে পারে।'
তার মতে, খামারগুলোতে স্বাস্থ্যসম্মত ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে প্রচারণা দরকার। এটা বোঝানোর জন্য যে, অ্যান্টিবায়োটিকের অত্যধিক ব্যবহার সাহায্য করে না। বরং এটি মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর আর এতে খরচ বাড়ে।
ওয়ান হেলথ বাংলাদেশের জাতীয় সমন্বয়ক নিতীশ চন্দ্র দেবনাথ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'মুরগিতে পাওয়া প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া একটি বড় উদ্বেগের বিষয়…মানবদেহে প্রতিরোধী প্যাথোজেন পেলে ঠিক যেমন উদ্বেগ আমরা অনুভব করি।
'যেকোনো প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া উদ্বেগ সৃষ্টিকারী। তা মানুষ, প্রাণী কিংবা প্রকৃতি- যেখান থেকেই উদ্ভূত হোক না কেন। কারণ এটি সমস্ত প্রজাতির মধ্যে সংক্রমিত হতে পারে।'
নিতীশ চন্দ্র দেবনাথ জাতিসংঘের নেতৃত্বাধীন ওয়ান হেলথ হাই লেভেল এক্সপার্ট প্যানেলের একজন। তার পরামর্শ, অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স মোকাবিলা করার জন্য সব ধরনের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা- মানুষ, প্রাণী ও প্রকৃতি- সবকিছুকে 'এক স্বাস্থ্য' পদ্ধতির আওতায় আনতে হবে।
ওয়ান হেলথ এমনটাই বলে থাকে যে, আশপাশের পরিবেশ ও প্রাণীকূলের স্বাস্থ্যের সঙ্গে মানবস্বাস্থ্যের বিষয়টি ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত।
অনুবাদ করেছেন মামুনুর রশীদ
Comments