উড়ন্ত গাড়ি এখন আর কল্পনা নয়
গাড়ি তৈরির ক্ষেত্রে অভিনবত্ব আনতে পোর্শের জুড়ি নেই। এবার তারা আনছে উড়ন্ত গাড়ি।
শুধু পোর্শে নয়। আরও কয়েকটি গাড়ি প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান উড়ন্ত গাড়ি নিয়ে কাজ করছে।
একবার ভাবুন তো, কেমন হবে যদি দেখেন আপনার মাথার ওপর দিয়ে উড়ে চলেছে গাড়ি। কোনো প্রকার যানজট ছাড়াই সেগুলো পৌঁছে যাচ্ছে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায়! বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনির মতো শোনালেও এটিকে বাস্তবে রূপ দিতে কাজ করে যাচ্ছে গাড়ি প্রস্তুতকারী বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান।
গাড়ি এবং উড়োজাহাজের সমন্বিত এই রূপ বদলে দিতে পারে সারা পৃথিবীর ভ্রমণ অভিজ্ঞতা।
এরই মধ্যে গাড়ি-নির্মাণ শিল্পের বাঘা বাঘা সব নাম নিজেদের নিয়োজিত করেছে এ কাজে। চলছে প্রতিযোগিতা, কার আগে কে এই অসাধ্য সাধন করে তাক লাগিয়ে দিতে পারে পুরো পৃথিবীকে।
পোর্শে, ডেইমলার এবং টয়োটার মতো প্রতিষ্ঠানগুলো ইভিটিওএল (ইলেকট্রিক ভার্টিকাল টেকঅফ এন্ড ল্যান্ডিং এয়ার ক্রাফট) নিয়ে কাজ করছে।
এই প্রযুক্তি ব্যবহার করেই গাড়িকে স্থলের সঙ্গে সঙ্গে চালানো যাবে আকাশেও।
ইভিটিওএল’র মাধ্যমে গাড়িকে লম্বালম্বিভাবে উড়ানো এবং মাটিতে নামানো নিয়ে পরীক্ষা চলছে। আর এই কাজ হবে একটি অ্যাপে ক্লিক করার মাধ্যমেই।
এগুলোকে কল্পকাহিনি মনে হচ্ছে? হতে পারে হয়তো। তবে তা যে শুধুই নয়, তার প্রমাণ দুবাই। এরই মধ্যে দুবাইয়ে সীমিত আকারে এমন গাড়ি পরীক্ষামূলকভাবে চলছে।
গাড়ি নির্মাতাদের জন্য এই প্রযুক্তি একই সঙ্গে সম্ভাবনা এবং হুমকির। হুমকি হওয়ার কারণ, স্থলপথে তাদের নিয়মিত ব্যবসার ক্ষেত্রটি তখন বেশ-খানিকটা ছোট হয়ে যাবে। চাহিদার তুঙ্গে থাকবে উড়ন্ত গাড়ি।
বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি নির্ভর সিনেমার মতো শোনালেও ভলোকপ্টার নামে এমন উড়ন্ত-গাড়ি আগামী বছরেই চালু হতে যাচ্ছে।
মার্সিডিজ গাড়ি উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত ডেইমলার। জার্মান এই প্রতিষ্ঠানটি ভলোকপ্টার তৈরিতে বিনিয়োগ করছে। এই গাড়িতে দুজন যাত্রী বসতে পারবে। শহরের পরিবেশে চালানোর জন্য এটি বিশেষভাবে নকশা করা হয়েছে।
ল্যাব ১৮৮৬ নামের ডেইমলারের একদল বিশেষজ্ঞ এই গাড়ি নিয়ে কাজ করছে এবং ইউরোপের একটি শহরে এটি পরীক্ষামূলক উড়িয়েছে বলে জানিয়েছে সিএনএনের একটি প্রতিবেদন।
সুইডিশ প্রতিষ্ঠান ভলভো এবং ডেইমলারের একটি অংশের চীনা মালিকানা প্রতিষ্ঠান হচ্ছে গিলি। তারা এরইমধ্যে এই প্রকল্পে ৫০ মিলিয়ন ইউরো বিনিয়োগ করেছে।
ক্যালিফোর্নিয়ায় অবস্থিত চীনা অটোমোবাইল প্রতিষ্ঠান টেরাফুগিয়াও এই কাজে মনোনিবেশ করছে।
টেরাফুগিয়ার ‘উড়ন্ত-গাড়ি’ দেখতে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনির লেখকদের কল্পনার মতোই।
‘দ্য এপটলি’ নামের গাড়িটি সাধারণ গাড়ির মতোই রাস্তায় চালতে পারবে। ব্যবহারকারী চাইলে এর পাখা মেলে উড়োজাহাজের মতো উড়াতে পারবে।
২০১৮ সালের নভেম্বরে টেরাফুগিয়া ঘোষণা করেছিলো ২০১৯ সালে তারা গাড়িটির উৎপাদনে যাবে। যদিও তা এখন পর্যন্ত পারেনি প্রতিষ্ঠানটি।
জাপানি অটোমোবাইল প্রতিষ্ঠান টয়োটাও এমন প্রকল্প নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে।
ক্যালিফোর্নিয়ায়-ভিত্তিক জবি অ্যাভিয়েশনের বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান টয়োটা এআই ভেনচার্স। জবি ইভিটিওএল প্রযুক্তি ব্যবহার করে বৈদ্যুতিক বাহন তৈরি করতে কাজ করছে। এটি একবার চার্জ করে ২৪০ কিলোমিটার চালানো যাবে। পাঁচজন যাত্রী বহন করতে পারবে এটি। এর সম্পর্কে বলতে গিয়ে জবি জানিয়েছে তাদের এই বাহনটি অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের বাহনগুলোর তুলনায় বেশি গতিসম্পন্ন হবে এবং শব্দ হবে কম।
টয়োটা এআই ভেনচার্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জিম অ্যাডলার সিএনএনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “আমরা এমন প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছি যা মানুষের জল, স্থল এবং আকাশ পথে চলার অভিজ্ঞতায় পরিবর্তন আনবে।”
অটো শিল্পের ভবিষ্যতের সঙ্গে জড়িত একটি মূল উপাদান হচ্ছে ব্যাটারি। দীর্ঘ সময় ছোট্ট বাহনকে পরিচালনা করতে বেশ শক্তিশালী ব্যাটারির প্রয়োজন।
জেট-ব্লু টেকনোলজি ভেনচারর্সের প্রধান বনি সিমি বলেন, “আমরা এখন ইভিটিওএলের ক্ষেত্রে এতো পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছি মূলত ব্যাটারি প্রযুক্তির অগ্রগতির কারণে।”
যুক্তরাজ্যের ক্র্যানফিল্ড বিশ্ববিদ্যালয় গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান অ্যাস্টন মার্টিনের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করছে ‘ভোলেন্ট ভিশন কনসেপ্ট’ নিয়ে। এটি বিলাসবহুল গাড়ি তৈরি করবে ইভিটিওএল প্রযুক্তি ব্যবহার করে।
রোলস রয়েস তাদের নিজস্ব ইভিটিওএল প্রযুক্তি ২০১৮ সালে সবার সামনে আনে। তারা আশা করছে ২০২০ সালে বাজারে তাদের গাড়ি আনতে পারবে।
জার্মান-ভিত্তিক বিলাসবহুল গাড়ি নির্মাণ প্রতিষ্ঠান পোর্শে নিজস্ব ‘উড়ন্ত গাড়ি’ তৈরির জন্য বোয়িংয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে।
প্রকল্পটি এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে থাকলেও তাদের প্রকাশিত এক তথ্যচিত্রে দেখা যায় এটি দেখতে অনেকটা ব্যাটম্যানের মতো।
অপরদিকে, এয়ারবাসের নিজস্ব ইভিটিওএল ক্র্যাফট রয়েছে। ২০১৮ সাল থেকে শুরু করে এরইমধ্যে এটি ১০০তম পরীক্ষামূলক উড়ান সম্পন্ন করেছে। সেদিক থেকে সবচেয়ে এগিয়ে আছে তারাই।
পোর্শের পূর্বাভাস ২০৩৫ সালের মধ্যে এসব গাড়ি বিক্রি হবে প্রায় ২৩ হাজার। যা ৩২ বিলিয়ন ডলার মূল্যের নতুন বাজার তৈরি করবে।
এমন যাত্রী বহনকারী গাড়ি আপনার মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়া নিয়ে এখনই ভয় পাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। প্রাথমিকভাবে ২০২৫ সালে চালু হতে পারে উড়ন্ত গাড়ি। তবে প্রথমদিকে এর বেশিরভাগ বিমানবন্দর থেকে বড় শহরগুলোর কেন্দ্র পর্যন্ত চলতে পারে। ২০৩৫ সালের মধ্যে এটি আরও বিস্তার পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
উড়ন্ত গাড়ি আসছে। অপেক্ষা শুধু সময়ের জন্য। তবে দেখার ব্যাপার হচ্ছে, এখন যারা গাড়ির বাজারে আধিপত্য বিস্তার করে আছে তারাই কি এই বাজারও দখল করে থাকবে, না কি অন্য কোনো নতুন প্রতিষ্ঠান এই বাজার নিজেদের করে নেবে?
Comments