যেভাবে গড়ে উঠল হামাস
গাজায় স্থল হামলার ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে ইসরায়েলের সেনাবাহিনী। তবে শুধু মাটির ওপরে যুদ্ধ করে ইসরায়েল জিততে পারবে না। গাজার মাটির তলায় শত শত কিলোমিটার বিস্তৃত টানেল বা সুড়ঙ্গে যুদ্ধের জন্য সজ্জিত আছে হামাস যোদ্ধারা। এমন মত দিয়েছেন বিশ্লেষকরা।
বিশ্লেষকদের মতে, বছরের পর বছর ধরে গোপনে প্রশিক্ষণ নিয়ে ইরান ও আরব বিশ্বের সহায়তায় বিশেষ সক্ষমতা অর্জন করেছে হামাস।
২০০৭ সাল থেকে গাজার নিয়ন্ত্রণ রাখা হামাস গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলের দক্ষিণে মরণপণ আক্রমণ চালায়।
হামাসের জ্যেষ্ঠ সদস্যদের একজন আলী বারাকা যেমন বলছেন- 'প্রয়োজনই উদ্ভাবনের জননী।' তিনি রয়টার্সকে বলেন, 'দীর্ঘদিন ধরে ইরান থেকে আর্থিক ও সামরিক সহায়তা পেয়েছে তারা। এর সঙ্গে সহায়তা করছে লেবাননের হিজবুল্লাহর মতো দলগুলোও, গাজায় নিজেদের শক্তিবৃদ্ধি করছে তারাও।'
আলী বারাকার শেকড়ও লেবাননে। তিনি জানান, বাইরে থেকে অস্ত্র আমদানি করা ছিল খুব কঠিন একটি ব্যাপার। গত নয় বছর ধরে স্থানীয়ভাবেই অস্ত্র উৎপাদন করেছেন তারা।
২০০৮ সালের যুদ্ধে গাজা থেকে হামাস যেসব রকেট ছুড়েছিল সেগুলো সর্বোচ্চ ৪০ কিলোমিটার যেতে পারত। ২০২১ সাল নাগাদ তাদের রকেটগুলো ২৩০ কিলোমিটার যাওয়ার সক্ষমতা অর্জন করে।
২০২০ সালে করা আমেরিকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ফিলিস্তিনের সংগঠনগুলোকে ইরান বার্ষিক ১০০ মিলিয়ন ডলার সহায়তা দিয়ে থাকে। এর ভেতর হামাস, ইসলামিক জিহাদ ও পপুলার ফ্রন্ট ফর দ্য লিবারেশন অব প্যালেস্টাইন রয়েছে।
বর্তমানে ব্যাপকভাবে বিস্তৃত ও গোপনে কার্যক্রম চালানো সংগঠনটির তুলনায় অনেক এগিয়েছে ৩৬ বছর আগের লিফলেট বিতরণ করা ছোট সেই সংগঠন।
হামাসের সক্ষমতা সম্পর্কে জানতে ১১ জনের সঙ্গে কথা বলেছে রয়টার্স, যাদের মধ্যে হামাসের নেতা, আঞ্চলিক নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও সামরিক বিশেষজ্ঞরা আছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে গাজা উপত্যকায় হামাসের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র দাবি করে, তারা একটি ছোটখাটো সামরিক বাহিনি। হামাসের একটি সামরিক প্রশিক্ষণকেন্দ্র আছে, যেখানে সাইবার নিরাপত্তা ও নৌপথে অভিযানের বিষয়ে বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়৷ এর সামরিক শাখায় রয়েছে ৪০ হাজার সদস্য। গ্লোবালসিকিউরিটি.অর্গ জানাচ্ছে, নব্বই দশকে হামাসের যোদ্ধার সংখ্যা ছিল ১০ হাজারের কম।
২০০০ সালের পর থেকে সংগঠনটি গাজার মাটির নিচে টানেল বা সুড়ঙ্গ নেটওয়ার্ক গড়ে তোলে। এর ফলে যোদ্ধাদের পালিয়ে যাওয়া, স্থানীয় বাসা-বাড়িতে অস্ত্র তৈরির কারখানা ও বাইরে থেকে অস্ত্র আমদানির ক্ষেত্রে সুবিধা হয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় একটি সূত্র রয়টার্সকে জানায়, দলটি বেশ ভালো পরিমাণে বোমা, মর্টার শেল, রকেট, ট্যাংক ও বিমান বিধ্বংসী মিসাইল তৈরি ও মজুদ করেছে।
হামাসের এই উত্তরোত্তর শক্তিবৃদ্ধির ফলাফল দেখা গেছে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে। ২০০৮ সালের অভিযানের সময় ইসরায়েলের নয়জন সেনা নিহত হয়েছিল, ২০১৪ সালে সংখ্যাটি বেড়ে দাঁড়ায় ৬৬ জনে।
ব্রিটেনের রয়াল ইউনাইটেড সার্ভিস ইন্সটিটিউটের সিনিয়র এসোসিয়েট ফেলো এইচ.এ. হেলিয়ারের মতে, জনাকীর্ণ গাজায় হামলা চালিয়ে হামাসকে ধ্বংস করতে সক্ষম ইসরায়েল।
'এটি সম্ভব নাকি অসম্ভব, প্রশ্নটা সেখানে নয়। প্রশ্ন এখানে যে, জনসাধারণকে এজন্য ঠিক কতটা মূল্য চুকাতে হবে। হামাস তো কোনো বিচ্ছিন্ন দ্বীপ বা মরুভূমিতে বাস করে না।'
এর আগে গাজায় যুদ্ধ হয় ২০২১ সালে। তখন হামাস ও এর সহযোগি ইসলামিক জিহাদ গ্রুপ তাদের অন্তত ৪০ ভাগ রকেট অক্ষত রাখতে পেরেছিল। জিউইশ ইন্সটিটউট ফর ন্যাশনাল সিকিউরিটি অব আমেরিকা জানায়, যুদ্ধের আগে তাদের রকেট ছিল ২৩ হাজার। এর মধ্যে ১১,৭৫০টি রকেট তারা রক্ষা করতে পেরেছিল।
নিশ্ছিদ্র প্রতিরোধ
১৯৮৮ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সংগ্রামে লিপ্ত হামাস। ইসরায়েল, আমেরিকা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কানাডা, মিশর ও জাপান একে সন্ত্রাসী সংগঠন আখ্যা দিয়েছে।
বছরের পর বছর ধরে হামাস ইরানকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছে যে ইসরায়লকে বিপুল সংখ্যক সৈন্য দিয়ে ঘিরে ফেলা যায়। হামাসের পাশাপাশি ফিলিস্তিনের অন্যান্য দল এবং লেবাননের হিজবুল্লাহও যুক্ত রয়েছে এই পরিকল্পনায়। ফিলিস্তিনের ভূমিতে ইসরায়েলের দখলদারিত্ব অবসানে আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে প্রতিরোধ গড়তে চায় তারা।
এই দলের নেতারা মধ্যপ্রাচ্যের লেবানন ও কাতারের মতো দেশগুলোতেও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছেন, তবে এদের মূল ভিত্তি গাজায়। গাজার অধিবাসীদের তারা আহ্বান জানিয়েছেন, ইসরায়েলের হুমকিতে যেন তারা গাজা ত্যাগ না করে। ইতোমধ্যে সেখানে ইসরায়েলের বোমা হামলায় ২৮০০ এর বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন।
গত ৭ অক্টোবর, গত ৫০ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ হামলা হয় ইসরায়েলে। হামাস এদিন হাজারো রকেট নিক্ষেপ করে সীমান্তের বেড়া ভেঙে ইসরায়েলে ঢুকে সামরিক ও বেসামরিক লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালায়। এই হামলায় ১ হাজার ৩০০ এর মতো ইসরায়েলি নিহত হন এবং প্রায় ২০০ জনকে জিম্মি করে গাজায় ধরে আনা হয়।
রয়টার্স সেখানকার কয়েকজন অধিবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানতে পারে ইরান অস্ত্রশস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দিয়ে হামাসকে সহায়তা করলেও, ৭ অক্টোবরের হামলায় তাদের প্রত্যক্ষ মদদ থাকার কোনো প্রমাণ মেলেনি।
আঞ্চলিক নিরাপত্তা সূত্র জানাচ্ছে, আক্রমণের সিদ্ধান্ত ছিল পুরোপুরি হামাসের হাতে। তবে হামাসের এই হামলার প্রশংসা করলেও নিজেদের সংযুক্তি অস্বীকার করেছে ইরান।
গত বছর আল জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে হামাসের নেতা ইসমাইল হানিয়া জানান, তাদের সংগঠন ইরান থেকে ৭০ মিলিয়ন ডলারের সামরিক সহায়তা পেয়েছে। তিনি আরও জানান, 'আমাদের কাছে স্থানীয়ভাবে তৈরি করা রকেট আছে। তবে দূরপাল্লার রকেট আসে বাইরে থেকে। ইরান ও সিরিয়া থেকে মিশর হয়ে এসব রকেট আসে।'
ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনীর একটি সূত্রের মতে, গত বছর ইরান হামাসের সামরিক শাখার জন্য সহায়তার পরিমাণ ১০০ মিলিয়ন ডলার থেকে বাড়িয়ে ৩৫০ মিলিয়ন ডলারে উন্নীত করে।
হামাসের প্রতিষ্ঠাতা শেখ ইয়াসিন
হামাস শব্দটি আরবি, যার অর্থ উদ্যম। ১৯৮৭ সালের ১০ ডিসেম্বর গঠিত হয় এই সংগঠন। চার ফিলিস্তিনি শ্রমিক বহনকারী এক গাড়িতে ইসরায়েলের সন্দেহভাজন হামলায় যাত্রীদের সবাই নিহত হয়। ঘটনার পরদিন মুসলিম ব্রাদারহুডের কিছু সদস্য একত্রিত হয়ে গড়ে তোলেন হামাস।
শেখ আহমেদ ইয়াসিনের বাড়িতে এক বৈঠক শেষে ১৪ ডিসেম্বর ইসরায়েলের বিরুদ্ধে 'প্রথম ইন্তিফাদা'র ঘোষণা দিয়ে প্রকাশ্যে লিফলেট বিতরণ করে হামাস।
২০০৫ সালে গাজা থেকে ইসরায়েল সেনা প্রত্যাহার করার পর ইরান থেকে রকেট আমদানি করতে শুরু করে হামাস। এর সঙ্গে বিস্ফোরক ও অন্যান্য জিনিসও আনতে থাকে তারা। জাহাজে করে সুদান হয়ে কিংবা মিসর দিয়ে ট্রাকে করে ও সিনাই উপদ্বীপের নিচে সরু টানেল ব্যবহার করে গাজার ভেতর অস্ত্র আসে। ইরান থেকে অস্ত্র, প্রশিক্ষণ ও অর্থ পৌঁছে যায় এ অঞ্চলের অন্যান্য দেশেও। তেহরান থেকে সহায়তা পায় লেবানন, সিরিয়া, ইরাক, ইয়েমেন ও গাজার প্রত্যেকেই৷
দামেস্কের ইরানি দূতাবাসে ১৯৮২ সালে হিজবুল্লাহর সূচনা হয়। এর আগে ১৯৭৫ এ লেবাননে হামলা করে ইসরায়েল। ১৯৭৫-৯০ সাল পর্যন্ত সেখানে চলে গৃহযুদ্ধ।
হামাসের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র রয়টার্সকে জানায়, ১৯৯২ সালে হামাসের ৪০০ সদস্যকে ইসরায়েল লেবাননে নির্বাসিত করার পর ইরান হামাসের সঙ্গে হাত মেলায়। ইরান ও হিজবুল্লাহ হামাসের সদস্যদের আশ্রয় দেয়, সামরিক প্রযুক্তিগত সহায়তা দেয় ও আত্মঘাতী বোমা হামলা করার প্রশিক্ষণও দেয়।
হামাসের মুখপাত্র বারাকা রয়টার্সকে জানান, ৭ অক্টোবরের হামলার মূল উদ্দেশ্য ছিল ইসরায়েলের জেলে থাকা পাঁচ হাজার ফিলিস্তিনির মুক্তির ব্যবস্থা করা, পবিত্র আল আকসা মসজিদে ইসরায়েলি আক্রমণ প্রতিরোধ এবং গাজায় ১৬ বছর ধরে চলা অবরোধের অবসান।
তিনি ইসরায়েলকে সতর্ক করে বলেন, যদি ইসরায়েল আমেরিকা ও ব্রিটেনের সহায়তা পায়, তবে এই যুদ্ধ শুধু গাজায় সীমাবদ্ধ থাকবে না; বরং, পুরো অঞ্চলজুড়ে ছড়িয়ে যাবে।
'এটি শুধুমাত্র গাজায় চলা ইসরায়েলি যুদ্ধ নয়, বরং সব পক্ষ মিলে গাজার বিরুদ্ধে আটলান্টিক অঞ্চলের যুদ্ধ; তাই এখানে নতুন ফ্রন্টলাইনের দেখা পাওয়া যাবে,' বলেন বারাকা।
গ্রন্থনায় মাহমুদ নেওয়াজ জয়
সূত্র: রয়টার্স
Comments