তিনি ছিলেন অনুপ্রেরণার উৎস

বলা হয়, একজন সফল দক্ষিণ এশীয় উদ্যোক্তা বিশ্বের যে কোনো জায়গায় ব্যবসা চালাতে পারবেন। কারণ, তাদের মধ্যে এই যাত্রার প্রায় প্রতিটি ধাপে বহুমুখী বাধা অতিক্রম করার দক্ষতা রয়েছে।

একজন নারী উদ্যোক্তার জন্য এই যাত্রা আরও কঠিন।

কিন্তু সব বাধা অতিক্রম করে একজন সফল ব্যবসায়ী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন বাংলাদেশের প্রথম খ্যাতিমান নারী উদ্যোক্তাদের একজন রোকিয়া আফজাল রহমান।

দেশের প্রথম নারী ব্যাংক ব্যবস্থাপক তিনি। ব্যাংকার হিসেবে তিনি ৭ বছর দায়িত্ব পালন করেছেন। বহু বছরে তিনি দেখে ফেলেছেন অর্থ ও বাণিজ্যের প্রায় পুরো দুনিয়াটাই।

১৯৮০ সালে রোকিয়া আফজাল রহমান কৃষি ব্যবসা শুরু করেন এবং অন্যান্য খাতেও তার ব্যবসা সম্প্রসারণ করেন। তিনি মিডিয়া, বিমা, রিয়েল এস্টেট এবং জ্বালানি খাতে ব্যবসা সম্প্রসারণ করেছিলেন।

কেবল নারী উদ্যোক্তাদের জন্য পথ প্রশস্ত করতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন তাই নয়, অনেক ব্যবসায়ী নারীর জন্য অনুপ্রেরণার উৎসও ছিলেন তিনি।

তিনি শত শত নারী উদ্যোক্তাদের আর্থিক সহায়তা ও পরামর্শ দিয়ে মেন্টরশিপের ভূমিকা পালন করেছেন।

১৯৯৪ সালে ১৫০ জন সদস্য নিয়ে 'উইমেন অন্ট্রোপ্রেনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ' গঠিত হয় এবং রোকিয়া আফজাল রহমান ছিলেন এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি।

১৯৯৬ সালে তিনি ক্ষুদ্র উদ্যোগ ও শিল্প গঠনে নারীদের আরও এগিয়ে নিতে 'উইমেন ইন স্মল এন্টারপ্রাইজেস' গঠন করেন।

এই ২টি সংগঠনই নারীদের জীবনে পরিবর্তন আনতে এবং নারী উদ্যোক্তা তৈরির মাধ্যমে তাদের ক্ষমতায়ন করতে কাজ করছে।

রোকিয়া আফজাল রহমান ২০০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত 'বাংলাদেশ ফেডারেশন অব উইমেন এন্টারপ্রেনারস'র প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন।

গতকাল বুধবার ভোরে সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ নোভেনা হাসপাতালে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন বিশিষ্ট উদ্যোক্তা রোকিয়া আফজাল রহমান

তার মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছে ব্যবসায়ী মহল।

ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বলেন, 'রোকিয়া আফজাল রহমান ছিলেন একজন পথপ্রদর্শক এবং অনেকের অনুপ্রেরণার উৎস। তার মৃত্যু দেশের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি।'

মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এমসিসিআই) সভাপতি মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, 'রোকিয়া আফজাল রহমান সত্যিকারের মানবিক গুণাবলীসম্পন্ন একজন দূরদর্শী ব্যবসায়ী নেতা ছিলেন। অথচ, বহু মানুষ এখন বস্তুবাদী।'

একজন ব্যবসায়ী নেতা হিসেবে রোকিয়া আফজাল রহমানের সঙ্গে স্মৃতি স্মরণ করে মো. সাইফুল ইসলাম টেলিফোনে দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'তার দূরদর্শিতা অতুলনীয় ছিল। তিনি ২০১৩ ও ২০১৪ সালে ২ মেয়াদে এমসিসিআইয়ের সভাপতিও ছিলেন। তিনি মূল্যবোধ ও মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাকে লালন করেছেন, যা আজকাল বিরল।'

এমসিসিআইয়ের সভাপতি থাকাকালীন এর ১১০তম বার্ষিকী উদযাপনের সময় বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের অগ্রগতির চিত্র তুলে ধরতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন রোকিয়া আফজাল রহমান। ওই আয়োজনে প্রধান অতিথি ছিলেন ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি এপিজে আব্দুল কালাম।

বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সাবেক সভাপতি এবং এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর ওমেনের উপাচার্য ড. রুবানা হক বলেন, 'তিনি নম্রতার অপর নাম। রোকিয়া আপা আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন তার সহমর্মিতার কারণে।'

রোকিয়া আফজাল রহমান ছিলেন মাইক্রো ইন্ডাস্ট্রিজ ডেভেলপমেন্ট অ্যাসিসট্যান্স অ্যান্ড সার্ভিসেসের (মাইডাস) একজন পরিচালক। মাইডাসের সাবেক চেয়ারপারসন পারভীন মাহমুদ বলেন, 'মাতৃস্নেহে সাহস যোগাতেন রোকিয়া আপা। তিনি আমার রোল মডেল।'

তিনি বলেন, 'মাইডাস যখন গঠন করা হয় তখন আহ্বায়কের দায়িত্ব নিতে রোকিয়া আপাই আমাকে উৎসাহ দিয়েছিলেন।'

ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি আবুল কাসেম খান বলেন, 'রোকিয়া আফজাল রহমান নিজে ছিলেন সাহসী এবং তিনি অন্যদের সাহস যোগাতেন। তার ট্রেডমার্ক ছিল হাসিমাখা মুখ। আমরা তাকে মিস করব। দেশ তার এক সোনার সন্তানকে হারাল।'

বাংলাদেশে কানাডিয়ান চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি মাসুদ রহমান বলেন, 'রোকিয়া আফজাল রহমান ছিলেন বাংলাদেশে নারী উদ্যোক্তার পথিকৃৎ। তিনি বহু নারী উদ্যোক্তাকে অনুপ্রাণিত করেছেন। আমি তার কাছ থেকে ইতিবাচক চিন্তা করতে শিখেছি।'

বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সাবেক সভাপতি ফজলুল হক বলেন, 'তিনি একজন মা কিংবা বড় বোনের মতোই যত্নশীল ছিলেন।'

ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স-বাংলাদেশের (আইসিসি-বি) বোর্ড সদস্য ফজলুল হক বলেন, 'তার মৃত্যুর খবর শুনে আমি স্তব্ধ হয়ে যাই। আমার কাছে তিনি ছিলেন মায়ের মতো। সব সময় আমার ও আমার পরিবারের সদস্যদের সার্বিক খোঁজ-খবর তিনি রাখতেন।'

'রোকিয়া আফজাল রহমান আইসিসি-বি এর সহসভাপতি ছিলেন। বোর্ড মিটিংয়ে আমরা নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছি,' যোগ করেন তিনি।

আইসিসি-বি এর সহসভাপতি ও এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি এ কে আজাদ বলেন, 'রোকিয়া আফজাল রহমান ছিলেন একজন সৎ উদ্যোক্তা। তার মাতৃসুলভ ও মানবিক গুণাবলী ছিল। তিনি কখনই কাউকে আঘাত করতেন না। সমাজে তার অপরিসীম অবদান রয়েছে।'

রোকিয়া আফজাল রহমান ব্র্যাকের বোর্ডেও দায়িত্ব পালন করেছেন এবং সুবিধাবঞ্চিত ও আর্থিকভাবে অত্যন্ত অসচ্ছলদের জন্য কাজ করা প্রতিষ্ঠান 'বাঁচতে শেখা'র চেয়ারপারসন ছিলেন।

তিনি ১৯৯২ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ৫ বছর 'মিনি মার্টস'র চেয়ারপারসন ছিলেন। বিভিন্ন ধরনের পণ্য বিক্রি করার জন্য একদল নারী উদ্যোক্তা মিনি মার্টস প্রতিষ্ঠা করেন। মধ্যস্বত্বভোগীদের সরিয়ে দেওয়া এবং ব্যবসায় নারী উদ্যোক্তাদের জন্য লাভের একটি অংশ রাখা ছিল এর একটি অন্যতম উদ্দেশ্য।

চিটাগাং উইমেন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (সিডাব্লিউসিসিআই) সভাপতি মনোয়ারা হাকিম আলী বলেন, 'রোকিয়া আফজাল রহমান বাংলাদেশের নারী উদ্যোক্তাদের পথপ্রদর্শক ছিলেন। তিনি আমাদের পথ দেখিয়েছেন। তিনি নারী উদ্যোক্তাদের খুব ভালোবাসতেন।'

মনোয়ারা বলেন, 'তিনি সবসময় মানুষের জন্য কাজ করার পরামর্শ দিতেন। নারীদের ব্যবসায়িক উদ্যোগের প্রতীক হয়ে তিনি আমাদের মাঝে থাকবেন।'

মাইডাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এএসএম মশি-উর-রহমান বলেন, 'যারা ব্যাংক ও ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ পান না, তাদের অর্থায়নের জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মাইডাস। রোকিয়া আফজাল রহমান সেই সময়ে নারী উদ্যোক্তাদের জন্য জামানতমুক্ত ঋণের ব্যবস্থা করেছিলেন, যখন ব্যাংকগুলো নারী উদ্যোক্তাদের অর্থায়ন করত না। বাংলাদেশের নারী উদ্যোক্তাদের উন্নয়নে এত বেশি কাজ করা মানুষ রোকিয়া আফজাল রহমান ছাড়া আর কেউ নেই।'

 

Comments

The Daily Star  | English
COP29 protest

COP29 negotiations: The deadlock over cardinal issues

Developing countries require about $6-8 trillion a year for climate action but some analysts view this as sleight of hand accounting.

43m ago