রোকিয়া আফজাল রহমান: নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের আলোকবর্তিকা
সামাজিক অঙ্গনে তার সৌন্দর্য ও সৌম্য ভাবমূর্তি আলোচনার বিষয় ছিল। আমরা প্রায়ই ভাবতাম, কীভাবে তিনি সব ধরনের আচার-অনুষ্ঠানে এতোটা চৌকস ও নিখুঁতভাবে নিজেকে উপস্থাপন করতে পারেন। আমাদের অনেকের জন্য তিনি ছিলেন অনুপ্রেরণার উৎস। তিনি ছিলেন একজন দিকনির্দেশক, যার মাঝে ছিল দক্ষিণ এশীয় নারীদের মূল্যবোধ ও কৃষ্টি এবং একইসঙ্গে আধুনিক, প্রগতিশীল ও ভবিষ্যতমুখী চিন্তাধারা।
রোকিয়া আফজাল রহমান, যাকে আমরা আদর করে রোকি আপা ডাকতাম—৫ এপ্রিল ভোরে সবাইকে হতবাক ও শোকাভিভূত করে শান্তিপূর্ণভাবে পরপারে চলে গেছেন। তার প্রয়াণে সৃষ্ট অপূরণীয় ক্ষতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে এবং তার রেখে যাওয়া শূন্যস্থান পূরণে আমাদের দীর্ঘ সময় প্রয়োজন হবে।
স্বার্থপরতা ও প্রবল প্রতিযোগিতার আঘাতে ক্ষতবিক্ষত এ বিশ্বে তিনি একাত্মকরণের শক্তি হিসেবে নিজেকে আলাদা করে চিনিয়েছেন। তিনি ভিন্নমতাবলম্বী ও মতামতকে একই সূতায় গেঁথেছেন। নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের বিষয়টি তিনি তার হৃদয়ে ধারণ করতেন এবং এ বিষয়েও একাত্মবোধ সৃষ্টিতে রেখেছেন গুরুত্বপূর্ণ অবদান।
রোকিয়া আফজাল রহমান ১৯৬২ সালে ব্যাংকিংখাতে তার কর্মজীবন শুরু করেন। সে সময় খুব কম নারীই এ পেশায় ছিলেন। ১৯৬৪ সালে তিনি ছিলেন দেশের প্রথম নারী ব্যাংক ম্যানেজার। পরবর্তীতে তিনি ব্যবসার জগতে প্রবেশ করেন এবং দেশের সবচেয়ে সম্মানিত উদ্যোক্তাদের একজন হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন। এক পর্যায়ে দেশের ১১টি ভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশন ও মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি এবং মাইডাসের চেয়ারপার্সন পদেও তিনি নির্বাচিত হন।
তবে যে বিষয়টি তাকে অন্য সবার থেকে আলাদা করেছে তা হলো, নারীদের সহায়তা বা অর্থনৈতিক স্বাধীনতা এনে দিতে পারে, এমন সংস্থা গঠনের দিকে নজর দেওয়া। তিনি বিশ্বাস করতেন, নারীর মুক্তি তাদের অর্থনৈতিক সচ্ছলতার মধ্যে নিহিত। এই উদ্দেশ্য সফল করতে তিনি ১৯৯৪ সালে উইমেন অন্ট্রোপ্রেনার্স অ্যাসোসিয়েশন (ডব্লিউইএ) গঠন করেন। এই সংস্থার প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল ক্ষুদ্র ও অতিক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তাদের দক্ষতার উন্নয়ন ঘটানো, যাতে তারা আরও ভালো করে তাদের ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা করে সেখান থেকে সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জন করতে পারেন। ডব্লিউইএর মাধ্যমে হাজারো নারী আর্থিক ব্যবস্থাপনা, হিসাবরক্ষণ ও সফল ব্যবসায়ী হয়ে ওঠার প্রশিক্ষণ পেয়েছেন।
তিনি একইসঙ্গে ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠান ও শিল্পে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়াতে ও তাদেরকে এ খাতে আরও দক্ষ উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলতে উইমেন ইন স্মল এন্টারপ্রাইজ (ওয়াইজ) প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি প্রত্যন্ত অঞ্চলের গ্রামীণ নারীদের সঙ্গে কাজ করতেন এবং তাদেরকে দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র থেকে বের করে আর্থিক স্বাধীনতা অর্জনে সহায়তা করতেন। ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রে নারীরা যেসব সমস্যার সম্মুখীন হন, সেগুলো নিয়ে উচ্চকণ্ঠ হতে তিনি তাদেরকে অনুপ্রাণিত করতেন।
বাংলাদেশের ব্যবসায়িক জগতের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত থাকার ফলে রোকিয়া আফজাল রহমান নীতিমালায় এমন কিছু পরিবর্তন আনেন, যা নারীদের ঋণ পেতে ও দক্ষতার উন্নয়নে সহায়তা করে।
২০০৬ সালের আগস্টে তিনি বাংলাদেশ ফেডারেশন অব উইমেন অন্ট্রোপ্রেনারশিপের (বিএফডব্লিউই) গোড়াপত্তন করেন। এই ফেডারেশন ৫০ লাখ নারীর সঙ্গে কাজ করে, যাদের বেশিরভাগই ছোট শহর ও গ্রামে বসবাস করেন। এটা ছিল অসংখ্য নারীকে ক্ষুদ্র ব্যবসায় নিয়ে আসার একটি বড় উদ্যোগ। আজ সারা দেশে নারীর ক্ষুদ্র উদ্যোগের প্রসার ও সাফল্যের মূলে রয়েছে রোকিয়া আফজাল রহমানের অগ্রণী প্রচেষ্টা।
তার প্রয়াণে বাংলাদেশ আজ অন্যতম শীর্ষ নারী উদ্যোক্তাকে হারিয়েছে, যিনি শুধু নিজের ব্যবসারই প্রসার ঘটাননি, বরং নিরবচ্ছিন্নভাবে অন্যদের, বিশেষত নারীদের আত্মনির্ভরশীল করে তোলার জন্য কাজ করে গেছেন। তিনি এমন এক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখতেন, যেখানে বৈষম্য থাকবে না এবং সবাই আত্মসম্মান বজায় রেখে জীবনযাপন করতে পারবেন। তিনি একইসঙ্গে আঞ্চলিক সহযোগিতা ও এ অঞ্চলের সীমানা ছাড়িয়ে অন্যান্য দেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখার নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি সাউথ এশিয়ান উইমেনস নেটওয়ার্কের (এসডব্লিউএএন) একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন।
রোকি আপা, আপনার অনুপস্থিতি আমরা সবাই অনুভব করবো, কিন্তু আপনার রেখে যাওয়া নারীর আর্থিক ক্ষমতায়নের উদ্যোগগুলো আজীবন বেঁচে থাকবে। আপনি এমন কিছু সংস্থা রেখে গেছেন, যেগুলো আপনার অসামান্য কাজকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবে। ব্যক্তিগতভাবে বলতে গেলে, আমি ও আমার পরিবার আপনার স্নেহ, ভালোবাসা ও হাসিমাখা মাধুর্য সর্বদা মিস করবো। আপনি সবকিছু অন্যদের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া ও তাদেরকে সহায়তা করার মতাদর্শে বিশ্বাসী থেকে জীবন কাটিয়েছেন। আপনার আত্মার শান্তি কামনা করি।
Comments