জলাতঙ্কের টিকা ঘাটতির মধ্যেই চট্টগ্রামে পোষা প্রাণীর কামড়ে আক্রান্ত বাড়ছে
পোষা প্রাণীর কামড়ে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে চট্টগ্রামে। কিন্তু প্রয়োজনীয় টিকার ঘাটতি থাকায় চাপের মুখে পড়েছে হাসপাতালগুলো।
চট্টগ্রামে দুটি হাসপাতাল—চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল (সিজিএইচ) ও ফৌজদারহাটে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজেস (বিআইটিআইডি) হাসপাতালে রোগীদের বিনামূল্যে জলাতঙ্ক রোগের টিকা দেওয়া হয়।
দুই হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, পাঁচ বছর আগেও পোষা প্রাণীর কামড়ে অসুস্থ রোগীর চেয়ে অন্যান্য পশুর কামড়ের রোগীর সংখ্যা অনেক বেশি ছিল, যার অনুপাত প্রায় ৮০:২০।
তবে, এই অনুপাত এখন অনেকখানি পরিবর্তন হয়েছে। পোষা প্রাণীর কামড়ের রোগীর হার এখন মোট রোগীর প্রায় ৭০ শতাংশ।
এই পরিবর্তনের কারণে জলাতঙ্ক রোগের টিকার চাহিদা অনেক বেড়েছে, যা হাসপাতালের ওপর প্রচণ্ড চাপ তৈরি করেছে।
গত শনিবার ও রোববার চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে কোনো টিকা ছিল না। রোগীদের বাধ্য হয়ে বাইরে থেকে টিকা কিনতে হয়। এতে তুলনামূলক দরিদ্র রোগীদের ওপর বাড়তি চাপ হয়।
গত সপ্তাহে স্থানীয় বাসিন্দা রাশেদা আক্তারের ১০ বছর বয়সী সন্তানকে কুকুর কামড়ালে তিনি বাচ্চাকে নিয়ে যান চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে। কিন্তু হাসপাতালে গিয়েই তিনি হতাশ হয়ে যান। তাকে বলা হয়, 'হাসপাতালে জলাতঙ্কের টিকা ফুরিয়ে গেছে।'
রাশেদা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ডাক্তাররা বললেন বাইরে থেকে টিকা কিনতে। আমার স্বামী রিকশাচালক। কীভাবে টিকা কিনব?'
জলাতঙ্কের টিকার দামের কথা ভেবেই তিনি হতাশ হয়ে পড়েন।
হাসপাতালের মূল ফটকে নোটিশ টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছে, জলাতঙ্কের টিকা সরবরাহ সাময়িকভাবে বন্ধ। রোগীদের বাইরে থেকে টিকা কিনতে হবে।
যোগাযোগ করা হলে চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসা কর্মকর্তা রূপা দত্ত ডেইলি স্টারকেবলেন, 'যখন হাসপাতালে ভ্যাকসিন সরবরাহ থাকে না, তখন রোগীদের নোটিশ দিয়ে জানানো হয়।'
তবে দুই দিন পর সোমবার থেকে আবার হাসপাতালে বিনামূল্যে জলাতঙ্কের টিকাদান শুরু হয় বলে জানা গেছে।
সূত্র জানায়, এ হাসপাতালে প্রায় প্রতিমাসেই জলাতঙ্ক টিকার ঘাটতি দেখা দেয়। গত অক্টোবরে প্রায় ১০ দিন ভ্যাকসিন ছিল না হাসপাতালে।
এই ঘাটতির কারণে এ অঞ্চলে জলাতঙ্কে আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধির সম্ভাবনা নিয়েও উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।
সাধারণত কুকুর, বিড়াল, গবাদি পশু ও বন্যপ্রাণীর কামড়ে জলাতঙ্ক ছড়ায়। সময়মতো টিকাদানই এই রোগ প্রতিরোধের একমাত্র কার্যকর উপায়।
বাজারে জলাতঙ্ক রোগের টিকার এক ডোজ ৪৫০ টাকায় বিক্রি হয় বলে জানা গেছে।
জেনারেল হাসপাতালের সুপারিনটেনডেন্ট ডা. আব্দুল মান্নান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কোনো প্রাণী কামড়ালে মোট তিনটি টিকা নিতে হয়। প্রথম দিন একটি, তৃতীয় দিন দ্বিতীয়টি এবং কামড়ানোর সপ্তম দিনে তৃতীয়টি।'
তিনি আরও বলেন, 'আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে ক্যাটাগরি-৩ এবং তীব্র ক্যাটাগরি-২ এর অনেক রোগীকে জলাতঙ্ক রোগ প্রতিরোধক ইমিউনোগ্লোবুলিন নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।'
'সাধারণত আমাদের হাসপাতালে এগুলো বিনামূল্যে দেওয়া হয়। কিন্তু সরবরাহ ঘাটতির কারণে মাঝে মাঝে সংকট দেখা দেয় এবং তখন রোগীদের বাইরে থেকে কিনতে হয়,' বলেন তিনি।
বাজারে জলাতঙ্ক রোগ প্রতিরোধক ইমিউনোগ্লোবুলিনের এক ভায়াল ৭০০ টাকায় বিক্রি হয় বলে জানা গেছে।
টিকার ঘাটতি সম্পর্কে জানতে চাইলে ডা. মান্নান বলেন, 'কেন্দ্রীয় ঔষধাগার থেকে চাহিদা অনুযায়ী টিকা পাওয়া যাচ্ছে না। আমাদের প্রতিদিন ৬০টি টিকা প্রয়োজন হয়। কিন্তু চাহিদা অনুযায়ী টিকা পাওয়া যায় না।'
'আমরা ৫ হাজার টিকার রিকুইজিশন দিলে পাই ৭০০ থেকে এক হাজার,' বলেন তিনি।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের সহকারী পরিচালক ডা. নজরুল ইসলাম জানান, তারা টিকার রেশনিং করেন না।
তিনি বলেন, 'আমরা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের চাহিদা অনুযায়ী হাসপাতালগুলোতে টিকা বিতরণ করি।'
টিকার সরবরাহের ঘাটতি সম্পর্কে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) ফরহাদ হোসেন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এইচপিএনএসপি প্রকল্পের আওতায় টিকা কেনা হয়েছিল। গত বছরের জুলাই মাসে প্রকল্প শেষ হওয়ায়, টিকা পেতে দেরি হচ্ছে।'
'তবে সম্প্রতি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে টিকা কেনার জন্য একটি জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয় এবং সভায় সরকারের সরাসরি তহবিলের মাধ্যমে টিকা কেনার সিদ্ধান্ত হয়,' বলেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, 'টেন্ডারও হয়েছে এবং আমরা খুব শিগগির টিকা পাব। আমাদের স্টোরে কিছু টিকা আছে যা এর মধ্যে চাহিদা পূরণ করবে।'
পোষা প্রাণীর কামড় বৃদ্ধি
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চট্টগ্রামে পোষা প্রাণীর কামড়ের ঘটনা অনেক বেড়েছে। এতে শুধু নগরের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর চাপ তৈরি হয়েছে তা নয়, বরং সচেতনতা বৃদ্ধি ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজনীয়তাও দেখা দিয়েছে।
চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের সুপারিনটেনডেন্ট ডা. আব্দুল মান্নান এই বাস্তবতার বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে বলেন, 'প্রাণীর কামড়ে অসুস্থ মোট রোগীর প্রায় ৭০ শতাংশ এখন পোষা প্রাণীর কামড়ের শিকার। আগে, পোষা প্রাণীর কামড়ের অনুপাত ছিল ২০ এবং অন্য প্রাণীর কামড় ছিল ৮০।'
এ সংক্রান্ত পরিসংখ্যানও একইরকম চিত্র তুলে ধরে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজেস (বিআইটিআইডি) হাসপাতালে গত বছর জলাতঙ্কের টিকা নেওয়া ১৩ হাজার জনের মধ্যে ৯ হাজারের বেশি পোষা প্রাণীর কামড়ের শিকার।
বিআইটিআইডির পরিচালক ডা. শাখাওয়াত উল্লাহ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বর্তমানে আমাদের টিকার ঘাটতি নেই। কিন্তু, টিকা সরবরাহের স্বল্পতার মধ্যে রোগীর সংখ্যা বাড়ায় আমরা প্রায়ই সমস্যার মধ্যে পড়ি।'
একই পরিস্থিতি জেনারেল হাসপাতালে। সেখানে গত বছর জলাতঙ্কের টিকা দেওয়া ২৩ হাজার ৯৮৩ জনের মধ্যে ১৬ হাজার ৬৩২ জন পোষা প্রাণীর কামড়ের শিকার, যা প্রায় ৬৯ দশমিক ৩৪ শতাংশ।
এ বছরের প্রথম কয়েক সপ্তাহে এই প্রবণতা অব্যাহত ছিল। গত ২১-২৭ জানুয়ারি জেনারেল হাসপাতালের তথ্যও একইরকম। জলাতঙ্কের টিকা দেওয়া ৫৪০ জনের মধ্যে ৬৩ শতাংশের বেশি পোষা প্রাণীর কামড়ের শিকার।
জলাতঙ্কের ঝুঁকি কমাতে ও জনসাধারণের নিরাপত্তা ও কল্যাণ নিশ্চিতে সচেতনতা বৃদ্ধি, পোষা প্রাণীর প্রপ্তি দায়িত্বশীলতা বৃদ্ধি ও জলাতঙ্ক টিকা সহজলভ্য করা প্রয়োজন বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
যোগাযোগ করা হলে চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড ভেটেরিনারি পাবলিক হেলথ বিভাগের অধ্যাপক ড. পরিতোষ কুমার বিশ্বাস ডেইলি স্টারকে বলেন, 'পোষা প্রাণীকে টিকা দেওয়া হলে জলাতঙ্ক সংক্রমণের ঝুঁকি যথেষ্ট কমলেও এটি পরিপূর্ণ সুরক্ষার নিশ্চয়তা দেয় না।'
'কোনো পোষা প্রাণীকে টিকা দেওয়া হলেও, সেটি কামড় দিলে বা আঁচড় দিলে জলাতঙ্ক সংক্রমণের সম্ভাবনা থাকে। সুতরাং, পোষা প্রাণীকে টিকা দেওয়া হোক বা না হোক, প্রাণীর কামড় বা আঁচড় দিলে যে কারও জন্য টিকা নেওয়াসহ তাৎক্ষণিক চিকিৎসা নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ,' বলেন তিনি।
প্রত্যন্ত অঞ্চলে টিকাদান কেন্দ্রের অভাব জলাতঙ্কের ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে তোলে। যদিও, চট্টগ্রামে একটি সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং ১৫টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে জলাতঙ্কের টিকা নেই। এতে প্রত্যন্ত অঞ্চলের বাসিন্দাদের এই চিকিৎসার সুযোগ সীমিত।
যোগাযোগ করা হলে চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. জাহাঙ্গীর আলম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'জলাতঙ্কের টিকা বর্তমানে শুধুমাত্র জেনারেল হাসপাতাল ও বিআইটিআইডিতে বিনামূল্যে পাওয়া যায়।'
টিকা সরবরাহের আওতা বাড়ানো ও সব উপজেলায় টিকা সরবরাহের প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'এ বিষয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলব।'
যোগাযোগ করা হলে চট্টগ্রাম জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মোঃ আলমগীর বলেন, 'সম্প্রতি নগরীর বাসিন্দাদের মধ্যে পোষা প্রাণী রাখার প্রবণতা বেড়েছে। বর্তমানে চট্টগ্রামে প্রায় ১ লাখ পোষা প্রাণী আছে, পাঁচ বছর আগে এই সংখ্যা ছিল মাত্র ৫ হাজার।'
Comments