মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বর্তমান সরকার ব্যবসা করছে: জি এম কাদের
স্বাধীনতার চেতনা, মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বর্তমান সরকার ব্যবসা করছে বলে মন্তব্য করেছেন সংসদে বিরোধী দলীয় নেতা ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের।
স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে আজ মঙ্গলবার রাজধানীর বনানী কার্যালয়ে আয়োজিত আলোচনা সভায় তিনি এ কথা বলেন।
স্বাধীনতা যুদ্ধের চেতনা হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ বাস্তবায়ন করেছিলেন, এর আগে কেউ করেনি মন্তব্য করে কাদের বলেন, 'স্বাধীনতার যে মূল চেতনা এবং যাদের মূল্যায়ন করা দরকার; মুক্তিযোদ্ধাদের উনি তালিকা করেছিলেন। উনি আমাকে একদিন দুঃখ করে বলেছিলেন যে, অনেক খুঁজে খুঁজে গ্রামে-গঞ্জে বিরাট টিম পাঠিয়ে আমি মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজে খুঁজে বের করেছি। নাম্বারটা মনে নাই, ৭০ হাজার বা কত হাজার উনি করতে পেরেছিলেন। তার চেয়ে বেশি উনি করতে পারেন নাই। উনি একদিন দুঃখ করে বলেছিলেন, উনি মারা যাওয়ার কিছু দিন আগে যে, এত মুক্তিযোদ্ধার তালিকা আসছে কোথা থেকে!
'আমি তো মুক্তিযুদ্ধে পরে গ্রামে গ্রামে মানুষ পাঠিয়ে, বিভিন্নভাবে, আমাদের এজেন্সিগুলোকে পাঠিয়ে খুঁজে খুঁজে বের করে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা করেছিলাম। এখন তো দেখছি তার চেয়ে তিনগুণ সংখ্যা মুক্তিযোদ্ধার। সেই মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ৫০ বছর হয়নি, ৫১ বছরের বেশি স্বাধীনতার—সে মুক্তিযোদ্ধা। এগুলো চলছে এবং এগুলোকে বাতিল করতে পারবেন না। আদেশ করা হয়েছে এমনভাবে যে এটা বাতিলযোগ্য নয়। (১৯৭১ সালে) তিন বছর বয়স যার, সে মুক্তিযোদ্ধা। এক বছর বয়স, সে মুক্তিযোদ্ধা। এগুলো কি মুক্তিযুদ্ধে চেতনা? এগুলো কি স্বাধীনতার চেতনা,' প্রশ্ন রাখেন তিনি।
কাদের বলেন, 'এগুলো করা হয়েছে বৈষম্য সৃষ্টির জন্য। এরশাদ সাহেব এটা দূর করার চেষ্টা করেছিলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য প্রতিটি জেলায় অফিস করার জায়গা দিয়েছিলেন, অফিস করে দিয়েছিলেন। মুক্তিযোদ্ধা সংসদ করেছিলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য চাকরি-বাকরির ব্যবস্থা করেছিলেন। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তানদের ভাতা দেওয়া শুরু করেছিলেন উনি। কিন্তু উনি উনাদের দিয়ে উনার দলীয় কাজ করান নাই। উনি দলীয়করণ করেন নাই মুক্তিযোদ্ধাদের। বর্তমান সরকার মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের দলীয়করণ করেছে।'
তিনি বলেন, 'তারা (আওয়ামী লীগ) নিজেদের লোককে মুক্তিযোদ্ধা বানিয়েছেন এবং তাদের মাধ্যমে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দিয়ে একটি সুবিধাবাদী গোষ্ঠী তৈরি করেছেন। তারা বিভিন্ন জায়গায় সরকারের জন্য লাঠি ধরছে। লাঠিয়াল হয়ে গেছে। এটা তো মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হতে পারে না!'
বৈষম্য ও লুণ্ঠন এখানো আছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, 'আগে পাকিস্তান নিয়ে যেত। এখন লুণ্ঠন হচ্ছে না? খবরের কাগজ দেখেন। সব জায়গায় দেখেন। দেশের ব্যাংক খালি হয়ে যাচ্ছে, আর টাকা লুণ্ঠন হচ্ছে। হিসাবহীনভাবে।'
কাদের বলেন, 'এই স্বাধীনতার যেগুলো কথা ছিল, যে চেতনা ছিল, সেটা নিয়ে ব্যবসা করছে আমাদের বর্তমান সরকার। স্বাধীনতার চেতনা, মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধ—এগুলো নিয়ে বর্তমান সরকার ব্যবসা করছে। নিজেদের স্বার্থে এগুলোকে ব্যবহার করছে।'
তিনি বলেন, 'শিকড় থেকে দেখছেন না। গাছের কাণ্ড থেকে ফল দেখছেন। শিকড় না থাকলে তো গাছ হতো না, আর গাছ না থাকলে ফল হতো না। সেই শিকড়কে ভুলে গেছেন। কত মানুষ জীবন দিয়েছে। কত মানুষের কত ত্যাগ তিতিক্ষা আছে। এই মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রাম তো আজকে থেকে শুরু হয়নি! ভাষা আন্দোলন; সেখানেও তারা মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। কীসের মুক্তি? বৈষম্য থেকে মুক্তি। তারপর স্বাধীনতার সময় যখন দেখা গেল, আমরা স্বায়ত্ত শাসন পাচ্ছি না, বৈষম্য থেকে মুক্তি পাচ্ছি না, তখন মানুষ অস্ত্র ধরল—দেশ চাই, আমার দেশ। যেটা হবে আমার দেশ, প্রজাতন্ত্র। আমি প্রজা, আমাদের দেশ, আমার ক্ষমতা থাকবে। সকল ক্ষমতার উৎস হবো আমি, আমি দেশ চালাব। তাহলে আমাকে কেউ বৈষম্য করতে পারবে না। এটিই ছিল মানুষের আকাঙ্ক্ষা। এটি ছিল চেতনা মানুষের। সেই চেতনা কোথায়?
'দেশের সকল ক্ষমতার উৎস যদি জনগণ হয়, তাহলে তার সর্বোচ্চ ক্ষমতা হলো আমি তোমাকে নির্বাচিত করলাম, আমি তোমাকে নির্বাচিত করলাম না। এই ক্ষমতা কি বর্তমান জনগণের আছে? আমি চেয়েছিলাম বৈষম্যমুক্ত একটি সমাজ গঠন করব। সেই সমাজে আমি সবাইকে জবাবদিহি করব। রাজা থেকে শুরু করে প্রজা কেউ এর বাইরে যেতে পারবে না। যে যেটা করবেন তার জন্য জবাবদিহি করতে হবে,' বলেন তিনি।
কাদের বলেন, 'বিভিন্ন জায়গায় অপকর্ম হচ্ছে, সুশাসনের অভাব; অর্থ হলো আমাকে জবাবদিহি করতে হচ্ছে না। সরকার কেন করছেন না, জিনিসপত্রে দাম কেন কমাবেন না, কেন কমাতে চাইলেও করতে পারছেন না, কেন আগুন বন্ধ করতে পারছেন না, এখনো কেন ভেজাল বন্ধ করতে পারছেন না? কেননা তারা করছেন না। কেন করছেন না? কারণ করবার প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন নেই কেন? আপনাকে তো জবাবদিহি করতে হবে না! না করলে তো আপনাকে শাস্তি দেওয়ার ব্যবস্থা কোথাও করা যাচ্ছে না। সরকারকে সরকার থেকে সরিয়েও দেওয়া যাচ্ছে না। কাজেই শুনবার প্রয়োজন কী? শুনবার প্রয়োজন তো নেই। তাহলে আমরা কী অর্জন করলাম? আমরা কী পেলাম এই স্বাধীনতা থেকে এবং কোন দিকে যাচ্ছি সামনে?'
বিরোধী দলীয় এই নেতা আরও বলেন, 'জনগণের দেশ হবে, বৈষম্যমুক্ত দেশ হবে, দেশে আইনের শাসন থাকবে। আইনের চোখে সবাই সমান হবে। সবচেয়ে বড় যে জিনিসটা আমরা গণতন্ত্র থেকে পাই সেটা হলো সবাই আইনের চোখে সমান হবে। আমাদের দেশে আমরা এই জিনিসটি করতে পারছি না। একটি স্তরের পরে আমরা কথাও বলতে পারি না। সরকারের বিরুদ্ধে আমরা কোনো কথা বলতে গেলে, তাদের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের বিরুদ্ধে কথা বলতে গেলে বিভিন্ন ধরনের মামলা হয়। একেবারে আইন তৈরি করা হয়েছে, যে আইনে (মামলা) এটা করা যায়। কাজেই বৈধভাবে আমাদের দাবিয়ে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এটা কি স্বাধীন হলো? সেই দেশ স্বাধীন দেশ?'
তিনি আরও বলেন, 'সরকারের বিরুদ্ধে কথা বললে ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করা হচ্ছে। দেশের শত্রু, দেশদ্রোহিতার মামলা। একজন বিভিন্নভাবে দুর্নীতি করছে, দুর্নীতি ধরতে যান, বলবে তোমাকে ডকুমেন্টসহ, পেপারসহ দিতে হবে, না হলে তোমাকে জেল দেওয়া হবে। এভাবে আস্তে আস্তে মানুষের মুখ বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে মানুষকে কথা বলতে দেওয়া হচ্ছে না। যে জন্য, যে আকাঙ্ক্ষায় মানুষ স্বাধীনতা অর্জন করেছিল, যে আকাঙ্ক্ষা নিয়ে মানুষ স্বাধীনতা যুদ্ধ করেছিল, সেই আকাঙ্ক্ষা ছিল আমার নিজের একটি দেশ হবে। যেখানে আমি বৈষম্যের শিকার হবো না। যেখানে আমরা সকলে সমান থাকব। জবাবদিহিতার মধ্যে থাকব। সেই সমাজে আমি বসবাস করতে চাই, যার জন্য আমি জীবন দিতে গেছি। সেই সমাজ হয়নি। সেই সমাজের দিকে সামনে আমরা যাচ্ছি না, এটিই হলো দুর্ভাগ্যের বিষয়।
'আমি আস্তে আস্তে যাচ্ছি, হয়তো এখন না যাই ১০ বছর পরে যাব-২০ বছর পরে যাব—যদি সঠিক পথে যাই। যদি উল্টা পথে যাই, তাহলে প্রতি মুহূর্তে তো আমি দূরে সরে যাচ্ছি! আমার কাছে এটিই হলো দুঃখ। আমাদেরকে পথ ঠিক করতে হবে। আমাকে প্রথম বলতে হবে আমি প্রজাতন্ত্র। প্রজাদের শাসন করতে দিতে হবে, তাদেরকে ভোট দিতে দিতে হবে, তাদের নিজের নেতা নির্বাচিত করতে দিতে হবে। দেশ শাসনে তাদের জবাবদিহিতা করার ক্ষমতা দিতে হবে, তাহলেই তো আমি প্রজাতন্ত্র হলাম। তার পরে আমি দেখব কে খারাপ কাজ করছে, কে করছে না। যার দেখার দায়িত্ব সে করছে কি করছে না। কেন করছে না? না করলে সে থাকবে নাকি থাকবে না। সেই ক্ষমতা যখন থাকবে, তখন আমি সত্যিকার অর্থে স্বাধীনতার সুফল এবং সত্যিকার অর্থে স্বাধীনতার চেতনা আমি বাস্তবায়ন করব,' যোগ করেন তিনি।
সরকার বৈষম্য সৃষ্টি করেছে অভিযোগ করে কাদের বলেন, 'সুবিধাবাদী ২২ পরিবার থেকে ২২ হাজার পরিবার হয়েছে। টাকার অভাব নেই। পাঁচ টাকার জিনিস ৫০০ টাকায়, পাঁচ হাজার টাকায় কেনার লোক আছে। দেশ তো ধনী দেশ, এটা বলে বেড়ানো হচ্ছে। রাস্তায় হাজার হাজার গাড়ি, এটা বলে বেড়ানো হচ্ছে। কীসের গরিব দেশ! ওই লোকের জন্য গরিব দেশ নয়। দেশের বেশির ভাগ মানুষের জন্য গরিব দেশ। বেশির ভাগ মানুষ এখন অনিশ্চয়তায় দিন কাটাচ্ছে। বেশির ভাগ মানুষ কালকে কীভাবে থাকবে তা জানে না। বেশির ভাগ মানুষ কালকে বেঁচে থাকবে কি না জানে না। বেশির ভাগ মানুষ তার সহায়-সম্পত্তি থাকবে কি না তা জানে না। আপনার বাড়ি-ঘর আজকে ঠিক আছে, কালকে থাকবে কি না কেউ জানে না। বাড়িটা কেউ দখল করে যদি নিয়ে যায় এবং তারপর আপনি কোথাও বিচার করতে গেলে পাবেন না। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, এগুলো নিয়ে অনেকে আমার কাছে অভিযোগ করতে আসে যে, বাড়ি-ঘর দখল হয়ে গেছে। এখন কেস করতে যাচ্ছি, কেউ কেস নিচ্ছে না। উকিলরা ভয় করে, কেননা এখানে প্রভাবশালী মহল জড়িত।'
রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের যে চরিত্র থাকার কথা সেখান থেকে তারা দূরে সরে আসছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, 'আমরা কখনোই কেউ বিপ্লব চাই না, আমরা সহিংসতা চাই না। আমরা চাই না, যুক্তিতর্কের বাইরে গায়ের জোরে কোনো কিছু অর্জন করা হোক। কিন্তু গায়ের জোরে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করলে গায়ের জোর ছাড়া এর কোনো উপায় থাকে না। এটি হলো বাস্তবতা।'
Comments