উত্তপ্ত নারায়ণগঞ্জে চলছে রাজনীতির ‘খেলা’
নারায়ণগঞ্জে রাজনীতির পরিবেশ এখন উত্তপ্ত। আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী সংসদ সদস্য শামীম ওসমানের 'ঘণ্টা বাজানোর' সমাবেশ ও 'খেলা হবে' ঘোষণার পর খোদ তার দলের ভেতরেই চলছে পাল্টাপাল্টি বাক্য বিনিময়। এ ব্যাপারে মুখ খুলেছেন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভীও।
অন্যদিকে বিএনপি নেতারা বলছেন, আওয়ামী লীগ দলীয় কোন্দলে জড়িয়ে নিজেরা মাঠে না নেমে পুলিশ দিয়ে 'খেলছে'।
গত ১ সেপ্টেম্বর বিএনপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে দলীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে যুবদলকর্মী শাওন প্রধান নিহত হওয়ার পর এই উত্তেজনার পারদ যেন বেড়েই চলেছে। কারণ আওয়ামী লীগও শাওনকে নিজেদের কর্মী বলে দাবি করছে।
এরমধ্যে বিএনপির নেতা-কর্মীদের আসামি করে শাওনের পরিবারের পক্ষ থেকে মামলা করার যে প্রচারণা চালানো হয়েছে, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। শাওনের পরিবারের সদস্যরা বলছেন, তারা মামলার ব্যাপারে কিছু জানেন না। তাদের কাছ থেকে আগে থেকেই তৈরি করা কাগজে সই নেওয়া হয়েছে কেবল।
এদিকে এই ঘটনায় পুলিশকে বিবাদী করে দায়ের করা বিএনপির মামলা খারিজ করে দিয়েছেন আদালত। গ্রেপ্তার হয়েছেন নারায়ণগঞ্জ জেলা ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি জাকির খান। অন্য নেতা-কর্মীরাও আছেন গ্রেপ্তার আতঙ্কে।
সবমিলিয়ে নারায়ণগঞ্জের স্থানীয় রাজনীতি এখন বেশ সরগরম।
গ্রেপ্তার আতঙ্কে বিএনপি নেতা-কর্মীরা
১ সেপ্টেম্বর পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে যুবদলকর্মী শাওন প্রধান নিহত হওয়ার পর থেকেই গ্রেপ্তার আতঙ্কে আছেন বিএনপির নেতা-কর্মীরা।
সেদিন মধ্যরাতে কড়া পুলিশি পাহারায় হস্তান্তরের পৌনে এক ঘণ্টার মধ্যে তড়িঘড়ি করে শাওনের লাশ দাফন করা হয়।
এর আগে রাত সাড়ে ১২টার দিকে নারায়ণগঞ্জ জেনারেল (ভিক্টোরিয়া) হাসপাতালে বিপুলসংখ্যক পুলিশ ও জেলা গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) পুলিশের উপস্থিতিতে নিহত শাওনের বড় ভাই মিলন প্রধান ও মামা মোতাহার হোসেনের কাছে লাশ হস্তান্তর করে পুলিশ। পরে পুলিশ ও জেলা গোয়েন্দা পুলিশের পাহারায় শাওনের লাশ বাড়িতে নেওয়া হয়।
এদিন রাতেই শাওনের বড় ভাই মিলন প্রধান বাদী হয়ে নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানায় একটি হত্যা মামলা করেন বলে পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়। তবে মামলার পর থেকেই মিলন আত্মগোপনে আছেন। তার মোবাইল ফোনটিও বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।
শাওনের আরেক ভাই ফরহাদ হোসেনের দাবি, তারা কোনো মামলা করেননি। শাওনের মরদেহ বুঝিয়ে দেওয়ার সময় পুলিশ থানায় ডেকে তাদের কাছ থেকে ৩টি সাদা কাগজে সই নিয়েছিল।
সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আনিচুর রহমান এ অভিযোগ অস্বীকার করে ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বাদী নিজেই বাইরে থেকে মামলার এজাহার লিখে এনেছেন। আমরা জোর করিনি।'
এই সংঘর্ষের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ২ সেপ্টেম্বর ৭১ জনের নাম উল্লেখ করে ও অজ্ঞাতনামা ৫ হাজার জনকে আসামি করে আরেকটি মামলা করে পুলিশ। বিপরীতে ৪ সেপ্টেম্বর গোয়েন্দা পুলিশের উপপরিদর্শক মাহফুজুর কনকসহ ৪২ জনের নাম উল্লেখ করে বিএনপির একটি মামলার আবেদন খারিজ করে দেন আদালত।
বিএনপির বিরুদ্ধে পুলিশের মামলায় জেলা বিএনপির আহবায়ক ও সদস্য সচিবসহ বিভিন্ন পর্যায়ের যে ৭১ জন নেতা-কর্মীর নাম উল্লেখ করা হয়েছে, তারা সবাই এখন পলাতক।
এ বিষয়ে নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির যুগ্ম-আহবায়ক নাসির উদ্দীন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমাদের অসংখ্য নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হয়েছে। এখন হাইকোর্ট বন্ধ থাকায় আমরা চেষ্টা করছি ভ্যাকেশন কোর্টের মাধ্যমে নেতা-কর্মীদের জামিনের ব্যবস্থা করতে। আমরা মাঠে সংগ্রাম করছি, সংগ্রাম চালিয়ে যাব। আওয়ামী লীগ বারবার বলে খেলা হবে। কিন্তু তারা নিজেরা মাঠে না নেমে পুলিশকে মাঠে নামায়। কারণ আওয়ামী লীগ অন্তঃকোন্দলে ব্যস্ত।'
নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপির সহ-সভাপতি সরকার হুমায়ুন কবিরের বক্তব্য, 'আমরা সেদিন শান্তিপূর্ণভাবে মিছিল করছিলাম। প্রশাসনের লোকজন অহেতুক আমাদের ওপর হামলা করেছে। তাদের হামলার কারণে আমাদের এক ছেলেও মারা গেছে। আওয়ামী লীগ লাশ নিয়েও রাজনীতি করে। আমরা জনগণের রাজনীতি করি।'
আবারও আইভী-শামীম টক্কর
নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে শামীম ওসমান ও সেলিনা হায়াৎ আইভীর বিরোধ অনেক পুরোনো। গত ২৭ আগস্ট শহরে শামীম ওসমানের সমাবেশের পর সেই বিরোধ আবারও সামনে এসেছে।
শামীম ওসমানের ডাকা ওই সমাবেশে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল হাই, মহানগরের সভাপতি আনোয়ার হোসেন এবং জেলার সহ-সভাপতি সেলিনা হায়াৎ আইভীসহ দলের বড় একটি অংশ উপস্থিত হননি।
ওই সমাবেশে শামীম ওসমান বিএনপিকে উদ্দেশ্য করে 'খেলা হবে' ঘোষণা দিয়ে বলেন, 'আপনারা খেলবেন বাংলাদেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্র করতে, আর আমরা খেলব ষড়যন্ত্র ভেস্তে দিতে। আর যদি মনে করেন সেই খেলায় জিতবেন, তাহলে তারিখ দেন। সেদিন খেলি।'
এর ২ দিনের মাথায় ৩০ আগস্ট নারায়ণগঞ্জ জেলা শ্রমিক লীগের উদ্যোগে শোক দিবসের অনুষ্ঠানে মেয়র আইভী বক্তব্য দেন। সেখানে কারও নাম উল্লেখ না করে তিনি বলেন, 'এত বড় সমাবেশ করলেন। আপনি টাকার বিনিময়ে মানুষকে দলে নিয়ে আসেন, আবার টাকার বিনিময়ে মানুষকে আপনি ক্ষতি করেন। এই কাজ থেকে বিরত থাকুন। আপনার ভয়ে অনেকে আমাদের সঙ্গে এসে কাজ করতে সাহস পায় না। দলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিভেদ তৈরি করেন আপনি।'
এ সময় ওয়ান ইলেভেন নামে পরিচিতি পাওয়া ২০০৭ সালের জরুরি অবস্থার কথা উল্লেখ করে আইভী আরও বলেন, 'ওয়ান ইলেভেনে যখন নেত্রীকে (শেখ হাসিনা) গ্রেপ্তার করল, তখন তো আমি কোন বড় নেতাকে দেখি নাই এই শহরে।'
বক্তব্যে আইভী কারও নাম উল্লেখ না করলেও ওই সভায় উপস্থিত থাকা থাকা জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সেদিন মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভীর বক্তব্যটি মূলত আমাদের এমপি শামীম ওসমানকে উদ্দেশ্য করে দেওয়া।'
এরপর ৩ সেপ্টেম্বর শেখ রাসেল স্টেডিয়ামে আয়োজিত সোনারগাঁ আওয়ামী লীগের ত্রি-বার্ষিক সম্মেলনে একই মঞ্চে ছিলেন আইভী ও শামীম ওসমান।
সেদিন শামীম ওসমান বলেন, 'কয়েকদিন আগে নারায়ণগঞ্জে জনসভা ডেকেছিলাম। সেটা অনেকেরই পছন্দ হয়নি। ভাইয়ে ভাইয়ে অনেক বিরোধ থাকে। সকলের কাছে অনুরোধ জানাতে চাই, আসুন ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত আমরা এক থাকি। কারণ বাংলাদেশ বাঁচাতে হবে। সেজন্য শেখ হাসিনাকে বাঁচাতে হবে। আমরা খেলব সব অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে।'
একই মঞ্চ থেকে সেদিন আইভী বলেন, 'এখন অনেকেই অমুক ভাই, তমুক ভাইয়ের নামে শ্লোগান দেয়। কিন্তু ক্ষমতা না থাকলে আর কেউ থাকে না। সব ভাই ভেসে যাবেন শেখ হাসিনা না থাকলে। তাই শ্লোগান দিতে হবে আমাদের দলের ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নামে।'
সামগ্রিক বিষয়ে নারায়ণগঞ্জ জেলা পরিষদের প্রশাসক ও মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেনের ভাষ্য, 'নারায়ণগঞ্জের (রাজনৈতিক) পরিস্থিতি বর্তমানে ঠাণ্ডা আছে। ১ সেপ্টেম্বর যে ঘটনা ঘটেছে তা অন্য বিষয়। যেকোনো রাজনৈতিক দলেরই আন্দোলন-সংগ্রাম করার অধিকার আছে। তবে আন্দোলনের নামে বিশৃঙ্খলা করলে পুলিশ বিশৃঙ্খলকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেই।'
একই ধরনের মতামত দেন আওয়ামী লীগের জাতীয় পরিষদের সদস্য অ্যাডভোকেট আনিসুর রহমান ও নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম।
Comments