বইমেলায় ‘সেরা লেখক’ স্বীকৃতির আয়োজনের প্রস্তাব প্রধান উপদেষ্টার

বাংলা একাডেমিতে অমর একুশে বইমেলা-২০২৫ এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ছবি: পিআইডি

বইমেলায় প্রতিবছর বিষয়ভিত্তিক 'সেরা লেখক' স্বীকৃতির আয়োজনের প্রস্তাব দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

আজ শনিবার বিকেলে রাজধানীর বাংলা একাডেমিতে অমর একুশে বইমেলা-২০২৫ এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি এ প্রস্তাব দেন।

এসময় প্রধান উপদেষ্টা বলেন, 'গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে জাতির ঘাড়ে দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে চেপে থাকা স্বৈরাচারী সরকারের পতন ঘটেছে। আমাদের সাহসী তরুণদের এই অভূতপূর্ব আত্মত্যাগ বিশ্বকে চমকে দিয়েছে। এই বিজয়ের মাধ্যমে এসেছে নতুন বাংলাদেশ গড়ার ইস্পাত কঠোর প্রতিজ্ঞা।'

তিনি বলেন, 'মহান আত্মত্যাগের মাধ্যমে অর্জিত অভ্যুত্থান এবারের বইমেলা নতুন তাৎপর্য নিয়ে আমাদের সামনে এসেছে। এবারের বইমেলার প্রতিপাদ্য জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থান এবং তার মাধ্যমে নতুন বাংলাদেশের বিনির্মাণ। বরাবরই একুশে মানে জেগে উঠা। একুশে মানে আত্মপরিচয়ের সঙ্গে মুখোমুখি হওয়া। একুশে মানে অবিরাম সংগ্রাম। নিজের পরিধিকে আরও অনেক বাড়িয়ে নেওয়া। এবারের একুশের প্রেক্ষিত আমাদের নতুন দিগন্তে প্রতিস্থাপন করেছে।'

ছবি: পিআইডি

'বরকত, সালাম, রফিক, জাব্বারের বুকের রক্তে যে অঙ্গীকার মাখা ছিল তাতে ছিল জুলাই অভ্যুত্থানকে নিশ্চিত করার মহাবিস্ফোরক শক্তি। অর্ধ শতাব্দী পর এই মহাবিস্ফোরণ গণঅভ্যুত্থান হয়ে দেশ পাল্টে দিলো। এই বিস্ফোরণ আমাদের মধ্যে নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় গ্রোথিত করে দিয়ে গেল। ১৭ কোটি মানুষের প্রতিজনের সত্ত্বায় এই প্রত্যয় গভীরভাবে গ্রোথিত। অমর একুশের এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আমরা এই প্রত্যয়ে শপথ নিতে এসেছি', বলেন তিনি।

ড. ইউনূস বলেন, 'একুশ আমাদের মূল সত্তার পরিচয়। একুশ আমাদের ঐক্যের দৃঢ় বন্ধন। এই বন্ধন ছোট-বড়, যৌক্তিক-অযৌক্তিক, ক্ষণস্থায়ী-দীর্ঘস্থায়ী সকল দূরত্বের ঊর্ধ্বে। এজন্য সকল প্রকার জাতীয় উৎসবে, সংকটে, দুর্যোগে আমরা শহীদ মিনারে ছুটে যাই। সেখানে আমরা স্বস্তি পাই। শান্তি পাই। সমাধান পাই। সাময়িকভাবে অদৃশ্য ঐক্যকে আবার খুঁজে পাই। ২১ আমাদের মানসকে এভাবে তৈরি করে দিয়েছে। একুশ আমাদের পথ দেখায়। একুশ আমাদের জাগিয়ে তোলে। মাত্র ছয় মাস আগে জুলাই গণঅভ্যুত্থান জাতিকে এক ঐতিহাসিক গভীরতায় ঐক্যবদ্ধ করে দিয়েছে। যার কারণে আমরা অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, প্রাতিষ্ঠানিক এবং মানবিক দিক থেকে বিধ্বস্ত এক দেশকে দ্রুততম গতিতে আবার উদ্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য তৈরি করার জন্য প্রস্তুতি নিতে সাহস খুঁজে পেয়েছি।'

তিনি বলেন, 'একুশের টান বয়সের ঊর্ধ্বে। প্রজন্মের ঊর্ধ্বে। একুশের টান প্রজন্মের পর প্রজন্ম বিস্তৃত হয়েছে শুধু তাই নয়, এই-টান গভীরতর হয়েছে। আমাদেরকে দুঃসাহসী করেছে। ছাত্র জনতার অভ্যুত্থান তারই জ্বলন্ত প্রমাণ। দুঃস্বপ্নের বাংলাদেশকে ছাত্র-জনতা নতুন বাংলাদেশে রূপান্তরিত করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। তারা অসম্ভবকে সম্ভব করে দেখিয়েছে। আমাদের তরুণ-তরুণী, কিশোর- কিশোরী রাস্তার দেয়ালে দেয়ালে তাদের স্বপ্নগুলো, তাদের আকাঙ্ক্ষাগুলো, তাদের দাবিগুলো অবিশ্বাস্য দৃঢ়তায় এঁকে দিয়েছে। আমাদের রাস্তার দেয়াল এখন ঐতিহাসিক দলিলে রূপান্তরিত হয়ে গেছে। এগুলির স্থান এখন আমাদের বুকের মধ্যে এবং জাদুঘরে হওয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই।'

ছবি: পিআইডি

'আমি অভিনন্দন জানাচ্ছি বইমেলার উদ্যোক্তাদের তারা এই দেয়ালচিত্রগুলো মেলায় আসা এবং যাওয়ার পথে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন। বাংলা একাডেমি আয়োজিত বইমেলা আমাদের জাতীয় জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে। ক্রমে ক্রমে এর গুণগত ও আয়োজনগত বিবর্তন হতেই থাকবে। বইমেলায় হাজির করার জন্য লেখক-লেখিকারা সারা বছর প্রস্তুতি নিতে থাকেন যথাসময়ে নিজ নিজ বই সমাপ্ত করার জন্য। প্রকাশকরা অনেক আয়োজন করেন নিজেদের বইগুলো যথাসময়ে হাজির করার জন্য, গুণগত প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করার জন্য এবং আগ্রহ বাড়ানোর জন্য প্রতিবছর বিষয়ভিত্তিক সেরা লেখক স্বীকৃতির আয়োজন করলে লেখকরা এই স্বীকৃতি পাবার জন্য এবং সেরা লেখকরা সেরা প্রকাশক পাবার জন্য অনেক সহায়ক হবে। আমি এই প্রস্তাব দিচ্ছি', বলেন তিনি।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, 'আমরা যদি একুশের ভাষা আন্দোলনকে আরও গভীরতর পরিপ্রেক্ষিতে স্বাধিকার আন্দোলন হিসেবেও দেখি তাহলে অমর একুশের গণ্ডি বৃহত্তর হয়ে দাঁড়ায়। তখন আমরা ভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কিশোর কিশোরী, তরুণ- তরুণীদের তাদের সৃজনশীলতার জন্য স্বীকৃতি দিতে পারি, নতুন উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য স্বীকৃতি দিতে পারি। শহর ও গ্রামের নারী পুরুষকে কৃষি, শিল্প, সাংস্কৃতিক জগত, বিজ্ঞান, বাণিজ্য শিক্ষায় ও অন্যান্য ক্ষেত্রে যারা নির্দিষ্ট বছরে জাতির জন্য অবদান রেখেছেন তাদের স্বীকৃতি দিতে পারি, তাদের জন্য আনুষ্ঠানিক আয়োজন করে দিতে পারি। প্রবাসী বাংলাদেশীদের, প্রবাসী শ্রমিকদের অবদানের জন্য স্বীকৃতি দিতে পারি। সারা পৃথিবী জুড়ে নানা কাজে বাংলাদেশিরা কৃতিত্ব দেখাচ্ছে।'

'আমরা একুশের দিনে তাদের সবাইকে স্মরণ করতে চাই। তারা সবাই একুশের দিনে নিজের দেশকে স্মরণ করে অনুষ্ঠান করে। তারা আমাদের পরিবারের অংশ হিসেবে তাদের সন্তান-সন্ততির কাছে পরিচয় করিয়ে দেয়' উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'আমার সব কথা আপনাদের গ্রহণ করতে হবে এমন চিন্তা করছি না। তবে নিজের বলার সুযোগ যখন পেয়েছি তখন বলে রাখলাম।'

ছবি: পিআইডি

প্রধান উপদেষ্টার উদ্বোধনের পরপরই বইপ্রেমীরা উচ্ছ্বাসের সঙ্গে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মেলাপ্রাঙ্গণে প্রবেশ করেন। তাদের কেউ কেউ বিভিন্ন প্রকাশনীর বই ঘুরে দেখতে ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা মুখরিত হয়ে ওঠে পাঠক, লেখক ও দর্শনার্থীদের প্রাণবন্ত আড্ডায়।

মাসব্যাপী এই সাহিত্য উৎসব, যা বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অন্যতম প্রতীক, বই, ইতিহাস ও বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার এক বিশাল মিলনমেলা হিসেবে পরিচিত।

এবারের মেলার কেন্দ্রীয় থিম 'জুলাই গণ-অভ্যুত্থান: নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণ', যা জুলাই আন্দোলনকে শ্রদ্ধা জানিয়ে রাখা হয়েছে। আন্দোলনের প্রভাব তুলে ধরতে বিশেষ 'জুলাই কর্নার' স্থাপন করা হয়েছে, যেখানে বই ও প্রদর্শনীর মাধ্যমে দর্শনার্থীরা এর ঐতিহাসিক গুরুত্বের ঝলক পাবেন।

আগের বছরের মতো এবারও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বাণিজ্যিক প্রকাশনী সংস্থাগুলো তাদের স্টল বসিয়েছে, আর বাংলা একাডেমি চত্বরে সরকারি প্রতিষ্ঠান ও সামাজিক সংগঠনগুলোর স্টল রয়েছে।

মেলা প্রতিদিন বিকেল ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত খোলা থাকবে, তবে সরকারি ছুটির দিনে সময়সূচি ভিন্ন হতে পারে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ও শহীদ দিবস উপলক্ষে ২১ ফেব্রুয়ারি মেলা সকাল ৮টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত চলবে।

প্রকাশকরা আশা করছেন, এবারের মেলায় বিক্রি ভালো হবে, কারণ গত দুই বছরের বিভিন্ন বিধিনিষেধ আর নেই। 

ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশের সহ-মালিক আদিত্য অন্তর আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, 'গত দুই বছর আমাদের বইমেলার ব্যবসা ক্ষতির মুখে পড়েছিল। এবার আমরা সেই ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার আশায় আছি।'

Comments

The Daily Star  | English

‘No room for politics under AL name, ideology’

Nahid Islam, adviser to the interim government, spoke with The Daily Star on the nation's key challenges and the way forward.

14h ago