একটা অদৃশ্য সরকার সব সময় বাংলাদেশের নীতি নির্ধারণ করে: আনু মুহাম্মদ

অনুষ্ঠানে কথা বলছেন অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। ছবি: সংগৃহীত

একটা অদৃশ্য সরকার সব সময় বাংলাদেশের নীতি নির্ধারণ করে, যারা কখনো সামনে আসে না বলে মন্তব্য করেছেন অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ।

আজ সোমবার আনু মুহাম্মদ সম্পাদিত ত্রৈমাসিক বাংলা জার্নাল সর্বজনকথার আয়োজনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের মুজাফফর আহমেদ চৌধুরী মিলনায়তনে 'স্বৈরতন্ত্র থেকে গণতন্ত্রের পথ: বৈষম্যহীন বাংলাদেশের সন্ধানে' শীর্ষক দিনব্যাপী সেমিনারে তিনি এই মন্তব্য করেন।

সেমিনারে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বৈষম্য, কৃষকের ন্যায্যমূল্য ও খাদ্য পণ্যের সিন্ডিকেট, পাঁচ দশকে শিল্পায়নের ব্যর্থতা, বৈষম্য নিরসনে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের ভূমিকা, উচ্চশিক্ষার সংকট, জনস্বাস্থ্যের সংকট, লিঙ্গীয় বৈষম্যের নানান রূপ, জাতিগত সংকট নিরসনে করণীয় এবং বাংলাদেশে ধর্মীয় সম্প্রীতির পথে বাধা নিয়ে আলোচনা চলে।

বক্তব্য রাখেন লেখক ও প্রকৌশলী কল্লোল মোস্তফা, কৃষি সাংবাদিক সাইদ শাহীন, গবেষক ড. মাহা মির্জা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. মোশাহিদা সুলতানা, অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান, সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের সাবেক অধ্যাপক ডাক্তার হারুন-অর-রশিদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. সামিনা লুৎফা, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. মির্জা তাসলিমা সুলতানা, গবেষক রেং ইয়ং ম্রো, শিল্পী আন্তনী রেমা, বিশিষ্ট আলেম ও বক্তা কাজী জাবের আহমেদ আল জাহাঙ্গীর এবং লেখক ও সাংবাদিক খোকন দাস।

সেমিনারটি আয়োজনে সহযোগিতা করে জার্মানির হ্যামবার্গের বাংলাদেশ উন্নয়ন ফোরাম। তাদের পক্ষ থেকে স্বাগত বক্তব্য দেন সুজিত চৌধুরী। সর্বজনকথার পক্ষ থেকে স্বাগত ও সমাপনী বক্তব্য প্রদান করেন সর্বজনকথা সম্পাদক জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ।

অর্থনৈতিক বৈষম্য ও করণীয় নিয়ে কল্লোল মোস্তফা বলেন, 'যেখানে এদেশের ৪১ শতাংশ সম্পদ ১০ শতাংশ মানুষের হাতে, সেখানে বাংলাদেশই একমাত্র দেশ যেখানে ন্যূনতম মজুরি দারিদ্র্যসীমার নিচে। বৈষম্য কমাতে হলে ধনীদের কাছ থেকে প্রত্যক্ষ কর বাড়াতে হবে।'

কৃষকের ন্যায্যমূল্য ও খাদ্যপণ্যের সিন্ডিকেট নিয়ে সাইদ শাহীন বলেন, 'রাষ্ট্রের ধানচালের মজুত সক্ষমতা মাত্র ২১ লাখ টন, যা মোট উৎপাদনের মাত্র পাঁচ শতাংশ। অথচ মিলারদের মজুত সক্ষমতা প্রায় এক কোটি টন। রাষ্ট্র এখানে সম্পূর্ণ ব্যর্থ।'

শিল্পায়নের ব্যর্থতা নিয়ে বলতে গিয়ে ড. মাহা মির্জা তুলে ধরেন কীভাবে গত পাঁচ দশকে রাষ্ট্রের ধারাবাহিক পলিসি ব্যর্থতার কারণে এদেশে যথাযথ শিল্পায়ন হয়নি। একইসঙ্গে গ্রামীণ অর্থনীতি থেকে ধারাবাহিকভাবে বিনিয়োগ তুলে নেওয়া হয়েছে। মূলত এই দুই কারণে এই দেশে প্রাতিষ্ঠানিক খাতের বদলে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে একটা বিশাল শ্রমিক শ্রেণি তৈরি হয়েছে। এসব কারণেই বিপুল পরিমাণ অটোরিকশা ও হকার তৈরি হয়েছে।

অর্থনৈতিক বৈষম্য নিরসনে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের ভূমিকা নিয়ে বলতে গিয়ে ড. মোশাহিদা সুলতানা বলেন, 'রাজস্ব আয়ের বড় অংশ বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জে ব্যয় হয়। অন্যদিকে জনগণ বেশি দামে বিদ্যুৎ কেনে। বিদ্যুতের দাম বেশি হওয়ায় সব কিছুর দাম বেড়ে যাচ্ছে। শহরের মানুষ বিদ্যুৎ পাচ্ছে, গরিবরা পাচ্ছে না। এভাবে বৈষম্য বৃদ্ধি পাচ্ছে।'

বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষার সংকট নিয়ে বলতে গিয়ে অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান বলেন, এমন কিছু বিশ্ববিদ্যালয় বানানো হয়েছে যাদের বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার কোনো যোগ্যতাই নেই। এমনকি এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রস্তাবনায় একটা লাইব্রেরি পর্যন্ত নেই। অথচ এগুলোতে ঠিকই ভিসি নিয়োগ হয়ে যাচ্ছে, লাখ লাখ টাকার নিয়োগ বাণিজ্যও হচ্ছে। এভাবে জেলায় জেলায় যথেচ্ছ বিশ্ববিদ্যালয় করে আসলে উচ্চশিক্ষাকে ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে।

ডাক্তার হারুন-অর-রশিদ জনস্বাস্থ্যের সংকট নিয়ে বলতে বলেন, 'স্বাস্থ্যকে মানুষের অধিকার হিসেবে না দেখে বাণিজ্যিকভাবে দেখার ফলেই আমাদের দেশের স্বাস্থ্যখাতের এই দুর্দশা।'

লিঙ্গীয় বৈষম্যের নানান রূপ তুলে ধরে ড. সামিনা লুৎফা বলেন, 'চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে যেসব নারী সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তারাও পরবর্তীতে সাইবার বুলিং, আক্রমণের শিকার হয়েছেন। নারী এদেশে জনসংখ্যার ৫১ শতাংশ হলেও তারা সংখ্যালঘুই রয়ে গেছেন।'

ড. মির্জা তাসলিমা বলেন, 'রাষ্ট্রের সমস্ত প্রতিষ্ঠান তৈরি করা হয়েছে প্রবলের জন্য সুবিধাজনক জায়গা থেকে। শুধু নারী ও পুরুষ নন—এর বাইরেও যেসব লিঙ্গীয় পরিচয়ের মানুষ আছে, তাদের নিয়ে কেউ কথা বলতে চায় না।

জাতিগত সংকট নিয়ে রেং ইয়ং ম্রো বলেন, 'জাতিগত সংকট সমাধানের প্রথম ধাপ হবে দেশের ভেতরের জাতিগত বৈচিত্র্যকে স্বীকার করা। এরপর তারা কী নামে নিজেরা পরিচিত হতে চান সেটা তাদেরকে ঠিক করতে দেওয়ার সৎসাহস দেখালেই এই সংকটের সমাধান হবে।'

আন্তনী রেমা বলেন, 'আদিবাসী ইস্যুতে পার্বত্য চট্টগ্রামকে আলাদা দেখিয়ে বিচ্ছিন্নতার প্রচারণা চালানো হয়। অথচ এদেশে বেশি সংখ্যক আদিবাসী সমতলে বাস করে। বারবার বলেছি আমরা সংবিধানে যুক্ত হতে চাই। তাহলে যারা সংবিধানে যুক্ত হতে চায় তারা বিচ্ছিন্নতাবাদী নাকি যারা বাধা দিচ্ছে তারা?'

ধর্মীয় সম্প্রীতির পথে বাধা সম্পর্কে কাজী জাবের আহমেদ আল জাহাঙ্গীর বলেন, যারা ইসলামকে শুধু লেবাস মনে করে, পোশাকের মধ্য দিয়ে ইসলামকে মাপে, তাদের কারণে মানুষ এখন ধর্মের কথা শুনতে চায় না। এই গোষ্ঠীই আমাদের কথায় কথায় ট্যাগ লাগায়।

সমাপনী বক্তব্যে অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, 'বাংলাদেশের মানুষ গণতন্ত্রের স্বাদ কেবল তখন পায়, যখন কোন গণপ্রতিরোধ চলতে থাকে। সব ধর্ম, জাতি, মত, লিঙ্গ—যারা দেশকে একটা গণতান্ত্রিক রূপান্তরের দিকে নিতে চায়, তারা সবাই তো ছিল গণঅভ্যুত্থানে। তখন তো ঐক্য ছিল। কিন্তু অদ্ভুতভাবে অভ্যুত্থান শেষেই আবার অসহিষ্ণুতা দেখা যায়। অথচ নানান জাতি, লিঙ্গ, ধর্ম, মতের বৈচিত্র্যই বাংলাদেশের শক্তি।'

'শাসক শ্রেণির কাছে মানুষের একতা ভীতিকর। মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতার দাবি ছিল গণঅভ্যুত্থানের একটা বড় দাবি। কিন্তু অভ্যুত্থানের পর দেখা গেল অপরাপর মত প্রকাশের ওপর দমন-পীড়ন শুরু হয়েছে, যা ধর্মের নামেই বেশি হচ্ছে', বলেন তিনি।

ভ্যাট আরোপের সমালোচনা করে এই অধ্যাপক বলেন, কয়েকটা গোষ্ঠী বা পরিবারের হাতে অবৈধ হাজার হাজার কোটি টাকা পুঞ্জীভূত থাকলেও সরকার তাদের না দেখে বলে যে আমাদের টাকার অভাব। একটা অদৃশ্য সরকার সব সময় বাংলাদেশের নীতি নির্ধারণ করে যারা কখনো সামনে আসে না।

Comments

The Daily Star  | English

Why Dhaka has become unliveable

To survive Dhaka, you need a strategy. Start by embracing the absurd: treat every crisis as a plot twist.

12h ago