কার্তিকের হিমে বাংলার আবহমান হেমন্ত

হেমন্ত
গুমাই বিলে ফসলের উৎসব। ছবি: রাজীব রায়হান/স্টার।

'কার্তিকের ভোরবেলা কবে

চোখে মুখে চুলের উপরে

যে- শিশির ঝরলো তা

শালিখ ঝরালো ব'লে ঝরে

আমলকী গাছ ছুঁয়ে তিনটি শালিখ

কার্তিকের রোদে আর জলে 

আমারি হৃদয় দিয়ে চেনা তিন নারীর মতন

সূর্য? না কি সূর্যের চপ্পলে'

জীবনানন্দ দাশ তার 'কার্তিক' কবিতায় এমনই এঁকেছেন কার্তিকের এক ভোরের চিত্রকে।

আজ কার্তিক মাসের প্রথম দিন। একইসঙ্গে আজ থেকে শুরু হলো হেমন্তকাল।

হেমন্ত যে কতখানি বর্ণিল হতে পারে তা দেখিয়েছেন জীবনানন্দ দাশই। জীবনানন্দ দাশের প্রিয় ঋতু ছিল হেমন্ত। ঋতু পরিক্রমার কবিতা হিসেবে করলে জীবনানন্দ দাশ সবচেয়ে বেশি কবিতা লিখেছেন কার্তিক মাসকে ঘিরেই।

কার্তিক
কার্তিকের বার্তা জানান দিচ্ছে বিলের শাপলা। ছবি: আহমাদ ইশতিয়াক

বাংলায় কার্তিক মাসের নামকরণ করা হয়েছিল কৃত্তিকা নক্ষত্রে সূর্যের অবস্থান থেকে। সবুজ ঘাসের আচ্ছাদনে জমবে শিশির বৃষ্টি। ধানের শীষে জমবে শিশির চাদর। আবহমান বাংলার ঘরে ঘরে কদিন বাদেই তো উঠবে নবান্নের ঢেউ। আন্দোলিত হবে হিমেল হাওয়ার আচ্ছাদনে। নয়নাভিরাম প্রকৃতির সবুজে হলুদে মিলেমিশে বইবে ফসলের খেতে। ভোরবেলা কুয়াশা ভেজানো ভোর স্বাগতম জানাবে প্রতিদিন। সূর্যের আড়মোড়া ভাঙবে কিছুটা আলস্যে। কারণ হেমন্তকে বলা যায় শীতের আগমনধ্বনি। কার্তিকের হিমে যার শুরু, অগ্রহায়ণে যা এগিয়ে দেয় বহুখানি। কার্তিকের বেলা টুপ করে ডুব দেয়। আবার ভোর হয় আয়েশে।

তাইতো জীবনানন্দ দাশ তার 'গোলপাতার ছাউনির বুক' কবিতায় লিখেছিলেন,

'গোলপাতা ছাউনির বুক চুমে নীল ধোঁয়া সকালে সন্ধ্যায়

উড়ে যায়- মিশে যায় আমবনে কার্তিকের কুয়াশার সাথে;'

আশ্বিন এবং শরৎকালকে বলা হয় উৎসবের মাস এবং ঋতু। আর হেমন্তকে বলা যায় নবান্নের কাল। এ সময় বাংলার কৃষকের ঘরে আসে আনন্দ হিল্লোলের সুবাতাস। কারণ কৃষকের গোলা ভরে যায় অবারিত ধানে। সুফিয়া কামাল 'হেমন্ত' কবিতায় লিখেছিলেন, 'সবুজ পাতার খামের ভেতর/ হলুদ গাঁদা চিঠি লেখে/ কোন্ পাথারের ওপার থেকে/ আনল ডেকে হেমন্তকে?/ আনল ডেকে মটরশুঁটি,/ খেসারি আর কলাই ফুলে/ আনল ডেকে কুয়াশাকে/ সাঁঝ সকালে নদীর কূলে।'

কার্তিক উঠে আসবে না শহুরে ঋতু পরিক্রমায়। শহুরে নাগরিকদের তালিকায় কেবল তিনটি ঋতুই প্রাধান্য পায়। গ্রীষ্ম, বর্ষা ও শীত। কদাচিৎ দেখা মিলে বসন্তের। বাংলার গ্রাম্য জনপদে পাওয়া যায় হেমন্তের ঘ্রাণ। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বর্তমানে ঋতুভেদে বাংলার আবহাওয়া বাঁকবদল করলেও ফসলের ক্ষেত্রে তা কদাচিৎই দেখা মিলে। হেমন্তের ঢং, রূপ লাবণ্য পাওয়া যায় আবহমান বাংলার কৃষি জনপদে, প্রকৃতির সাজ-রবে। 

তবে কার্তিক কিন্তু এককালে শুভ হতোনা গ্রামবাংলার উত্তরাঞ্চলে। কারণ কার্তিক মাসেই শুরু হতো মঙ্গা। হেমন্তের এই প্রকারভেদ। প্রথম মাসটি অনেকাংশেই ম্রিয়মাণ, দ্বিতীয় মাসটি উৎসবের রঙে উচ্ছ্বসিত। কার্তিকের নামে তাই অপবাদ জুটেছে 'মরা কার্তিক' নামে। কারণ এই কার্তিকেই যে মঙ্গাপীড়িত অঞ্চলগুলোতে অভাব আর অনটন লেগেই থাকত।

সাহিত্যিক মশিউল আলম তার 'দুধ'  গল্পগন্থের গল্প 'আকালুর খিয়ারযাত্রা'তে লিখেছেন সেই মঙ্গাপীড়িত জনপদের আকালু নামের এক ক্ষেত মজুরের করুণ চিত্র। সেই সময়টা ছিল কার্তিক মাসই।

 কার্তিক
বাংলার গ্রামে কার্তিকের চিরায়িত সকাল। ছবি: আহমাদ ইশতিয়াক

'রৌমারীর গাঁয়ে গাঁয়ে যখন কার্তিকের শেষ দিনটা চাকা ভাঙা গরু গাড়ির মতো থমকে দাঁড়ায়, যখন মাঠে মাঠে আমন ধানের খেতগুলো ভয়ানক শত্রুতা আরম্ভ করে, শালার ধান পণ করে যে সহজে পাকবে না, কারণ খেতমজুরদের শুকিয়ে মারা দরকার…'

চারণ সাংবাদিক মোনাজতউদ্দিনের লেখা চিলমারীর এক যুগ এ উঠে এসেছে মরা কার্তিকে দুর্বিষহ হাহাকার। যা মঙ্গাপীড়িত মানুষের ক্ষুধার যন্ত্রণার উপলব্ধিরই সাক্ষাৎ প্রমাণ।

আজকের দিনে এসে মোনাজাতউদ্দিনের সেই মঙ্গাপীড়িত উত্তরবঙ্গকে হয়তো চেনা যাবে না। সময়ের ব্যবধানে আজ উত্তরবঙ্গ আধুনিক, ঝাঁ ঝাঁ সড়ক, দুধারে ফসলের খেত, প্রতিটি ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ, আধুনিকতার জয়ধ্বনি। মঙ্গাপীড়িত উত্তরবঙ্গের খেত আজ তিন ফসলি জমি, বাড়ির আঙিনায় সবজি খেত, পুকুরে মাছ, গোয়ালে গাই। 

কিন্তু মোনাজাতউদ্দিনের উত্তরবঙ্গ আজকের মতো ছিল না। সেই উত্তরবঙ্গ ছিল রুক্ষ, সেই জনপদে চতুর্দিকে কেবলই হাহাকার। আশ্বিন-কার্তিক মাস এলেই উত্তরাঞ্চলে মঙ্গা দেখা দিত। বেশির ভাগ মানুষের ঘরে খাবার থাকত না। আমন ধান ঘরে তোলার আগ পর্যন্ত খাবার জুটত না।

কিন্তু এই কার্তিকেই আবার শাপলার বিল হয়ে উঠতো পরিপূর্ণ। শাপলার শালুক ছিল মঙ্গার দিনগুলোতে অন্যতম প্রধান খাবার। এ সময় প্রাকৃতিক খাবার হিসেবে কেবল শালুকই জুটত। বিবর্ণ কার্তিক আর মরা কার্তিক যা বলা হোক না কেন, প্রকৃতির অনেকাংশে কার্তিককে দিয়েছে অনেকখানি রূপ। নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা, সবুজে ভেজা ফসলের মাঠ। ভোরবেলায় কুয়াশা ভেজা প্রান্তর। ভাদ্র কিংবা আশ্বিনে আদ্রতা থাকে বেশি। যার ফলে উষ্ণতা অধিক অনুভূত হয়, কার্তিকে উষ্ণতা কমতে থাকে।  একই সঙ্গে কচুরিপানা ফুলে ভরে যায় খাল বিল। ফসলের খেতের আলপথে হাওয়ায় দুলে জংলী ফুল। ঘুঘু ঢাকা আয়েশি মধ্য দুপুরে কোথাও ঝরে পড়ে শুকনো পাতা।

শুকনো পাতার মর্মর ধ্বনি গ্রাস করে যেন প্রকৃতিকে বিষণ্ণতার রূপে।  তাই শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের চোখে হেমন্ত যেন প্রকৃতির বার্ধক্যের এক রূপ।  'হেমন্ত যেখানে থাকে' কবিতায় শক্তি চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন,

'হেমন্ত যেখানে থাকে, সেখানে কৌতুক থাকে গাছে

সাড়া থাকে, সচ্ছলতা থাকে।

মানুষের মতো নয়, ভেঙে ভেঙে জোড়ার ক্ষমতা

গাছেদের কাছে নেই

হেমন্ত বার্ধক্য নিতে আসে

খসায় শুকনো ডাল, মড়া পাতা, মর্কুটে বাকল

এইসব।'

বাংলায় হেমন্তের রূপের বর্ণনা ও চিত্র  লিখিত আকারে প্রথম পাওয়া যায় বাংলা বৈষ্ণব পদাবলীর  বিখ্যাত পদকর্তা গোবিন্দদাসের লেখা পদে। তিনি লিখেছেন গ্রাম  বাংলার নাইয়র প্রথাকে নিয়ে। হেমন্তের নবান্নের সময় নাইয়র হয়ে মেয়েরা বাপের বাড়ি আসত। 'আঘাণ মাস রাস রস সায়র/ নায়র মাথুরা গেল।/ পুর রঙ্গিনীগণ পুরল মনোরথ/ বৃন্দাবন বন ভেল॥'

বৈষ্ণব পদাবলীর বিখ্যাত পদকর্তা লোচন দাস ও কম যাননি। মূলত বৈষ্ণব পদাবলীতে বাংলার ঋতু বৈচিত্র্যের সবচেয়ে নান্দনিক রূপের দেখা মিলে। লোচন দাস লিখেছিলেন, হেমন্তের অগ্রহায়ণে কৃষকের নতুন ধানের আনন্দ নিয়েই। 'অগ্রাণে নোতুন ধান্য বিলাসে।/ সর্বসুখ ঘরে প্রভু কি কাজ সন্ন্যাসে ॥/ পাটনেত ফোটে ভোটে শয়ন কম্বলে।/সুখে নিদ্রা যাও তুমি আমি পদ তলে॥'

মধ্যযুগের কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর লেখায় পাওয়ায় হেমন্তের প্রচলিত রূপের বর্ণনা। 'কালকেতু' উপাখ্যানে তিনি লিখেছেন, 'কার্তিক মাসেতে হয় হিমের প্রকাশ/ যগজনে করে শীত নিবারণ বাস'

কার্তিক যেমন বারবার উঠে এসেছে কবিতার খেরোখাতায়, কবিদের হৃদয়ের পর্দায় বা সৃষ্টির চাঞ্চল্যে। কবি জসীমউদ্দীন তাঁর নকশীকাঁথার মাঠ কাব্য গ্রন্থে লিখেছেন 

'আশ্বিন গেল, কার্তিক মাসে পাকিল খেতের ধান,

সারা মাঠ ভরি গাহিতেছে কে যেন হল্ দি-কোটার গান |

ধানে ধান লাগি বাজিছে বাজনা, গন্ধ উড়িছে বায়,

কলমীলতায় দোলন লেগেছে, হেসে কূল নাহি পায় |'

জীবনানন্দ দাশের কাছে হেমন্ত প্রিয় ঋতু তো বটেই একই সঙ্গে উৎসবের ঋতুও।  কার্তিকের মধ্য দিয়েই তো হেমন্তের শুরু।  জীবনানন্দ দাশ তাই বারবার ফিরে আসতে চেয়েছিলেন কার্তিকের নবান্নের দেশে, শঙ্খচিল বা শালিকের বেশে।

'আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে – এই বাংলায়

হয়তো মানুষ নয় – হয়তো বা শঙখচিল শালিকের বেশে,

হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে

কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব কাঁঠাল ছায়ায়।'

Comments

The Daily Star  | English
Aynaghar

DGFI destroyed evidence of 'Aynaghar': commission

The commission investigating enforced disappearances submitted its report to the chief adviser

11m ago