সামিট নিয়ে হঠাৎ সিদ্ধান্ত বদল বিটিআরসির

সরকার বদলের পর দুই মাস আগে নেওয়া সামিট কমিউনিকেশন্সের শেয়ার হস্তান্তর সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা (বিটিআরসি)।

দুই মাস আগে সামিট কমিউনিকেশন্সকে কোনো ফি ছাড়াই শেয়ার হস্তান্তরের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। এই বিষয়টি আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরের শাসনামলে সামিট কমিউনিকেশন্স কতটুকু সুবিধা পেয়েছে সেই প্রশ্ন তোলেছে।

সামিট কমিউনিকেশন্সের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ ফরিদ খান আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ফারুক খানের ছোট ভাই। ফারুক খান গোপালগঞ্জ-১ আসনের পাঁচবারের সংসদ সদস্য। তিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের বন্ধু।

নিয়ম অনুযায়ী, কোনো কোম্পানি যখন শেয়ার হস্তান্তর করে, তখন বিক্রয়মূল্যের পাঁচ দশমিক পাঁচ শতাংশ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে ফি হিসেবে জমা দিতে হয়।

২০২১ সালের এপ্রিলে নতুন শেয়ার ইস্যুর মাধ্যমে কীর্তনখোলা টাওয়ার বাংলাদেশকে নতুন কোম্পানির কাছে শেয়ার স্থানান্তরের জন্য বিটিআরসিকে পাঁচ কোটি ৭০ লাখ টাকা পরিশোধ করতে হয়েছিল।

২০০৯ সালে আত্মপ্রকাশের পরে টেলিকম ও ইন্টারনেট অবকাঠামো খাতের সবচেয়ে বড় কোম্পানিতে পরিণত হওয়া সামিট কমিউনিকেশনের জন্য এসব নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা করা হয়নি।

টেলিযোগাযোগ বিশেষজ্ঞ আবু নাজাম এম তানভীর হোসেন বলেন, 'অনেক কর্মকাণ্ড, অবহেলা ও ভুল থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, বিটিআরসি ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় রাজনৈতিক প্রভাবে পরিচালিত হতো। এটি নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে ক্ষমতাহীন করে তোলে এবং দৃশ্যমান ও অদৃশ্য নির্দেশনা অনুসরণ করতে বাধ্য করে।

সামিট কমিউনিকেশন্স গত মার্চের শেষে আবুধাবি ও মরিসাসভিত্তিক কোম্পানি এবং এর বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালককে ১৭০ কোটি পাঁচ লাখ টাকা মূল্যের নতুন শেয়ার ইস্যু করার জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনুমোদন চেয়েছিল।

আবেদনপত্র অনুসারে, প্রতিটি ১২ টাকায় মোট ১৪ কোটি ২০ লাখ নতুন শেয়ার ইস্যু করা হবে। এক মাস পরে লেনদেনের পূর্বানুমোদনের জন্য ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়, যেখানে পরের মাসেই সরকারের অনুমোদন আসার কথা ছিল। এরপর ১২ জুন কোম্পানিটিকে কোনো চার্জ ছাড়াই শেয়ার হস্তান্তরের অনুমতি দেয় বিটিআরসি।

তবে তার আগেই বিটিআরসি আইনি পরামর্শ নেয়। একটি ল' ফার্ম থেকে জানানো হয়, সামিট যেহেতু শুধু নতুন শেয়ার ইস্যু করছে, সেহেতু বিক্রয় মূল্যের ওপর পাঁচ দশমিক পাঁচ শতাংশ ফি প্রযোজ্য নয়।

সামিটও জানায়, কোম্পানিটি নতুন শেয়ার ইস্যু করে মূলধন বাড়ানোয় এই ফি প্রযোজ্য নয়।

তবে নতুন শেয়ার ইস্যুর আড়ালে সামিটের শেয়ার হস্তান্তর ও বিক্রির ব্যাপারে শুরু থেকেই বিটিআরসির লিগ্যাল অ্যান্ড লাইসেন্সিং বিভাগ অভিযোগ আনতে চেয়েছিল। এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা দ্য ডেইলি স্টারকে এ তথ্য জানিয়েছেন।

কারণ শেয়ার ইস্যু করার পর কোম্পানিতে ফরিদ খানের মালিকানা ৯৫ শতাংশ থেকে ২৫ শতাংশে নেমে আসে। কারণ তিনি নতুন প্রতিষ্ঠানের কাছে শেয়ার হস্তান্তর করেন এবং সামিটও এসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বিক্রয় চুক্তি জমা দেয়।

নতুন শেয়ারের মধ্যে সংযুক্ত আরব আমিরাতভিত্তিক কোম্পানি গ্লোবাল এনার্জিসকে ১১৩ কোটি ৩৮ লাখ টাকা মূল্যের নয় কোটি ৪৪ লাখ শেয়ার ইস্যু করা হয়েছে, যা সামিট কমিউনিকেশন্সের ৪৯ শতাংশ শেয়ার নিশ্চিত করার জন্য যথেষ্ট।

গ্লোবাল এনার্জিসের অন্যতম একজন শেয়ারহোল্ডার ফরিদ খানের বড় ভাই মুহাম্মদ আজিজ খানের মেজ মেয়ে আদিবা আজিজ খান।

গ্লোবাল এনার্জিস হোল্ডিংসের পরিচালনা পর্ষদের রেজুলেশনের বরাত দিয়ে বিটিআরসির নথিতে বলা হয়, আদিবা ফরিদের মেয়ে ফাদিয়াহ খান এবং তার চাচা জাফর উম্মেদ খানের মেয়ে সানাদিনা খানকে সামিট কমিউনিকেশন্সের পরিচালক হিসেবে মনোনয়ন দেন।

৪৮ কোটি ৫৯ লাখ টাকা মূল্যের আরও চার কোটি চার লাখ শেয়ার মরিসাসভিত্তিক সিকোইয়া ইনফ্রা টেককে দেওয়া হয়, যা সামিট কমিউনিকেশন্সের ২১ শতাংশ শেয়ার সুরক্ষিত করার জন্য যথেষ্ট। সামিট কমিউনিকেশন্স বোর্ডে প্রতিনিধিত্ব করবেন সিকুইয়া ইনফ্রা টেকের পরিচালক দূরভেশ কুমার জুগুরনাথ।

বাকি ৭১ লাখ চার হাজার শেয়ার বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরিফ আল ইসলামকে ইস্যু করা হয়, যার পাঁচ শতাংশ শেয়ারের পরিমাণ অপরিবর্তিত রয়েছে।

কমিশনের একজন শীর্ষ স্থানীয় কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, 'সামিটেকে রেভিনিউ শেয়ারিং চার্জ করা যৌক্তিক , আমরা এর আগে কীর্তনখোলা টাওয়ার বাংলাদেশকে একই প্রক্রিয়ার জন্য চার্জ করেছিলাম।'

তবে বিটিআরসির সদ্য বিদায়ী সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদের প্রচেষ্টায়তেই এ বিষয়ে আইনি মতামত নেওয়া হয় বলে বিটিআরসির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

গত ১৪ আগস্ট বিটিআরসির সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগ করেন মহিউদ্দিন আহমেদ। একাধিকবার চেষ্টা করেও তার সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বিটিআরসি লেক্স কাউন্সিলকে চিঠি দিয়ে জানায়, তাদের আইনি মতামত কেবল পরামর্শমূলক, বাধ্যতামূলক নয়।

শেয়ারের বিক্রয় মূল্যের পাঁচ দশমিক পাঁচ শতাংশ পরিশোধের নির্দেশ দিয়ে গত ১৪ আগস্ট সামিটকে চিঠি দেয় বিটিআরসি।

দ্য ডেইলি স্টারের পক্ষ থেকে প্রশ্ন করা হলে সামিট কমিউনিকেশন্স জানায়, বিটিআরসির চিঠি পেয়ে ইতোমধ্যে তারা নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে ১০ কোটি ২৪ লাখ টাকা জমা দিয়েছে।

'বাস্তাবে আপনি দেখতে পাবেন, সামিট মানসম্পন্ন সেবা প্রদানকারী এবং আইন ও নিয়মের আওতায় পরিচালিত একটি বিশাল প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এটি সত্য,' বলেন টেলিকম সংস্থার একজন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা।

তবে সরকার সামিটকে এই অবস্থানে আসতে সব ধরনের সুবিধা দিয়েছে। অনেক নির্দেশনা কিংবা নীতি প্রণয়ন এমনভাবে করা হয়েছে যা সরাসরি সামিটের অনুকূলে যায়, বলেন তিনি।

তানভীর আরও বলেন, আমরা শেয়ার হস্তান্তরে রাজস্ব আরোপের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানাই।

তবে এটি থেকে অনুমান করা যায়, এ রকম ঘটনা আগেও ঘটে থাকতে পারে।

এই সম্ভাব্য চোরাগলি বন্ধে একটি স্বাধীন তদন্ত হওয়া উচিত, যাতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা দেরিতে হলেও এ ধরনের রাজস্ব পুনরুদ্ধার করতে পারে।

সামিট কমিউনিকেশন্স ও এর অংশীদারদের ২০২৬ সালের প্রথম প্রান্তিকে বেসরকারি সাবমেরিন ক্যাবল স্থাপন করার কথা রয়েছে।

'এই প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রত্যেক সদস্যকে প্রায় ৪০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করতে হবে। গত পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে। ডলারের ঘাটতির কারণে এই ধরনের তহবিল দরকার ছিল,' জানায় সামিট কমিউনিকেশন্স।

কোম্পানির পরিশোধিত মূলধন এবং বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ বাড়াতে গ্লোবাল এনার্জিস এবং সিকোইয়া ইনফ্রা টেকের সঙ্গে অংশীদারত্ব ছিল কৌশলগত উদ্যোগ। যে সহযোগিতা স্থানীয় ব্যাংকগুলো দিতে পারছিল না।

সাবমেরিন ক্যাবল প্রকল্পটি বাস্তবায়নে এই অংশিদারিক্ত (বিদেশি বিনিয়োগ) প্রয়োজন। কারণ জাতীয় জীবনেও এর উল্লেখযোগ্য গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।

Comments

The Daily Star  | English
What is Indian media’s gain in branding us as a Hindu-hating country?

What is Indian media’s gain in branding us as a Hindu-hating country?

What has shocked me is their refusal to fact-check what they are writing, broadcasting or televising—a basic duty of any journalist.

5h ago