আয়নাঘর

বাচ্চার জন্য কেনা দুধটাও বাসায় দিতে দেয়নি ওরা: ইউনিয়ন নেতা ফিরোজ মাহমুদ

ফিরোজ মাহমুদ হাসান
ফিরোজ মাহমুদ হাসান। ছবি: স্টার

কয়েক বছরের আইনি লড়াইয়ের পর দাবি আদায় হওয়ায় শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে শান্তিতে নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও গ্রামীণ টেলিকমের বিরুদ্ধে ১১০টি মামলা ২০২২ সালের ২৩ মে তুলে নেন ইউনিয়ন নেতা ও কর্মচারীরা।

এর প্রায় এক মাস পর ২০২২ সালের ৩০ জুন গ্রামীণ টেলিকম ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ফিরোজ মাহমুদ হাসানকে (৪৪) সাদাপোশাকধারী লোকজন তুলে নিয়ে যায়।

তাকে নেওয়া হয় গোপন বন্দীশালায়, যা 'আয়নাঘর' নামে পরিচিত। সেখানে প্রফেসর ইউনূস ও গ্রামীণ টেলিকম কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে জবানবন্দি দিতে বাধ্য করতে তার ওপর চলে নির্যাতন।

যেভাবে তাকে তুলে নেওয়া হলো

২০২২ সালের ৩০ জুন, রাত সাড়ে ১০টা। সন্তানদের নিয়ে ফিরোজ ও তার স্ত্রী সবেমাত্র রাতের খাবার খাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। যখন তাদের নজরে আসে, দেড় বছরের বাচ্চাটার জন্য বাসায় দুধ নেই। খাওয়ার আগে বাচ্চার জন্য দুধ কিনতে বাসার পাশেই মিরপুরের ইসিবি চত্বরে একটি দোকানে যান ফিরোজ।

বাড়ি ফেরার পথে মুখোশধারী ১০-১৫ জন তাকে থামিয়ে পরিচয় জানতে চায়। তারা ফিরোজের মোবাইল ফোন কেড়ে নেয় এবং তাকে তুলে নিয়ে যায়।

'বাচ্চার জন্য কেনা দুধটাও বাসায় দিতে দেয়নি ওরা। দ্রুত চোখ বেঁধে একটি মাইক্রোবাসে তুলে নেয়।'

এর কয়েক ঘণ্টা পর ফিরোজকে নেওয়া হয় একটি বন্দীশালায়। ফিরোজ জানতেন না যে এটাই সেই কুখ্যাত 'আয়নাঘর'।

আয়নাঘরে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয় ফিরোজের উপর। সেইসঙ্গে তাদের নির্দেশ না মানলে ফিরোজের পরিবারের সবাইকে তুলে নিয়ে আসারও হুমকি দেওয়া হয়।

তারা ফিরোজের একটি জবানবন্দি রেকর্ড করতে চেয়েছিল, যেখানে তিনি বলবেন যে মামলা তুলে নিতে শ্রমিকদের রাজি করানোর জন্য ইউনিয়ন নেতারা গ্রামীণ টেলিকমের কর্মকর্তাদের কাছ থেকে টাকা নিয়েছিল।

সোমবার দ্য ডেইলি স্টারের কাছে আয়নাঘরের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে ফিরোজ জানান, এতদিন তিনি মুখ খোলার সাহস পাননি ভয়ে। কিন্তু ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে পালিয়ে যাওয়ার পর তিনি সেই অন্ধকার সময়ের কথাগুলো সবাইকে বলার সাহস পাচ্ছেন।

'আয়নাঘর'

ফিরোজকে আয়নাঘরের একটি সেলে নেওয়ার পর তার চোখের বাঁধন খুলে দেওয়া হয়।

তার সেলটি ছিল খুবই ছোট—তিন ফুট চওড়া এবং ছয়-সাত ফুট লম্বা। তিন দিকে কংক্রিটের দেয়াল আর একদিকে তালাবদ্ধ লোহার গেট।

ফিরোজ বলেন, 'একটি বাল্ব, একটি ফ্যান, একটি পানির বোতল, আর একটি কম্বল ছাড়া সেলটিতে আর কিছুই ছিল না।'

তিনি জানান, বাইরে থেকে কোনো আলো-বাতাস বা শব্দও তার সেলে পৌঁছাতো না।

'বাল্ব সব সময় জ্বলতো। আমার সেলের বাইরে প্রচণ্ড শব্দে ফ্যান চলতো। টয়লেটে যেতে হলে হাত তুলতে হতো এবং সেটা দেখে কোনো প্রহরী আসতো। সম্ভবত তারা ২৪ ঘণ্টাই সিসিটিভির মাধ্যমে আমাকে পর্যবেক্ষণ করত,' বলেন ফিরোজ।

শুধুমাত্র সেলের ভেতরে থাকলে এবং টয়লেটে গেলে তার চোখ খুলে দেওয়া হতো। বাকি সময় চোখ বেঁধে রাখা হতো।

'কখন রাত, কখন দিন—কিছুই বুঝতাম না। আজানও শুনিনি। নাস্তা দিলে বুঝতে পারতাম সকাল হয়ে গেছে।'

নির্যাতন

ফিরোজকে প্রচুর জিজ্ঞাসাবাদ এবং শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়।

তিনি বলেন, 'একটি স্টিলের চেয়ারে বসিয়ে হাত বেঁধে আমার কোমর থেকে শুরু করে নিচের দিকে লাঠি দিয়ে প্রচণ্ড মারধর করতো, বৈদ্যুতিক শক দেওয়ার ভয় দেখাতো।'

তারা হুমকি দিতো যে তাদের কথা না শুনলে ফিরোজের পরিবারের সদস্যদেরও তুলে এনে নির্যাতন করা হবে।

'আমি তো ধরেই নিয়েছিলাম, যেকোনো দিন মরে যাব, পরিবারকে আর দেখতে পাব না।'

পুলিশে হস্তান্তর

আয়নাঘরে সাত দিন নির্যাতনের পর ৬ জুলাই ভোররাতে ফিরোজকে ডিএমপির গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) কাছে হস্তান্তর করা হয়।

সেখানে তিনি দেখা পান তার সহকর্মী ও ইউনিয়ন সভাপতি কামরুজ্জামানের। কামরুজ্জামানও ফিরোজের মতোই আটক ছিলেন এবং একই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছেন।

এরপর তাদের দুজনকে জালিয়াতি ও আত্মসাতের মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে সাত দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়।

রিমান্ডে নিয়ে ফিরোজ ও কামরুজ্জামানকে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি হিসেবে একটি স্ক্রিপ্ট মুখস্থ করতে বাধ্য করা হয়।

ফিরোজ বলেন, 'সেই স্ক্রিপ্টের একটি অনুলিপি আদালতে জমা দেওয়া হয়েছিল। সেটাকেই আমার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি হিসেবে রেকর্ড করেছে।'

এরপর তার আইনজীবী জামিনের আবেদন করলে প্রতিবারই তা নাকচ করে দিয়েছেন আদালত।

নয় মাস জেলে থাকার পর অবশেষে ২০২৩ সালের এপ্রিলে জামিন পান ফিরোজ। তারপরও কাটেনি তার নিরাপত্তাহীনতা ও উদ্বেগ।

 

Comments

The Daily Star  | English

First phase of Ijtema ends with ‘Akheri Munajat’

The final prayer was conducted by Maulana Zubair, top spiritual leader of Shura-e-Nezami, Bangladesh

1h ago