আলোকচিত্রীরা বারুদের গন্ধ, গুলির শব্দের মধ্যেও কাজ করেন: শহিদুল আলম

প্রদর্শনীতে আলোকচিত্রীদের তোলা ছবি দেখানো হয়। ছবি: ছবি: সাদী মুহাম্মাদ আলোক/স্টার

কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া শিক্ষার্থীদের আন্দোলন থেকে পরবর্তীতে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। জাতিসংঘের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, এই আন্দোলনে ছয় শতাধিক মানুষ নিহত হয়েছেন।

যেকোনো সময়ের মতো এবারের আন্দোলনকালীন পরিস্থিতিতেও রাষ্ট্রীয় নিষ্পেষণ এবং সব বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে পেশাগত দায়িত্ব পালন করে গেছেন আলোকচিত্রীরা। ১৬ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত বাংলাদেশে যা ঘটেছে, সেগুলো তুলে ধরেছেন দেশ-বিদেশে।

প্রদর্শনীতে আলোকচিত্রীদের তোলা ছবি দেখানো হয়। ছবি: ছবি: সাদী মুহাম্মাদ আলোক/স্টার

এমন কিছু আলোকচিত্রীর অভিজ্ঞতা শুনতে শনিবার সন্ধ্যায় ঢাকার দৃক গ্যালারিতে আয়োজিত হয়েছে 'আলোকচিত্রীর চোখে গণঅভ্যুত্থান' শীর্ষক এক অনুষ্ঠানের।

অনুষ্ঠান শেষে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আলোকচিত্রী ও দৃক পিকচার লাইব্রেরির ব্যবস্থাপনা পরিচালক শহিদুল আলম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আলোকচিত্রীরা যেভাবে আন্দোলনটাকে দেখেছে, একেবারে সরাসরি, সেটা আর কেউ করেননি। কারণ অন্যান্য ধরনের রিপোর্টিং দূর থেকে বা ভিন্নভাবে করা সম্ভব। আলোকচিত্রীরা সামনে থেকে বারুদের গন্ধ নিয়ে, গুলির শব্দ শুনে কাজ করেছেন এবং আহতও হয়েছেন। আমাদের একজন মারাও গেছেন। তারচেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ যে ছবিগুলো আজকের আয়োজনে দেখানো হলো। পত্রিকায় তো খুব বেশি ছবি দেখানো যায় না। আজকে ছবি দেখার পাশাপাশি পেছনের ঘটনা-অভিজ্ঞতা জানা গেছে।'

প্রদর্শনীতে আলোকচিত্রীদের তোলা ছবি দেখানো হয়। ছবি: ছবি: সাদী মুহাম্মাদ আলোক/স্টার

'যারা এই আন্দোলনে আহত হয়েছেন, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাদের কথা আমরা ভাবছি। সেটা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি আলোকচিত্রীদের যে মানসিক যন্ত্রণাটা এই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাওয়ার কারণে হয়েছে, তাদের ভেতর যে আগুন জ্বলছে, যে দগ্ধতা রয়েছে, সেটা নিয়েও ভাবতে হবে। সেটা নিয়ে আমরা খুব বেশি ভাবছি না। আমি মনে করি আমাদের আলোকচিত্রীদের সেই ক্ষতটা নিয়ে ভাবা দরকার।'

শহিদুল আলম বলেন, 'আন্তর্জাতিক ও আমাদের দেশের নিয়ম অনুযায়ী আলোকচিত্রীদের ওপর কোনো রকমের হামলা করার উপায় নেই। কিন্তু আমরা দেখেছি, আলোকচিত্রী বলেই হয়তো হামলা করা হচ্ছে কিছু কিছু ক্ষেত্রে। এটা শুধু আমাদের দেশেই না, গাজাসহ অন্যান্য জায়গাতেও হচ্ছে। পৃথিবীতে যে নিয়ম আছে, সেটা স্মরণ করে দেওয়া দরকার। এটা করার মাধ্যমে যে মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে এবং আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন হচ্ছে, সেটা সরকারকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া দরকার। এই মুহূর্তে আমরা গবেষণা করছি, যাতে এই সরকার ও পরবর্তী যেকোনো সরকারকে আমরা জবাবদিহির আওতায় আনতে পারি।'

প্রদর্শনীতে আলোকচিত্রীদের তোলা ছবি দেখানো হয়। ছবি: ছবি: সাদী মুহাম্মাদ আলোক/স্টার

'হামলার যেসব ঘটনা ঘটবে, সেগুলোর ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে। এই বিষয়টি আমরা বর্তমান সরকারের কাছে তুলে ধরেছি। তাদেরকেও জবাবদিহি করতে হবে। আজকে যেটা বলা হলো, এই সরকার থাকাকালেও এরকম ঘটনা ঘটেছে। ছবি-ভিডিও করতে যাওয়ার পর ক্যামেরা নিয়ে যাওয়া হয়েছে, আক্রমণও করা হয়েছে। এটার একটা সংস্কৃতি দাঁড়িয়ে গেছে, যেটার ক্ষেত্রে কোনো রকমের ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলে এটাই রীতি হয়ে যেতে পারে। এটাকে প্রশ্ন করা দরকার', যোগ করেন তিনি।

আয়োজনের উদ্বোধনে স্বাগত বক্তব্যে শহিদুল আলম বলেন, 'আমরা এতদিন ধরে একটা ভয়ের সংস্কৃতির মধ্যে ছিলাম। তবে এখন আমাদের কার্টুন প্রদর্শনীতে মানুষের ঢল নেমেছে। আমাদের এই অংশগ্রহণ ধরে রাখতে হবে। আমরা আমাদের ইতিহাসের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশে আছি। এই আন্দোলন, এই বিপ্লব আমাদের ধরে রাখতে হবে। আর এই ছবিগুলো আমাদের ভবিষ্যতের জন্য প্রামাণ্য।'

প্রদর্শনীতে আলোকচিত্রীদের তোলা ছবি দেখানো হয়। ছবি: ছবি: সাদী মুহাম্মাদ আলোক/স্টার

অনুষ্ঠানে আন্দোলনকালে পেশাগত দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা শোনান দৃকের আলোকচিত্রী হাবিবুল হক, পারভেজ আহমেদ, সুমন পাল, সুলতান মাহমুদ ও ইশতিয়াক করিম এবং দৈনিক ইত্তেফাকের আবদুল গনি, বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের নাঈম আলী ও মানবজমিনের জীবন আহমেদ।

হাবিবুল হক বলেন, 'সবাই মিলে একত্রিত হয়ে নির্ভয়ে কাজ করতে চাই। তবেই সেটা মানুষের উপকারে আসবে, ভালো কাজ হবে।'

আবদুল গনি বলেন, 'সব আন্দোলনে সাংবাদিক মার খাবে, কিন্তু আমাদের কখনো থামিয়ে রাখতে পারবে না। আমি এই আন্দোলনে আহত হয়ে ঘরে ছিলাম, কিন্তু থাকতে পারিনি। বাইরে যা হচ্ছে, সেটা দুনিয়াকে জানাতে হবে।'

গত ১৫ আগস্টে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, 'সাংবাদিক সব সরকারের শত্রু হয় জানি। কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও কেন আমার থেকে ক্যামেরা কেড়ে নেবে? কেন ছবি তুলতে বাধা দেওয়া হবে?'

আলোকচিত্রীদের কথার ফাঁকে ফাঁকে তাদের তোলা বিভিন্ন ছবি ও সেগুলোর পেছনের গল্প তুলে ধরা হয়। ছবিগুলোতে আন্দোলনের নানা মুহূর্ত, গুরুত্বপূর্ণ বাঁক, বিপ্লবের স্পৃহা, জাতীয় পতাকায় ঢাকা মরদেহ ও গণজাগরণের নানা দিক উঠে এসেছে। 

আলোকচিত্রী জীবন আহমেদ বলেন, 'আন্দোলনের ছবি তোলার জন্য আমাকে গোয়েন্দা বিভাগের অফিসে নিয়ে গিয়েছিল। আমাকে নিয়মিত অনুসরণ করা হতো। আমি পুলিশের গুলি খেয়েছিলাম। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকেরা নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিচ্ছিল যে, কে কয়জনকে গুলি করে মারবে।'

'এক যায়গায় ম্যাজিস্ট্রেট বলছিল, এইখানে তিনটা ফালায় (লাশ) দাও, আমি দেখলাম গুলি করছে একজন, দুইজন করে আন্দোলনকারী মরে পড়ে যাচ্ছে', যোগ করেন জীবন।

এখনো আন্দোলনের সময়কার ট্রমা থেকে বের হতে পারেননি উল্লেখ করে আলোকচিত্রী নাঈম আলী বলেন, 'আমার চোখের সামনে অনেক আন্দোলনকারীকে পুলিশ গুলি করে মেরে ফেলেছে। একা থাকায় অনেক সময় ছবিও তুলতে পারিনি ভয়ে।'

Comments

The Daily Star  | English
compensation for uprising martyrs families

Each martyr family to get Tk 30 lakh: Prof Yunus

Vows to rehabilitate them; govt to bear all expenses of uprising injured

3h ago