বাংলাদেশের প্রতীক কী?
লেখক, গবেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী তার ৮৯তম জন্মদিন উপলক্ষে গত ২৯ জুন শিশু একাডেমি মিলনায়তনে (ফিরে দেখা) একক আত্মজৈবনিক বক্তৃতা দেন। বক্তৃতায় উঠে আসে তার মুক্তিযুদ্ধের আগে-পরের সমাজ, রাষ্ট্র ও রাজনীতির নানা অনুষঙ্গ ও স্মৃতি, শৈশবের দিনগুলো। সবমিলিয়ে তার বক্তৃতাটি যেন ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসেরই অংশ।
আত্মজৈবনিক বক্তৃতার কথাগুলো পাঁচ পর্বে প্রকাশিত হবে দ্য ডেইলি স্টার বাংলায়। দীর্ঘ বক্তৃতাটি অনুলিখন করেছেন মোস্তফা মুশফিক ও ইমরান মাহফুজ। আজ প্রকাশিত হচ্ছে এর তৃতীয় পর্ব।
বাংলাদেশে এখন আমরা কোন প্রতীক নিয়ে কথা বলব? কাকে প্রতীক হিসেবে ধরব? অনেক ঘটনা, কোন ঘটনাকে প্রতীক হিসেবে ধরব? বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হলো তখন যে পরিস্থিতিটা, সেটাকে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি।
যখন দুর্ভিক্ষ ছিল, পঞ্চাশের মন্বন্তর, স্বাধীন বাংলাদেশে। দেশ যখন স্বাধীন হলো, দেশভাগ তখনো কিন্তু দুর্ভিক্ষের অবস্থা। তখন রেশন কার্ড পাওয়াটা একটা বড় কাজ ছিল, কৃতিত্বের কাজ ছিল এবং রেশনে পচা গম দিত, সেই গম ভাঙ্গাতে আমাদের বিভিন্ন জায়গায় যেতে হতো।
কিশোর বয়সে আমিও গিয়েছি ওই জায়গাটা। সেই রেশন কার্ডের সময়ে, এই পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হলো। পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল রেশন কার্ডের মধ্য দিয়ে এবং বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হলো তখনো কিন্তু আমাদের সেই রেশন কার্ডের কাছে যেতে হচ্ছে—তেলের জন্য, কাপড়ের জন্য।
১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন হয়েছে। ১৭ ডিসেম্বর কী দেখলাম—সকালে বেরিয়েছি আমি আর আমার এক আত্মীয়। আমরা দেখছি লুণ্ঠন চলছে। দেখলাম গভর্নমেন্ট হাউসটা লুট হয়ে গেছে। এখান থেকে সব জিনিসপত্র নিয়ে যাচ্ছে মানুষ। চারিদিকে উল্লাস হচ্ছে, যেন একটা উৎসব। একজন দেখলাম একটা সেলাই মেশিন নিয়ে যাচ্ছে, বিয়ে বাড়ির উপহার হিসেবে।
আরেকটা ঘটনা দেখলাম, মুক্তিযোদ্ধাদের একটা সমাবেশ হয়েছে এবং সেখানে একজন মুক্তিযোদ্ধা বক্তৃতা করছেন। বক্তৃতা করার পরে বললেন, আমরা তিনটি রাজাকার ধরেছি, রাজাকারের বিচার হয়েছে এবং তিনটে রাজাকারের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে এবং মৃত্যুদণ্ড এখনই কার্যকর হবে সবার সামনে। কীভাবে কার্যকর করা হলে আমি জানি না। কিন্তু তিনটি গুলির শব্দ শুনেছি। আবার সেই লুণ্ঠন চতুর্দিকে চলছে।
অন্যদিকে দেখলাম আগের দিন ১৬ ডিসেম্বর সকাল বেলা পর্যন্ত যারা পাকিস্তান জিন্দাবাদ করেছিল, তারাই এখন জয় বাংলা বলছে। আর আমাদের বিক্রমপুরের মুক্তিযোদ্ধা একজন তার অভিজ্ঞতার কথা বলেছে, দুটো অভিজ্ঞতা—তিনি তরুণ মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, ১৭ তারিখে দেখছেন তার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার বলছেন যে ঢাকায় যেতে হবে। তিনি বোঝেননি যে মুক্তিযুদ্ধ তো শেষ হয়েছে, ঢাকায় যেতে হবে কেন। পরে তিনি বুঝতে পারলেন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ইসলামপুরে এসে থাকছেন এবং সেখানে যে ঘড়ির, স্বর্ণের, কাপড়ের দোকানগুলো লুট করেছেন। এটি তার একটা অভিজ্ঞতা বাংলাদেশে।
আরেকটা অভিজ্ঞতার কথা তিনি বলেছেন, তিনি যাচ্ছিলেন একদিন রাস্তা দিয়ে, পাশে দেখলেন একজন মাটি কাটছে এবং ঝাঁকার মধ্যে করে মাটি নিয়ে যাচ্ছে। তখন তাকিয়ে দেখেন তার পরিচিত লোক; ব্যান্ড পার্টির লোক, তার একটা ব্যান্ড পার্টি ছিল সেখানে সে ব্যান্ড বাজাত। তিনি গাড়ি থেকে নেমে এলেন সেই লোক তাকে এসে জিজ্ঞেস করলেন, 'চাচা কী করছেন?' তিনি বললেন, 'বলেছিলে না মুক্ত হব? এই দেখ, মুক্তি নিয়ে আমি মাটি কাটছি'।
আমি সেই আত্মহত্যার কথাটাই বলি, ব্রিটিশ আমলের সেই আত্মহত্যা। এখন আমাদের গ্রামেই তিনজন মানুষ, তখন তো একজন মানুষ আত্মহত্যা করেছিল। এই ৬-৭ বছর আগের ঘটনা তিনজন মানুষ আত্মহত্যা করেছে এক পরিবারের, তারা ঋণ নিয়েছিল মাছের ব্যবসা করতে, তারপরে শোধ করতে পারেনি। এই শোধ করার তাগাদা আসছিল। সেই অসহায় অবস্থায় তারা ভাতের সঙ্গে বিষ মিশিয়ে খেয়ে বাবা মরেছে, মা মরেছে, তার মেয়েটাও। এটিকে কি আমি প্রতীক বলব?
এই যে একজনের জায়গায় তিনজন, এই উন্নতি কি আমি উন্নতি বলব? উন্নত হয়েছে তার মধ্যে এটাও কিন্তু একটা উন্নতি, আমরা প্রতিদিন আত্মহত্যার কথা শুনছি।
আত্মহত্যা আমার মনের মধ্যে দাগ কেটে গেছে। এই কদিন আগেই আত্মহত্যার কথা শুনলাম। নোয়াখালীর সেনবাগের এক জায়গায় একজন বয়স্ক লোক কামাল উদ্দিন মজুমদার, ৬৭ বছর বয়স। তিনি আত্মহত্যা করেছেন কাঁঠাল গাছের সঙ্গে, ছয় পৃষ্ঠার একটা চিরকুট লিখে গেছেন। তাতে দুঃখের কথা বলছেন; দীর্ঘদিনের অভাবের দুঃখ, এই দুঃখ ঋণের দুঃখ। সম্ভ্রান্ত লোক তিনি। ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগের সভাপতি, নাম দেখে তো বোঝাই যাচ্ছে যে লোকটা সম্ভ্রান্ত। তার পরিবারে কোনো উপার্জনক্ষম মানুষ নেই। একমাত্র তিনিই আছেন, সেজন্য তিনি কাঁঠাল গাছে ঝুলে আত্মহত্যা করেছেন। একে কি আমি প্রতীক বলব? বাংলাদেশের প্রতীক?
ধরুন, কয়দিন আগে হয়েছে জল্লাদের মৃত্যুর খবর। এই জল্লাদ কে? তিনি কোনো পেশাগত জল্লাদ নন। এই জল্লাদ হচ্ছেন একজন আসামি, যিনি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পেয়েছিলেন এবং ফাঁসি কার্যকর করার কাজে তাকে লাগানো হয়েছিল। অনেক ফাঁসি তিনি দিয়েছেন এবং এই অনেক ফাঁসি দেওয়ার কারণে তার শাস্তি লাঘব করা হয়েছে। তিনি মুক্ত হয়েছেন। মুক্ত হয়ে স্বাভাবিক জীবনে পৌঁছেছেন, স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে যাচ্ছেন, বিয়ে করেছেন এখন পরিবার শুরু করতে যাচ্ছেন। তার স্ত্রী এবং স্ত্রীর মা তার যত স্বর্ণালংকার যা ছিল নিয়ে পালিয়ে গেছে।
এই জল্লাদ বলছেন, আমি জেলখানাতে বরং ভালো ছিলাম। বাইরে এসে দেখি যে আমার এই জীবন! শুনলাম জল্লাদটা মারা গেছেন। তার হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে গেছিল। এটাকে কি আমি বলব বাংলাদেশের প্রতীক? নাকি প্রতীক বলব লুণ্ঠনকারীদের? নাকি মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতীক বলব? মুক্তিযোদ্ধাদের বলতেই পারি, মুক্তিযোদ্ধারা যাদেরকে আমরা স্মরণ করি, যারা যুদ্ধ করেছেন।
পাকিস্তানিদের একটা বইয়ে উল্লেখ করেছে যে, একটা যুবককে ধরে নিয়ে গেছে পাকিস্তান সেনাবাহিনী। সে মুক্তিযোদ্ধা, সাথে তো অস্ত্র পাওয়া গেছে। তাকে বলছে, 'তোর সাথে কে কে ছিল তাদের নাম বল?', সে নাম বলবে না। তার বুকে বন্দুক ধরে বলা হলো 'নাম বল নাইলে গুলি করবো', সে বলছে 'নাম বলবো না'। তারপর সে কী করলো। সে 'জয় বাংলা' বলে চিৎকার করে মাটির ওপর দাঁড়ালো এবং পাকিস্তানিরা তাকে গুলি করল। এটাকেও আমরা প্রতীক বলতে পারি। নূর হোসেনকে আমরা প্রতীক বলতে পারি, এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় যে প্রাণ দিয়েছিল। আমরা ডাক্তার মিলনকে প্রতীক বলতে পারি। কিন্তু আমার কাছে আমাকে যদি প্রতীক বলতেই হয়, তবে একজনের কথা বিশেষভাবে মনে পড়ে।
তিনি একজন মেয়ে। আমরা যে উন্নতির কথা বলছি, সেই উন্নতির মধ্যে কিন্তু মেয়েদের উন্নতি হচ্ছে না। আমাদের গ্রামে মেয়েদের স্কুল ছিল না। আমাদের গ্রামে যাদের বাবা সরকারি চাকরি করতেন, শুধু তারাই লেখাপড়ার সুযোগ পেতেন। সেই গ্রামে স্কুল হয়েছে, উন্নতি হয়েছে, মেয়েদের স্কুল হয়েছে। মেয়েদের স্কুল থেকে একটা প্রসেশনের ছবি বের হয়েছিল কাগজে। সেটা হচ্ছে মেয়েদের 'বখাটেদের থামাতে' হবে। গ্রামে বখাটেরা খুব উত্যক্ত করে মেয়েদের। মেয়েরা তাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছে এবং যে মেয়েটি সামনে আসে সে ক্লাস টেনে পড়ে। সেই হচ্ছে সবচাইতে নাখোশ এবং সবচেয়ে ভালো ছাত্রী। এই ছেলেগুলো কিছু করে না। তাদের বাবা-ভাইগুলো বিদেশে আছে। তারা এখানে টাকা পাঠায় এবং এই ছেলেগুলো মেয়েদের উত্যক্ত করে।
মেয়েটা প্রতিবাদ করেছে। তারপর একদিন তারই চেনা একজন তাকে এমন বিশ্রী কথা বলেছে যে সে এসে নিজেদের বাড়িতে গাছের সঙ্গে ঝুলে আত্মহত্যা করেছে। এই মেয়েটাকে মনে হয় বাংলাদেশের প্রতীক বলতে পারি। আত্মহত্যা অনেকে করছে, কিন্তু এই মেয়ে নিজের জন্য আত্মহত্যা করেনি। সে একটা প্রতিবাদ করেছে উত্তপ্তকারীর বিরুদ্ধে। সে আগেও প্রতিবাদ করছিল, এবার শেষ প্রতিবাদ করল নিজের প্রাণ দিয়ে। এই মেয়েকে মনে হয় আমরা বাংলাদেশের প্রতীক হিসেবে বলতে পারি।
Comments