তীব্র গরম থেকে বাঁচতে কবরস্থানের গাছের ছায়ায় বসে থাকেন তারা

ঢাকার মিরপুরের ভাসানটেক পুনর্বাসন প্রকল্প সংলগ্ন কবরস্থানের গাছের নিচে তীব্র গরমে স্বস্তির আশায় মানুষজন। ছবি: স্টার

রাজধানী ঢাকার মিরপুরের ভাসানটেক পুনর্বাসন প্রকল্প (বিআরপি) সংলগ্ন কবরস্থানের দুপাশে দেয়াল ঘেঁষে সারি বেঁধে বসে আছে প্রায় অর্ধশত মানুষ। শিশুরা খেলছে, কেউ হাঁটছেন।

কথা বলে জানা যায়, তারা পাশের আবুলের বস্তির বাসিন্দা। কোনো ধর্মীয় উপলক্ষকে কেন্দ্র করে নয়, গরম থেকে বাঁচতে তারা কবরস্থানের গাছের ছায়ায় আশ্রয় নিয়েছেন।

আবুল হোসেন এখানকার প্রথম বাসিন্দা বলে আবুলের বস্তি নামেই সবাই চেনেন। পরবর্তীতে আরও ৩১৮টি ঘর ওঠে। বস্তির ভেতরেই আবুল মুদি দোকান চালান।

মঙ্গলবার দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে আলাপকালে আবুল বলেন, 'আমার বয়স এখন ৫৫ বছর। ৩৬ বছর ধরে আমি এখানে আছি। এই ৩৬ বছরে এ রকম গরম আর দেখিনি।'

তিনি বলেন, 'বস্তিতে সবার টিনের ঘর। উচ্চতাও বেশি না। আমার ঘরের উচ্চতা আট ফুট। সকাল ৭টা বাজতে বাজতে টিন এমন গরম হয়ে যায় যে, ঘরের ভেতরে থাকা যায় না। বিদ্যুৎ সংযোগ এক ঘর থেকে অন্য ঘরে গেছে, যে কারণে ভোল্টেজ একদম কম। ফ্যানের বাতাস গায়ে লাগে না বললেই চলে।

ছবি: স্টার

'সেই কারণে কবরস্থানের গাছের ছায়ায় বসে আমাদের দিন কাটে। যাদের কাজে না গিয়ে উপায় নেই, তাদের তো যেতেই হয়,' বলেন তিনি।

আবুল বলেন, 'গরমে বস্তি লোকজন, বিশেষ করে শিশু আর বৃদ্ধরা অসুস্থ হয়ে পড়ছে। গত সপ্তাহে আমার স্ত্রী অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। কুর্মিটোলা হাসপাতালে তিন দিন ভর্তি রাখতে হয়েছে।'

তিনি বলেন, 'এখানেই যা একটু স্বস্তি। রান্না-গোসল করতে অনেকে ঘরে যায়, আবার ফিরে এসে গাছের ছায়ায় বসে। সকাল থেকে রাত ১টা, কোনো কোনো রাতে ৩টা পর্যন্ত আমাদের এখানেই কেটে যাচ্ছে।

'রাতের ঘরে ঢোকা যায় না। টিনের গরম নামতে থাকে। এখানে সব সময় বাতাস থাকে। এই তাপের মধ্যে বাতাস অমৃত মনে হয়,' যোগ করেন তিনি।

এই বস্তিতে গত চার বছর ধরে বাস করছেন শামসুদ্দিন মজুমদার। পেশায় তিনি অটোরিকশাচালক। দুই ছেলে, দুই মেয়ে নিয়ে ছয় সদস্যের পরিবার তার।

শামসুদ্দিন জানান, তার ঘর তুলনামূলক বড়। দুটি চৌকি, দুটি ফ্যান আছে।

'ভোল্টেজ কম থাকায় ফ্যানের বাতাস গায়ে লাগে না। গরমে শরীর খারাপ হয়ে যাচ্ছে। আগে দুই বেলা সিএনজি নিয়ে বের হতাম। এখন এক বেলা বের হচ্ছি। রোজ ৭০০-৮০০ টাকা আয় হতো, এখন ২০০ টাকার বেশি থাকে না। রাস্তায় যাত্রীও পাওয়া যায় না। গাড়ি চললে একটু ভালো লাগে, এই গরমে কোথাও একটু দাঁড়ানো যায় না,' বলেন তিনি।

শামসুদ্দিন বলেন, 'আমার স্ত্রী দিনমজুর হিসেবে কাজ করতো। গরমে অসুস্থ হয়ে কাজ করতে পারছে না। পরিবারের সবাই পাঁচ থেকে সাত ঘণ্টা কবরস্থানের পাশে বসে কাটাচ্ছি।'

গরমের কারণে আয় কমেছে বলে জানালেন মমিনুল ইসলাম। কবরস্থানের সামনে গাছ তলায় এই প্রতিবেদকের সঙ্গে তার কথা হয়।

মমিনুল মিরপুর এলাকায় রিকশা চালান। তিনি বলেন, 'বস্তির সব ঘর মাটির ওপরে না। আমার ঘরের নিচে খাল। বাঁশের ওপর পাটাতন বিছিয়ে ঘর তোলা হয়েছে। নিচে কচুরিপানা। এক দিকে প্রচণ্ড গরম, অন্য দিকে প্রচণ্ড মশা। ঘরে টেকা মুশকিল হয়ে গেছে।

'রিকশা চালাতে শুরু করলেও গোসল হয়ে যায়, প্যাডেল আগায় না। ইনকাম কমে গেছে। গত এক মাসে ১৫ হাজার টাকা ঋণ হয়ে গেছে,' বলেন তিনি।

এর মধ্যে আবুল হোসেনের মুদি দোকানে বাকি হয়েছে পাঁচ হাজার টাকা। এছাড়া মাসে ২০ শতাংশ সুদে ১০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছেন মমিনুল।

'গরমে যেমন আয় কমেছে, খরচও বেড়েছে। বড় খরচ ঠান্ডা পানি কেনা। দুই ছেলে রোজই ঠান্ডা ড্রিংকস খেতে চায়,' বলেন তিনি।

মমিনুল বলেন, 'আমরা রিকশা চালাই, বিভিন্ন সময় গাছের ছায়ায় বসি। এবারের গরমে বুঝলাম গাছ কত উপকারী! এই কবরস্থানের গাছগুলো না থাকলে আমরা কোথায় যেতাম! গাছের উপকারিতা গত দুই সপ্তাহ ধরে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি!

'এখানে আমরা আগেও আসতাম-বসতাম, গল্প করতাম, লুডু খেলতাম। কখনো ভিন্ন কিছু মনে হয়নি। এই গরমে জায়গাটা আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে,' যোগ করেন তিনি।

Comments

The Daily Star  | English

Dengue cases see sharp rise in early July

Over 1,160 hospitalised in first 3 days, total cases cross 11,000

15h ago