এমভি আবদুল্লাহ

দস্যুদের হাতে জিম্মি ৩৩ দিন, 'আর জাহাজে চাকরি করতে চাই না'

নূর উদ্দিন। ছবি: সংগৃহীত

প্রায় ৩৩ দিন সোমালিয়ার জলদস্যুদের হাতে জিম্মি ছিলেন বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আব্দুল্লাহ'র কর্মী মোহাম্মদ নূর উদ্দিন। মানসিকভাবে এতটাই ভেঙে পড়েছেন যে তিনি আর ওই জাহাজে করে সাগরপথে দেশে ফিরতে আগ্রহী নন। বরং দুবাইয়ের বন্দরে নেমে সেখান থেকে দ্রুত বিমানে দেশে ফিরতে চান।

শুধু তাই নয়, আপাতত জাহাজের পেশাতেই আর ফিরতে চাইছেন না ২৮ বছর বয়সী নূর উদ্দিন। ওই জাহাজে জেনারেল স্টুয়ার্ট হিসেবে কর্মরত তিনি। চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলায় থাকেন তার মা, স্ত্রী এবং তাদের আড়াই বছরের সন্তান। 

গত শনিবার গভীর রাতে হোয়াটসঅ্যাপে সংক্ষিপ্ত বার্তার মাধ্যমে দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে কথা হয় নূর উদ্দিনের। জিম্মি দশা সম্পর্কে জানতে চাইলে ২০১৫ সাল থেকে এ পেশায় থাকা নূর উদ্দিন বলেন, 'এরকম ঘটনা যেন কোনো নাবিকের জীবনে না আসে। আমার শরীর এখন ভালো। তবে মানসিকভাবে আমি একটু দুর্বল হয়ে পড়েছি। যে ভয়ঙ্কর সময়টা পার করে এসেছি, তা যদি আবার ফিরে আসে! এরকম ভয় কাজ করছে।'

তার সঙ্গে যখন বার্তা আদান-প্রদান হচ্ছিল জাহাজটি তখন সংযুক্ত আরব আমিরাতের আল হামরিয়া বন্দরের পথে। গতকাল বাংলাদেশ সময় বিকেল সাড়ে ৪টায় জাহাজটি আম্বিয়া বন্দরের বহিঃনোঙ্গরে পৌঁছেছে। এই বন্দরে জাহাজের থাকা কয়লা খালাসের পর এর ২৩ জন নাবিকের ২১ জন জাহাজটিতে করেই সাগরপথে দেশের ফিরবেন বলে জানিয়েছেন মালিক কর্তৃপক্ষ।

তবে বাকি দুজন এই বন্দরে জাহাজ থেকে নেমে যেতে চান। তাদের একজন নূর, অন্যজন জাহাজের দ্বিতীয় কর্মকর্তা মোজাহেরুল ইসলাম চৌধুরী।

নূর দ্য ডেইলি স্টারকে পাঠানো বার্তায় বলেন, 'আরব আমিরাত থেকে বাংলাদেশে যাওয়ার সাগর পথটাও বিপদসংকুল। আসলে দস্যুরা হাই রিস্ক এরিয়া থেকেও অনেক দূরে গিয়ে জাহাজে আক্রমণ করছে। আমার এখন মনে হচ্ছে জাহাজে চাকরি আর করব না। পরে পরিস্থিতি কী হয় এখনো জানি না। অন্য কোনো কিছু করতে না পারলে হয়তো আবারও ফিরে আসতে হতে পারে এ পেশায়।'

এসময় জলদস্যুদের হাতে আটক থেকে শুরু করে ঘটে যাওয়া সব ঘটনার বর্ণনা দেন নূর। স্মরণ করেন জিম্মি দশায় কাটানো দুঃসহ সেই ৩৩ দিন। দক্ষিণ আফ্রিকার দেশ মোজাম্বিকের মাপুতো বন্দর থেকে ৫৫ হাজার টন কয়লা নিয়ে আরব আমিরাতের আলহামরিয়া বন্দরে যাওয়ার পথে গত ১২ই মার্চ সোমালিয়া উপকূল থেকে প্রায় ৬০০ নটিকেল মাইল দূরে ভারত মহাসাগরে জলদস্যুদের কবলে পরে এনভি আব্দুল্লাহ।

কী ঘটেছিল সেদিন? 

ওই অঞ্চলে সেদিন ছিল দ্বিতীয় রমজানের দিন। আর সবার মতো নূর উদ্দিনও রোজা রেখেছিলেন। রাতের শিফটে ডিউটিতে ছিলেন তিনি। সারারাত ডিউটি শেষে সকালে নিজের কেবিনে ঘুমিয়ে ছিলেন। হঠাৎ অ্যালার্ম বাজার শব্দে তার ঘুম ভেঙে যায়। 

জাহাজের ক্যাপ্টেন ঘোষণা করলেন, 'পাইরেটস বোট সাসপেক্টেড"। যারা দিনের বেলায় ডিউটিতে ছিলেন তারা আগেই জাহাজের ব্রিজ রুমে পৌঁছে যান। নূরসহ বাকিরা ও সেখানে গিয়ে দেখেন ক্যাপ্টেন আব্দুর রশিদ বিভিন্ন দিকে ফোন করছেন। বিদেশি নৌবাহিনী জাহাজগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছেন।

'দেখতে পেলাম অনেকটা দূরে একটা বড় মাছ ধরার নৌকা থেকে একটা স্পিডবোট আমাদের দিকে তেড়ে আসছে,' নূর বলেন। 

ক্যাপ্টেন তখন জাহাজটিকে আঁকাবাঁকা পথে এগিয়ে নিচ্ছিলেন যাতে স্পিডবোটটি কাছে ঘেঁষতে না পারে।কিন্তু জাহাজের চেয়ে তাদের স্পিডবোটের গতি ছিল বেশি ফলে সেটি জাহাজের ডানে-বামে ছুটে আসতে থাকে বলে নূর জানান।

'বোটে থাকা মানুষগুলোর কাছে অস্ত্র দেখে আমরা অনেক ভয় পেয়ে গেলাম। ক্যাপ্টেনের নির্দেশে তৎক্ষণাৎ ২০ জন নাবিক ও কর্মী জাহাজের সুরক্ষিত জায়গা সিটাডেলে চলে গেলেন। একটু পরে ক্যাপ্টেন এবং চতুর্থ ইঞ্জিনিয়ার যখন প্রায় সিটাডেলের কাছে চলে এসেছিলেন ঠিক তখন শোনা গেল ব্রিজ থেকে দ্বিতীয় কর্মকর্তার আর্তনাদ, "ক্যাপ্টেন স্যার, ক্যাপ্টেন স্যার, ওরা আমাকে ধরে ফেলেছে, আপনি এখানে আসুন"।'

নূর জানান, ক্যাপ্টেন তখন সিটাডেলে না ঢুকে ব্রিজে চলে যান। আর যাওয়া মাত্রই দস্যুরা অস্ত্র ঠেকিয়ে সব নাবিক ও কর্মীকে ব্রিজে আসতে বলার জন্য তাকে জোর করতে থাকে। নিরুপায় হয়ে ক্যাপ্টেন তাদের সবাইকে ব্রিজে যেতে বললে সব নাবিকেরা সেখানে চলে যান। 

'আমরা দেখলাম দস্যুরা অস্ত্র ধরে আছে। আমরা হাত উঁচু করে সেখানে গেলাম। তারা আমাদের বন্দী করে ফেলল। তখন ক্যাপ্টেন স্যার বললেন আমরা সবমিলিয়ে এই ২৩ জন আছি।'

এটা শুনে দস্যুদের সে কি উল্লাস! তারা আকাশে গুলি ছুঁড়লো। তারা আমাদের প্রচুর ভয় দেখিয়েছে। আমরা হাঁটু গেড়ে নিচু হয়ে বসলাম। ওরা তখন জাহাজের ইঞ্জিন বন্ধ করতে বলে। মাছ ধরার বড় বোটটিও তখন কাছে চলে আসে। সেই বোট থেকে দস্যুদের আরও বেশ কিছু লোক আমাদের জাহাজে ওঠে। তারা নাবিকদের ওই জাহাজে তেল ও খাবার দিতে নির্দেশ দেয়। আমাকে পাঠানো হয় খাবার নিয়ে ওই জাহাজে যাওয়ার জন্য। স্টোর রুম থেকে খাবার সংগ্রহ করতে যাওয়ার সময় আমি কেবিনে ওয়াশরুমে গিয়ে আমার পরিবারের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করে ঘটনা জানাই,' বলেন তিনি।

মাছ ধরার নৌকাটি ছিল একটি ইরানি নৌকা, যা জলদস্যুরা আগেই ছিনতাই করে বড় জাহাজ ছিনতাইয়ের কাজে লাগিয়েছিল। সেখানে বেশ কজন জিম্মি নাবিককে দেখা গেছে বলে জানান নূর। তেল ও খাবার দেওয়ার পর নৌকাটি চলে যায়। জলদস্যুরা তখন এমভি আব্দুল্লাহকে সোমালিয়ার উপকূলের দিকে চালাবার নির্দেশ দেয়। আক্রান্ত হবার একদিন পর একটি বিদেশি নৌবাহিনীর যুদ্ধ জাহাজ এমভি আবদুল্লাহর পিছু নেয়।

'সেই যুদ্ধ জাহাজ থেকে একটি হেলিকপ্টার কয়েক দফা চক্কর দিতে থাকে আমাদের জাহাজ ঘিরে। সেখান থেকে দস্যুদের নির্দেশ দেওয়া হয় জাহাজ থেকে নেমে যেতে তা না হলে তারা আক্রমণ করবে,' বলেন তিনি।

'সে এক ভয়ঙ্কর ঘটনা। এক পর্যায়ে হেলিকপ্টার থেকে গুলিবর্ষণ শুরু হয়। দস্যুরা তখন নাবিকদের মাথা তাক করে ভারী অস্ত্র ধরে আছে। আমরা অনেকেই হাঁটুতে ভর করে উপুড় হয়ে বসে ছিলাম। ওই সময় সবাই আল্লাহকে স্মরণ করছিলাম, শুধু দোয়া পড়ছিলাম। আমাদের মনে হচ্ছিল আজ হয়তো কেউ মারা যাব। তখন দস্যুদের চোখ ছিল খুব ভয়ানক। এটা আসলে ভাষা দিয়ে বর্ণনা করার মতো নয়।'

এক পর্যায়ে দস্যদের নির্দেশে ক্যাপ্টেন জাহাজের ভিএইচএফ রেডিওর মাধ্যমে ওই যুদ্ধজাহাজ আর হেলিকপ্টারকে চলে যেতে অনুরোধ করেন কারণ নাবিকরা সবাই অস্ত্রের হাতে বন্দি। সেই অনুরোধ শুনে হেলিকপ্টার এবং যুদ্ধ জাহাজটি দূরে সরে যায়। 

'ওই যুদ্ধ জাহাজ যখন দূরে চলে যাচ্ছিল তখন দস্যুরা হাসছিল,' জানালেন নূর। 

কেমন ছিল জিম্মি অবস্থার দিনগুলো? 

নূর জানালেন প্রথম দিকে দস্যুরা খুব কঠোর ছিল। সবসময় অস্ত্র হাতে পাহারা দিত তাদের কেউ না কেউ।

'প্রথম দিকে খুব বেশি টেনশন হত। প্রায়ই ব্রিজ রুমে সবাইকে বন্দি রাখা হতো। একেবারেই ঘুম হচ্ছিল না খাবার খেতে পারতাম না সবসময় ভয় কাজ করতো। মালিকপক্ষের কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ হওয়ার পর যখন সমঝোতা আলোচনা শুরু হলো তারপর থেকে দস্যুরা একটু ভালো ব্যবহার করতে শুরু করল।'

'সোমালিয়া উপকূলে আসার পর ইংরেজিতে কথা বলতে পারে এমন একজন দস্যুদের জাহাজে ওঠে। তার নাম আহমেদ। সে ক্যাপ্টেনকে নানান নির্দেশনা দিত। দস্যুরা গাছের শিকড় জাতীয় এক ধরনের মাদক চিবিয়ে খেতো। এগুলো নাকি কেনিয়া থেকে আনা হয়। এসব মাদকের কারণে তারা দীর্ঘসময় না ঘুমিয়ে থাকতে পারতো।'

নূর তার পাঠানো বার্তায় জানান, সোমালিয়া উপকূলে যাওয়ার পর দস্যুরা জাহাজে অনেক অস্ত্রশস্ত্র আনে। আরও লোক ওঠে।

'যখনই কোনো নৌবাহিনী জাহাজ দৃশ্যমান হতো, দস্যুরা আমাদের আর ব্রিজ থেকে নামতে দিত না।'

যেদিন মুক্ত হলেন তারিখটা ঠিক মনে নেই নূরের। তিনি বলেন, 'তখন সকাল। হঠাৎ সব নাবিকদের জাহাজের ৫ নম্বর হেজ কাভারের ওপর লাইন ধরে দাঁড় করিয়ে রাখা হলো। তাদের চারপাশে দস্যুরা অস্ত্র ছেড়ে দাঁড়িয়েছিল।'

নূর জানালেন, একসময় একটা ছোট ফ্লাইট আসতে দেখা গেল। সেটি জাহাজের খুব কাজ দিয়ে কয়েকবার ঘুরে গেল। এক পর্যায়ে ক্যাপ্টেন সবাইকে বললেন হাত তুলতে। নূরের মতে, এটা হয়তো সব নাবিকরা যে সুস্থ আছে এটা জানান দেওয়ার জন্য।

নূর বলেন, 'বেশ কিছুক্ষণ চক্কর দিয়ে ফ্লাইটটি একসময় চলে যায়। তখন দস্যুরা আমাদের কেবিনের ভেতর নিয়ে যায়।'

এসময় বিমান থেকে টাকার ব্যাগ ফেলতে দেখেছেন কি না জানতে চাইলে নূর বলেন, 'তখন ছিল চারিদিকে খুব রোদ। পরিষ্কার করে আমি তেমন কিছু দেখতে পাইনি। তাছাড়া তিনি মাথা নিচু করে রেখেছিলাম অস্ত্রের মুখে। তবে মনে হয়েছে ফ্লাইট থেকে সাগরে হয়তো কিছু পড়ে থাকতে পারে।'

ওই সময় জাহাজের চারপাশে বেশ কটি স্পিড বোটে জলদস্যুদের কয়েকটি গ্রুপকে পেট্রোল করতে দেখেন নূর। এরপর জলদস্যুদের খুব ব্যস্ত দেখাচ্ছিল। তারা যেন রাত হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিল। এক পর্যায়ে তারা দূরের নৌ বাহিনীর জাহাজগুলোকে আরও দূরে সরে যেতে বলে। এগুলো দূরে সরে গেলে রাত ১২টার পর সব জলদস্যুরা একে একে জাহাজ থেকে নেমে যায়। অনেকগুলো স্পিডবোট করে তারা একে একে উপকূলের দিকে চলে যায় বলে জানান তিনি। 

'তখন আমরা বুঝি যে আমরা মুক্ত হয়েছি, আমরা সবাই কোলাকুলি করি, যার যার বাসায় ফোন করি। ওই সময়টা মনে হলো যেন ঈদ। আমরা অনেকেই শুকরানা নামাজ পড়লাম। রাতে আর ঘুম হলো না। সকালে নেভির লোকজন এলে আমরা রওনা হলাম আরব আমিরাতের বন্দরের দিকে,' বলেন তিনি।

Comments

The Daily Star  | English

Al Bakhera killings: Water transport workers call for indefinite strike

Bangladesh Water Transport Workers Federation rejects ‘sole killer’ claim, demands arrest of real culprits, safety of all workers

19m ago