‘ইনশাআল্লাহ, ঈদের পর আবার ঈদ হবে প্রিয়জনদের সঙ্গে’

‘তারপরও একসঙ্গে এতগুলো প্রিয় মুখ দেখার লোভটা আপাতত সামলেই নিতে হচ্ছে’
এমভি আব্দুল্লাহ। ফাইল ছবি সংগৃহীত

সোমালিয়ান জলদস্যুদের হাতে বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আব্দুল্লাহ জিম্মি হওয়ার একমাস হলো আজ। ঘটনার পরপরই জাহাজের মালিক প্রতিষ্ঠান ও সরকারের তৎপরতায় জিম্মি ২৩ নাবিক ও তাদের পরিবারের মনে আশা ছিল, হয়তো ঈদের আগেই তারা মুক্ত হয়ে দেশে ফিরবেন।

তেমন হলে হয়তো এবারের ঈদ হতে পারত তাদের জীবনের সেরা ঈদ। কিন্তু তা হয়নি।

জলদস্যুদের কড়া পাহারায় নাবিকরা ঈদের নামাজ পড়েছেন জাহাজেই। আজ সারা দেশে যখন সবাই ঈদের আনন্দে মাতোয়ারা, তখন তাদের পরিবারগুলো দিন কাটছে উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠায়।

গতকাল বুধবার পরিবারের কাছে পাঠানো অডিও বার্তায় জাহাজের এক জ্যেষ্ঠ নাবিকের কণ্ঠেও ঝরে পড়ল সেই আক্ষেপ।

বার্তার শুরুতেই এই নাবিককে বলতে শোনা যায়, 'মনে প্রাণে দোয়া করছিলাম, এবারের ঈদটা যেন বাসায় করতে পারি। কারণ, এবার আমাদের সঙ্গে ঈদ করতে মুখিয়ে আছে পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবসহ শুভাকাঙ্ক্ষীরা।'

'তারপরও একসঙ্গে এতগুলো প্রিয় মুখ দেখার লোভটা আপাতত সামলেই নিতে হচ্ছে' বলে কষ্টের অনুভূতি প্রকাশ করলেন এই নাবিক।

জানালেন মনকে আরেকবার শক্ত করছেন তারা, 'কারণ, এখন পরিস্থিতিই তো নিজেকে সামলিয়ে নেওয়ার। নিজেকে মানিয়ে নিতে হচ্ছে এই জিম্মিদশার সঙ্গে।'

জিম্মি দশায় এক মাস যেমন কেটেছে নাবিকদের

জিম্মি অবস্থায় গত একমাস নাবিকদের কীভাবে কেটেছে, তার কিছুটা প্রকাশ পেয়েছে এই নাবিকের অডিও বার্তায়।

তিনি বলেন, 'মূলত ক্যাপ্টেন মো. আব্দুর রশিদ স্যারের সুন্দর ম্যানেজমেন্ট এবং সব নাবিকের ধৈর্য ও সুন্দর মন-মানসিকতার ফলে শুরু থেকেই সোমালিয়ার জলদস্যুদের সঙ্গে আমাদের একটা ভালো বোঝাপড়া হয়েছিল। তাছাড়া একবার জিম্মি হয়ে গেলে তাদের সঙ্গে সহযোগিতা করা ছাড়া আর কিছু করতে যাওয়া এক ধরনের বোকামি।'

'শুরুতে জলদস্যুরা আমাদের সঙ্গে একটু কঠোর আচরণ করলেও যখন তারা আশ্বস্ত হলো, তখন তারা আমাদের নামাজ-রোজা এগুলোর জন্য কিছুটা ছাড় দিত। ফলস্বরূপ দিনে আমরা কেবিনে এবং রাতে সবাইকে ব্রিজে থাকার অনুমতি দেওয়া হলো এবং সপ্তাহে একদিন স্যাটেলাইট ফোনের মাধ্যমে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করার অনুমতিও দিলো।'

দুম্বা ও প্রয়োজনীয় রসদ সরবরাহের বিষয়টিকে তিনি সাধারণ ব্যাপার হিসেবে উল্লেখ করে জানিয়েছেন, 'এটা ছিল একটি কমন ব্যাপার। যেটা সাধারণত সব জিম্মি জাহাজের ক্ষেত্রে হয়ে থাকে।'

প্রতিকূলতা

ভিন্ন এক পরিবেশে বন্দি অবস্থায় প্রতিকূলতার সঙ্গে কীভাবে মোকাবিলা করেছেন সবাই, এই নাবিকের কণ্ঠে তার কিছুটাও ফুটে উঠেছে।

'পরিস্থিতির কারণে এখন আমরা সবাই যেমন দুম্বার মাংস খেতেও অভ্যস্ত হয়েছি, তেমনি সপ্তাহে একদিন এক ঘণ্টা করে পানি ব্যবহার করতে অভ্যস্ত হয়েছি। কবে নাগাদ মুক্ত হবো সেটা ভাবতে ভাবতে সারারাত নির্ঘুম কাটানোর অভ্যাসও আমাদের হয়ে গেছে। প্রায় সময় টেস্ট ফায়ারিংয়ের শব্দে পুরো জাহাজ কেঁপে ওঠে। এটাও এখন আমাদের অভ্যাস হয়ে গেছে।'

'গাদাগাদি করে ব্রিজের ফ্লোরে সবাই গল্প করে রাত কাটানোর অভ্যাসও আমাদের হয়ে গেছে। ইনশাল্লাহ সামনের দিনগুলোতেও আমরা সারভাইভাল টেকনিক অ্যাপ্লাই করে পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে ভালো থাকার চেষ্টা করব।'

নাবিকদের প্রত্যাশা জানিয়ে তিনি বললেন, 'আমরা আশা করব পুরো দেশবাসীর দোয়ায়, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায়, নৌ মন্ত্রণালয় ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপে এবং আমাদের প্রিয় আব্দুল্লাহ জাহাজের মালিকপক্ষ এসআর শিপিংয়ের আন্তরিক ও তড়িৎ প্রচেষ্টায় খুব শিগগির দস্যুদের সঙ্গে মুক্তিপণের বিষয়ে একটি দফারফার মাধ্যমে দ্রুতই অবসান ঘটবে এই জিম্মিদশার।'

'ইনশাআল্লাহ, ঈদের পর আবার ঈদ হবে আমাদের প্রিয়জনদের সঙ্গে, প্রিয় মাতৃভূমিতে, প্রিয় বাংলাদেশে। সে পর্যন্ত অবশ্যই আপনারা সবাই আমাদেরকে আপনাদের দোয়ায় রাখবেন। ভালো থাকুক প্রিয়জন, ভালো থাকুক প্রিয় বাংলাদেশ। ঈদ মোবারক বাংলাদেশ।'

জলদস্যুদের সঙ্গে দর কষাকষি শেষ করে ঈদের পরপরই ২৩ নাবিকসহ জাহাজ দেশে ফিরিয়ে আনার সম্ভাব্য উপায় নিয়ে আগাম পরিকল্পনা শুরু করেছে জাহাজের মালিকানা প্রতিষ্ঠান কেএসআরএম।

ইতোমধ্যে, জাহাজের ক্যাপ্টেন মালিকপক্ষের নির্দেশনা অনুযায়ী ক্রুদের কাছে জানতে চেয়েছেন জিম্মিদশা থেকে মুক্ত হওয়ার পর তারা কোথায় সাইন-অফ (জাহাজের কার্যক্রম থেকে অব্যাহতি) করতে চান—পরবর্তী বন্দর সংযুক্ত আরব আমিরাত, কিংবা জাহাজ চট্টগ্রামে পৌঁছালে।

মুক্তির পর সংযুক্ত আরব আমিরাতের একটি বন্দরে কয়লা খালাস করার কথা এবং তারপর সরাসরি চট্টগ্রাম বন্দরে যাওয়ার কথা আছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।

জাহাজের এক নাবিকের ঘনিষ্ঠ বন্ধু দ্য ডেইলি স্টারকে জানিয়েছেন, অন্তত ১৮ নাবিক জানিয়েছেন যে মুক্তির পর জাহাজটি আরব আমিরাতের কোনো বন্দরে পৌঁছানোর পরে তারা জাহাজ থেকে সাইন-অফ করতে চান এবং সেখান থেকে উড়োজাহাজে দেশে ফিরতে চান।

 

Comments

The Daily Star  | English

Iranian Red Crescent says bodies recovered from Raisi helicopter crash site

President Raisi, the foreign minister and all the passengers in the helicopter were killed in the crash, senior Iranian official told Reuters

4h ago