সীমান্তের ওপার থেকে অস্ত্র ও সমর্থন পাচ্ছে কেএনএফ: এম সাখাওয়াত হোসেন
নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, মিয়ানমারের চিন ও রাখাইন রাজ্য এবং ভারতের মিজোরাম ও মণিপুর রাজ্যের প্রভাবে বাংলাদেশে সশস্ত্র সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) আবির্ভাব ঘটেছে।
এক সময় পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় দায়িত্ব পালনকারী সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এসব অঞ্চলে কুকি-চিনের শক্তিশালী প্রভাব রয়েছে। চিন রাজ্যে ন্যাশনাল ডিফেন্স ফোর্স (এনডিএফ) মিয়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। বেশিরভাগ এনডিএফ সদস্য কুকি-চিন। এখান থেকে অনেক কুকি মিজোরাম গেছে। এই ইস্যুতেও সেখানে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে।'
`আমরা মণিপুরে মেইতেই ও কুকিদের মধ্যে গুরুতর সংঘর্ষ হতে দেখেছি। সীমান্তের ওপারে কুকি-চিনের চলাচল ও কার্যকলাপে এখানে কেএনএফ প্রতিষ্ঠা পায় এবং সক্রিয় হয়', বলেন তিনি।
এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, 'কেএনএফ সেখান থেকে অস্ত্র ও সহায়তা পায়।'
তিনি বলেন, 'পার্বত্য চট্টগ্রাম মাদকের প্রধান রুট হওয়ার প্রায় কাছাকাছি।'
`যেকোনো সশস্ত্র অভ্যুত্থানের সময় মাদকের আবির্ভাব ঘটে। মাদক ব্যবসা মূলত অস্ত্র সংগ্রহের জন্য অর্থ উপার্জনের একটি মাধ্যম', বলেন সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা।
তিনি বলেন, 'তারা (কুকি-চিন) এখন বান্দরবানের একটি বৃহৎ এলাকার স্বায়ত্তশাসন দাবি করছে। তবে তারা এখনও এখানে সীমান্তের ওপারে কুকি-চিন নিয়ন্ত্রিত এলাকার কথা উল্লেখ করেনি।'
এম সাখাওয়াত হোসেনের পর্যবেক্ষণ, রুমা, থানচি ও আলীকদমের দূরত্ব কম নয়। অল্প সময়ের মধ্যে এই তিনটি উপজেলায় সাম্প্রতিক হামলা থেকে বোঝা যায় যে, কেএনএফ সদস্যরা নিজেদের কয়েকটি দলে বিভক্ত করে সুপরিকল্পিত হামলা চালিয়েছে। তাদের শক্তি প্রদর্শন ইঙ্গিত করে যে, তারা এলাকাটিকে যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত করতে চায়।
তিনি বলেন, 'কেএনএফ কাচিন ইন্ডিপেন্ডেন্ট আর্মির মাধ্যমে প্রশিক্ষিত।'
এই বিদ্রাহ দমনে তিনি সেনাবাহিনীকে দায়িত্ব দেওয়ার পরামর্শ দেন। কারণ পুলিশ ও র্যাব এ বিষয়ে যথেষ্ট প্রশিক্ষিত নয়।
র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেছেন, গত ২ ও ৩ এপ্রিলে কেএনএফের ব্যাংক ডাকাতি ও আগ্নেয়াস্ত্র ছিনতাইয়ের বিষয়ে তাদের কাছে এখনও নিশ্চিত তথ্য নেই। কারণ তারা সশস্ত্র সংগঠনটির কাউকে এখনও গ্রেপ্তার করতে পারেননি।
তার পর্যবেক্ষণ, কেএনএফের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের পেছনে দুটি উদ্দেশ্য থাকতে পারে। প্রথমত তহবিল, অস্ত্র এবং গোলাবারুদ সংগ্রহ করা। দ্বিতীয়ত, পার্বত্য অঞ্চলে সমর্থক এবং প্রতিদ্বন্দ্বী গোষ্ঠীলোকে দেখানো যে, তারা পাহাড়ের একটি শক্তিশালী সশস্ত্র সংগঠন।
এদিকে শুক্রবার কেএনএফের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে সংগঠনটির মিডিয়া এবং ইন্টেলিজেন্স উইং প্রধান কর্নেল সলোমন বলেছেন যে, শান্তি কমিটি কেএনএফের সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন করায় তারা সম্প্রতি হামলা শুরু করেছে।
কেএনএফ কারা?
২০২২ সালের গোঁড়ার দিকে নতুন সশস্ত্র সংগঠন কেএনএফের নাম প্রকাশ্যে আসে। জানা গেছে, বান্দরবানের বম জনগোষ্ঠীর কিছু সদস্য এই সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছে।
একটি ফেসবুক পেজ খুলে বান্দরবান ও রাঙ্গামাটির নয় উপজেলা নিয়ে পৃথক রাষ্ট্রের দাবি জানানোর পর দলটি সামনে আসে।
উপজেলাগুলো হলো- রাঙামাটির বাঘাইছড়ি, বরকল, জুরাছড়ি ও বিলাইছড়ি এবং বান্দরবানের রোয়াংছড়ি, রুমা, থানচি, লামা ও আলীকদম।
তারা দাবি করে যে, তারা ছয়টি জনগোষ্ঠীকে প্রতিনিধিত্ব করে- বম, পাংখোয়া, লুসাই, খিয়াং, ম্রো এবং খুমি।
সে সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ কয়েকটি বিবৃতিতে কেএনএফ জানায় যে, তারা কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মি (কেএনএ) নামে একটি সশস্ত্র দল গঠন করেছে।
তারা আরও দাবি করেছে যে, তাদের সামরিক শাখার ১০০ জনেরও বেশি সদস্য তিন বছর আগে গেরিলা প্রশিক্ষণ নিতে মিয়ানমারের কাচিন প্রদেশে গেছে।
একটি প্রশিক্ষিত দল ২০২১ সালে বাংলাদেশে ফিরে আসে এবং ২০২২ সালে তারা আত্মগোপনে চলে যায়।
বান্দরবানের রুমা উপজেলার এডেনপাড়ার নাথান বম এই সংগঠনের প্রধান।
বম জনগোষ্ঠী সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের স্নাতক নাথান বম ২০০৮ সালে তার এলাকায় কুকি-চিন ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (কেএনডিও) নামে একটি বেসরকারি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। ২০১৯ সালে এর নাম পরিবর্তন করে কেএনএফ রাখা হয়।
২০২২ সালের অক্টোবরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যখন জানায় যে, নতুন জঙ্গি গোষ্ঠী জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া সদস্যদের যুদ্ধ প্রশিক্ষণ দিচ্ছে কেএনএফ, তখনই সংগঠনটি মিডিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
র্যাব কর্মকর্তারা জানান, জঙ্গি গোষ্ঠীটির পরিকল্পনা ছিল সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে বাংলাদেশে খিলাফত প্রতিষ্ঠা করা এবং প্রয়োজনে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বের ওপর হামলা করা।
তারা আরও জানান, গোষ্ঠীটি কমপক্ষে ১৯টি জেলা থেকে যুবকদের নিয়োগ করে পাহাড়ে নিয়ে যায় এবং কেএনএফের কাছ থেকে কঠোর যুদ্ধ প্রশিক্ষণ নিতে বাধ্য করে। জামাতুল আনসারের ৫৫ জন সদস্য অ্যাসল্ট রাইফেলসহ আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারে প্রশিক্ষিত।
এসব তথ্যের ভিত্তিতে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলো ধারাবাহিক অভিযান শুরু করে, যাতে কয়েক ডজন জঙ্গি এবং কেএনএফের প্রায় ২০ সদস্য আগ্নেয়াস্ত্রসহ গ্রেপ্তার হয়। সেই কেএনএফ সদস্যদের অনেকেই এখনো কারাগারে।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ অনুয়ায়ী, গত বছর অভিযানে ডিজিএফআইয়ের এক কর্মকর্তাসহ যৌথ বাহিনীর পাঁচ সদস্য নিহত হন। বেশ কয়েকজন কেএনএফ সদস্যও নিহত হয়।
কেএনএফ সদস্যদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে গত বছরের ২৯ মে বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ক্যশৈহ্লাকে আহ্বায়ক করে একটি শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি গঠন করা হয়।
কেএনএফ কমিটির সঙ্গে অনলাইনে এবং ব্যক্তিগতভাবে বেশ কয়েকটি মিটিং করেছে। গত বছরের ৫ নভেম্বর ও ৫ মার্চ দুই দফা বৈঠকে দুটি সমঝোতা স্মারকও সই হয়। কেএনএফ চাঁদাবাজি, অপহরণ এবং লুটপাটসহ সব ধরনের অপরাধমূলক কার্যকলাপ বন্ধ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।
কিন্তু প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে কেএনএফের সশস্ত্র সদস্যরা গত সপ্তাহে রুমা এবং থানচিতে সোনালী ও কৃষি ব্যাংকে হামলা চালিয়ে ব্যাংকার নেজাম উদ্দিনকে অপহরণ করে। সশস্ত্র দলটি পুলিশ ও আনসার সদস্যদের কাছ থেকে ১৪টি আগ্নেয়াস্ত্র লুট করে।
বৃহস্পতিবার রাতে থানচিতে একটি পুলিশ ফাঁড়িতে বন্দুক হামলা চালায় কেএনএফ। রাত সাড়ে ৮টায় শুরু হওয়া ঘণ্টাব্যাপী লড়াইয়ে পুলিশ এবং কেএনএফ সদস্যরা প্রায় ৭০০ রাউন্ড গুলি বিনিময় করে।
এ ছাড়াও, বিভিন্ন সময় চাঁদাবাজি, লুটপাট ও নিরীহ মানুষকে নির্যাতন করে এলাকায় ত্রাস সৃষ্টি করেছে কেএনএফ।
এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, `সশস্ত্র গোষ্ঠীর সঙ্গে শান্তি আলোচনা শুধু ওই সংগঠনগুলোকে শক্তিশালী করতেই কাজ করে।
তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এই ধরনের গোষ্ঠীর সঙ্গে শান্তি আলোচনার অর্থ হলো আপনি তাদের স্বীকৃতি দিচ্ছেন। এটি তাদের আরও সদস্য নিয়োগের সুযোগ দেয়। এটি ইঙ্গিত দেয় যে, সরকার তাদের গুরুত্ব দিচ্ছে।'
গত বছর প্রবারণার অনুষ্ঠান চলাকালীন কেএনএফ সাধারণ মানুষ, নির্মাণ শ্রমিকদের ওপর এবং বৌদ্ধ মন্দিরে হামলা চালায়। এটি পাহাড়ের আরেকটি সশস্ত্র সংগঠন ইউপিডিএফের গণতান্ত্রিকের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায়, এমনকি একটি সেতু উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। হামলা ও সংঘর্ষে অন্তত ১২ জন নিহত ও পাঁচজন আহত হন।
বম গোষ্ঠীর নেতাদের মতে, কেএনএফে প্রাথমিকভাবে ৩০০ সশস্ত্র সদস্য ছিল। গত বছর নিরাপত্তা বাহিনীর যৌথ অভিযানের সময় অনেক গ্রামের যুবক বনে পালিয়ে যায়। তাদের অনেকেই পরে স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায় কেএনএফে যোগদান করেন। এখন গ্রুপে প্রায় ৭০০ সদস্য থাকতে পারে।
Comments