পাবনার প্রথম শহীদ মিনার স্থাপিত হয় এডওয়ার্ড কলেজে

পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের নতুন শহীদ মিনার। প্রথম শহীদ মিনারটি ১৯৫৭ সালে স্থাপিত হয়েছিল বলে জানিয়েছেন ইতিহাসবিদরা। ছবি: স্টার

রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি যখন ঢাকার রাজপথ রক্তে রঞ্জিত হয়, তখন সে আন্দোলনের উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। ঢাকার নির্মম হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে ওঠে তৎকালীন পাবনার সর্ববৃহৎ বিদ্যাপীঠ পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের ছাত্ররা। বের হয় বিক্ষোভ মিছিল। ভাষার দাবিতে অকাতরে প্রাণ বিলিয়ে দেওয়া ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে কালো কাপড় দিয়ে তৈরি করা হয় অস্থায়ী শহীদ মিনার।

সেখানেই ছাত্র-জনতা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। পাকিস্তানি বাহিনীর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে প্রতি বছর ২১ ফেব্রুয়ারিতে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের সেই অস্থায়ী শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হতো।

১৯৫৫ সালে ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধা নিবেদন করতে গিয়ে পুলিশের হামলার শিকার হন ছাত্র জনতা। গ্রেপ্তার হন তৎকালীন প্রগতিশীল ছাত্রনেতারা। কিন্তু থেমে থাকেনি ভাষার জন্য পাবনার ছাত্র আন্দোলন। ভাষা আন্দোলনে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের ভূমিকা তুলে ধরে কথাগুলো বলেন, বিশিষ্ট ভাষা গবেষক পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার অধ্যাপক ড. আব্দুল আলীম।

তিনি বলেন, ১৯৫৭ সালে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজেই স্থাপিত হয় পাবনার প্রথম শহীদ মিনার। মুক্তিযুদ্ধ পূর্ব সময়ে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের শহীদ মিনার চত্বরটি ছিল সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সূতিকাগার।

কালের বিবর্তনে হারিয়ে গেছে পাবনার প্রথম শহীদ মিনারের স্মৃতি। এ প্রজন্মের অনেকেই জানে না সে ইতিহাস। কেউ নিশ্চিত করে জানাতে পারেনি পাবনার প্রথম শহীদ মিনারের ঐতিহাসিক স্থানটি।

উচ্চ শিক্ষার প্রাচীন প্রতিষ্ঠান পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ কালের বিবর্তনে উন্নত হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধের পর কলেজ ক্যাম্পাসে স্থাপন করা হয় শহীদ মিনার। ২০১৫ সালে পুরোনো শহীদ মিনারের স্থলে বর্তমান শহীদ মিনারটি নির্মিত হয়। প্রতি বছর কলেজের শিক্ষক, শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন সংগঠন পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের নবনির্মিত শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা তবে নতুন প্রজন্মের অনেকের কাছেই এখনও অজানা সেই প্রথম শহীদ মিনারের কথা।

পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের প্রাক্তন ছাত্র হাসান মাহামুদ বলেন, 'পাঁচ বছর এডওয়ার্ড কলেজে লেখাপড়া করেছি, অনেক অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছি, ভাষা শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছি কলেজের শহীদ মিনারে, তবে পাবনার প্রথম শহীদ মিনারের ইতিহাস আর এডওয়ার্ড কলেজের গৌরবোজ্জ্বল ভাষা আন্দোলনের অনেক ইতিহাসই আমার কাছে এখনও অজানা।'

'আমার মতো অনেক সাধারণ ছাত্র-ছাত্রী, দূর দূরান্ত থেকে লেখাপড়া করতে আসা শিক্ষার্থীরা প্রায় কেউই জানে না এসব ইতিহাস।'

ইতিহাসবিদদের মতে, পাবনার ভাষা আন্দোলন শুরু হয় ১৯৪৮ সাল থেকেই। সে সময়ে পাকিস্তানি সংসদে ভাষার জন্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের প্রস্তাব নাকচ হওয়ার পর পাবনায় প্রথম ভাষার জন্য আন্দোলন শুরু করে সে সময়ের বামপন্থী ও মুসলিম লীগের একাংশের নেতা কর্মীরা। গঠিত হয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। দেওয়ান লুৎফর রহমানকে আহবায়ক করে ও আমিনুল ইসলাম বাদশা ও মাহবুবুর রহমানকে যুগ্ম আহবায়ক করে আন্দোলনের রূপরেখা তৈরি করা হয়।

ভাষার দাবিতে ১৯৪৮ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি পাবনায় পালিত হয় হরতাল, জারি হয় ১৪৪ ধারা। আন্দোলনকারীদের মধ্যে প্রায় ৪০ জন গ্রেপ্তার হন, পরে অনেককে ছেড়ে দেয়া হলেও আমিনুল ইসলাম বাদশাসহ মুল সংগঠকদের বেশিরভাগই দীর্ঘ কয়েক বছর কারাভোগ করেন।

৪৮' এর ভাষা সৈনিকদের অনেকেই ১৯৫২ সালে কারাগারেই ছিলেন, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে তৎকালীন পাবনার ছাত্রনেতা মোসলেম উদ্দিন তালুকদার ভাষা আন্দোলনের মুল নেতৃত্ব দিলেও সে সময়ের ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের সবাই একসাথে ভাষার জন্য লড়াই করেন।

তৎকালীন ছাত্র নেতাদের মধ্যে আজাহার আলী, আমজাদ হোসেন, আলতাফ হোসেন, আব্দুল মতিন, কামাল লোহানি, রণেশ মৈত্রসহ অনেক ছাত্র সেদিন পাবনার আপামর জনগণকে সাথে নিয়ে ভাষার জন্য লড়াই চালিয়ে যান।      

পাবনার বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের প্রাক্তন ছাত্র ও শিক্ষক অধ্যাপক শিবজিত নাগ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, পাবনার ভাষা আন্দোলনে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা থাকলেও কালের বিবর্তনে এবং উদ্যোগের অভাবে গৌরবের স্মৃতি আজ বিস্মৃতির পথে। নতুন প্রজন্মের অনেকেই জানে না গৌরবের ইতিহাস।

পাবনার ভাষা আন্দোলনে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের গৌরবোজ্জ্বল স্মৃতি ধরে রাখতে এখনই উদ্যোগ না নিলে কালের বিবর্তনে তা পুরোপুরি হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করেন তিনি।

পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক প্রফেসর মাহবুব হোসেন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে প্রতি বছর শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা যথাযোগ্য মর্যাদায় মহান শহীদ দিবস পালন করে।

শিক্ষকরাও ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস তুলে ধরার চেষ্টা করছেন, এছাড়া ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের ভূমিকা নিয়ে কলেজে স্যুভেনির বের করার কাজ চলছে। পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের গৌরবের স্মৃতি ধরে রাখতে ইতোমধ্যে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।  

Comments

The Daily Star  | English
Nat’l election likely between January 6, 9

EC suspends registration of AL

The decision was taken at a meeting held at the EC secretariat

3h ago