শিক্ষার মাধ্যম মাতৃভাষা হতে হবে: প্রধানমন্ত্রী

রাজধানীর সেগুন বাগিচায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে ভাষণ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ছবি: বাসস

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, অন্য আরও ভাষা শিখলেও শিক্ষার মাধ্যম মাতৃভাষা হতে হবে। যেহেতু আমরা সংগ্রাম করে মাতৃভাষার মর্যাদা অর্জন করেছি। এই জন্য ছোটবেলা থেকেই একাধিক ভাষা শিক্ষার ওপর জোর দেন প্রধানমন্ত্রী। বাংলা বলার আগে ইংরেজি বলার যে একটা ঝোঁক ছিল তারও কঠোর সমালোচনা করেন তিনি।

তিনি বলেন, 'ইংরেজি বাচন ভঙ্গি বাংলা বললে ভাষার মাধুর্য হারিয়ে যায়।'

প্রধানমন্ত্রী আজ বিকেলে রাজধানীর সেগুন বাগিচায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে আয়োজিত চার দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে এ কথা বলেন।

শেখ হাসিনা বলেন, 'মাতৃভাষার পাশাপাশি আর এক-দুটি ভাষা যেন ছোটবেলা থেকে শিখতে পারে সেজন্য প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকেই উদ্যোগ নিতে হবে। তাহলে প্রয়োগের ক্ষেত্র যেমন দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাকবে না তেমনি তারা আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠবে এবং সে শিক্ষা হবে প্রকৃত জ্ঞানার্জনের জন্য শিক্ষা। সেভাবেই আমাদের শিক্ষা পরিকল্পনাগুলো নেওয়া উচিত বলেই আমি মনে করি।'

নিজের মাতৃভাষা সংরক্ষণ, চর্চা ও শক্তিশালী করার ওপর গুরুত্বারোপ করে যথাযথ অনুবাদের মাধ্যমে বাংলা শিল্প-সাহিত্যকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়ার আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী।

তিনি বলেন, 'আমাদের মাতৃভাষা সংরক্ষণ, চর্চা এবং শক্তিশালী করার পাশাপাশি সঠিক অনুবাদের মাধ্যমে শিল্প-সাহিত্যকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে হবে।'

তিনি আরও বলেন, 'বাঙালি জাতি যে নিজের ভাষার জন্য জীবন উৎসর্গ করেছে তা তুলে ধরা আমাদের সকলের কর্তব্য।'

তিনি বলেন, আমাদের মাতৃভাষাকে রক্ষা করা, চর্চা করা এবং আরও শক্তিশালী করে আমাদের শিল্পকলা, সাহিত্য সব অনুবাদ করে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে দিয়ে বাঙালি জাতি যে ভাষার জন্য নিজের জীবন দিয়ে গেছেন সেটা মানুষের সামনে তুলে ধরা আমাদের সকলের কর্তব্য। আর এই ইনস্টিটিউট থেকে আমি সেটাই আশাকরি।

সরকার প্রধান বাংলা একাডেমি এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটকে একে অপরের পরিপূরক-সম্পূরক হিসেবে কাজ কারার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।

তিনি বলেন, 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট এবং বাংলা একাডেমি এই দুটোকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। একে অপরের পরিপূরক হয়ে কাজ করতে হবে।

আমরা যখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করি তখন এটাই আমাদের মাথায় ছিল। এই দুটি প্রতিষ্ঠান যদি একসঙ্গে কাজ করে তাহলে আমরা আরও অধিক পরিমাণে শিল্প, সাহিত্য, কলাসহ বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে জানতে পারব এবং সেটাই সরকারের প্রত্যাশা।'

প্রধানমন্ত্রী প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে ভাষাকে এগিয়ে নেওয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করে ডিজিটাল ডিভাইসের সাহায্যে অনুবাদ করলেও তা যথাযথ সংশোধনের মাধ্যমে যথোপযোগী করে ব্যবহারের আহ্বান জানান।

শেখ হাসিনা বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতিসংঘে বাংলায় বক্তৃতা দিয়ে বাংলা ভাষাকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে আসেন যে পদাঙ্ক অনুসরণ করে তিনি নিজেও জাতিসংঘে (সাধারণ অধিবেশন) তার প্রতিটি বক্তৃতা বাংলায় করেছেন, যেটা অনুবাদ করেই অন্যান্য ভাষায় দেওয়া হয়।

তিনি বলেন, শুধু ভাষণের মধ্যেই নয় বাঙালিকেও মানুষ জানুক, বিশ্ব আরও জানুক। আমরা যে বিজয়ী জাতি, আমাদের একটি ভাষা আছে, সংস্কৃতি আছে সেটাও সারাবিশ্ব জানুক সেটাই আমরা চাই।

প্রধানমন্ত্রী এই সময় ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘে জাতির পিতা প্রদত্ত ভাষণের একটি উল্লেখযোগ্য অংশের উদ্ধৃতি তুলে ধরেন।

জাতির পিতা বলেছিলেন, 'শান্তি ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে সকল মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের উপযোগী একটি বিশ্ব গড়ে তোলার জন্য বাঙালি জাতি পূর্ণ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।'

তিনি বলেন, বাঙালি শান্তিতে বিশ্বাস করে। আমরা আর যুদ্ধ চাইনা,শান্তি চাই। সারাবিশ্বের যুদ্ধ ও অস্ত্র প্রতিযোগিতা বন্ধ হোক এবং এই অস্ত্র প্রতিযোগিতার যে অর্থ তা মানুষের জ্ঞান-বিজ্ঞান, গবেষণা এবং জলবায়ু পরিবর্তন, শিশু ও নারী শিক্ষা থেকে শুরু করে তাদের স্বাস্থ্য-সবক্ষেত্রেই ব্যবহার করা হোক সেটাই আমরা চাই। কাজেই শান্তি থাকলেই কিন্তু প্রগতি আসে, উন্নতি হয়, এগিয়ে চলা যায়। দেশকে আমরা এগিয়ে নিয়ে যাব এটাই আমাদের প্রতিজ্ঞা। আমরা আর পেছনে ফিরে তাকাবো না।

'৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী জাতি হিসেবে বিশ্বে বাংলাদেশ যে মর্যাদা অর্জন করেছিল এবং '৭৫ এ জাতির পিতাকে সপরিবারের হত্যার পর যা হারিয়ে যায়। তার সরকার আবার তা পুনরুদ্ধার করতে সমর্থ হয়েছে উল্লেখ করে সরকার প্রধান বলেন, উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে ২০২৬ সাল থেকে আমাদের অগ্রযাত্রা শুরু হবে। মাথা উঁচু করেই আমরা মর্যাদাশীল জাতি হিসেবে বিশ্বে এগিয়ে যাব।

শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতিবিষয়ক উপদেষ্টা কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী রুমানা আলী। স্বাগত বক্তৃতা করেন মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব সোলেমান খান।

বাংলাদেশে ইউনেস্কোর প্রতিনিধি এবং অফিস প্রধান সুজান ভাইজও বক্তব্য রাখেন, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. হাকিম আরিফ ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন।

মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. শিশির ভট্টাচার্য।

শুরুতে প্রধানমন্ত্রী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট প্রাঙ্গণে 'মুজিব শতবর্ষ যাদুঘর এবং আর্কাইভ'-এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।

অনুষ্ঠানে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ভাষায় রচিত জাতির পিতার 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী' এবং মাতৃভাষা পিডিয়া এবং মাল্টি লিঙ্গুয়াল পকেট ডিকশনারির মোড়ক উন্মোচন করেন প্রধানমন্ত্রী।

তিনি অনুষ্ঠানে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট আয়োজিত লিংগুয়িস্টিক অলিম্পিয়াড বিজয়ীদের মাঝে ও পুরস্কার বিতরণ করেন।

অনুষ্ঠানে বাংলাদেশে ইউনেস্কোর প্রতিনিধি এবং অফিস প্রধান সুজান ভাইজ প্রধানমন্ত্রীর কাছে ইউনেস্কো ক্যাটাগরি-২ চুক্তি নবায়ন নথি ও উপস্থাপন করেন।

অনুষ্ঠানের শুরুতে ভাষা আন্দোলনের শহীদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।

অনুষ্ঠানে দেশ বিদেশের শিশুরা নিজস্ব মাতৃভাষায় প্রধানমন্ত্রীকে শুভেচ্ছা জানান।

প্রধানমন্ত্রী বক্তৃতার শুরুতে ভাষা আন্দোলন সংগঠনের অন্যতম রূপকার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেন, আমাদের মাতৃভাষায় কথাবলার অধিকারটুকু পর্যন্ত কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। যখন একটি বিজাতীয় ভাষা আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয় তখন এদেশের মানুষ তা মেনে নেয়নি। সেই ১৯৪৮ সালে প্রকৃতপক্ষে আমাদের ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। যা ৫২'র একুশে ফেব্রুয়ারি রক্ত দিয়ে রক্তের অক্ষরে আমাদের শহীদরা বলে গিয়েছিলেন-মায়ের ভাষায় কথা বলতে চাই। আর এই আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।

তিনি বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তখনকার আইন বিভাগের ছাত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উদ্যোগ নেন। তিনি সংগঠন গড়ে তোলেন, ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেন এবং সে সময় তমুদ্দুন মজলিস এবং অন্যান্য আরও কয়েকটি প্রগতিশীল সংগঠনকে নিয়েই ভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়।

উল্লেখ্য, জাতির পিতা ভাষা আন্দোলন করতে গিয়ে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ কারাবরণ করেন এবং কারাগারে থাকাকালীন ৫২'র একুশে ফেব্রুয়ারি চূড়ান্ত আন্দোলনে ভূমিকা রাখেন।

সরকার প্রধান বলেন, জাতির পিতার উদ্যোগের ফলে এবং তার নেতৃত্বেই ভাষা আন্দোলনের পথ বেয়েই আমরা আমাদের স্বাধীনতা পেয়েছি এবং স্বাধীন জাতি হিসেবে আত্মমর্যাদা পেয়েছি। আর এই দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশটাই হচ্ছে একমাত্র জাতি রাষ্ট্র বা একটি ভাষার রাষ্ট্র।

তিনি একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি এনে দেওয়ায় কানাডা প্রবাসি সালাম ও রফিকসহ 'ভালবাসি মাতৃভাষা' নামক সংগঠনের অবদানকে স্মরণ করেন।

শেখ হাসিনা আজ মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে 'মুজিব শতবর্ষ জাদুঘর ও আর্কাইভ' এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের প্রসঙ্গ টেনে বলেন, এখানেই জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে অফিস করে সমস্ত কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়েছিল। আর তার নেতৃত্বে আমরা বাংলা ভাষার মর্যাদা পেয়েছি, একটি রাষ্ট্র পেয়েছি। তার জীবনের কার্যক্রম সংরক্ষণের যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে সেজন্য তিনি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটকে ধন্যবাদ জানান।

তিনি বলেন, আমাদের সঠিক ইতিহাস জানতে হবে। কিন্তু আমাদের খুব দুর্ভাগ্য যে আমাদের ইতিহাস বিকৃত করা হয়। '৭৫ এর পর আমাদের মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের ইতিহাস এমনকি ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসও বিকৃত করার চেষ্টা করা হয়েছিল। যা হোক এখন আর সেদিন নাই। ইতিহাস আসলে কেউ মুছে ফেলতে পারে না। ইতিহাস তার আপন গতিতে চলে এবং সময়মত উদ্ভাসিত হয়। আমাদের দেশের মানুষ কিন্তু সেটা এখন জানতে পেরেছে।

Comments

The Daily Star  | English

Dhaka cannot engage with non-state actors: foreign adviser

Md Touhid Hossain also emphasised that peace and stability in the region would remain elusive without a resolution to the Rohingya crisis

27m ago