শিশিরের জলে আঁকা কুয়াশার দিন

কুয়াশা
ছবি: রাজীব রায়হান/স্টার

এই গ্রীষ্মমণ্ডলীয় দেশে ক্ষণিকের অতিথি হয়ে আসা শীত ঋতুর পরিচয় বয়ে বেড়ানো কুয়াশাকে রীতিমতো বিস্ময়ের চোখে দেখেছিলেন জীবনানন্দ দাশ। বাংলা কবিতার রহস্যময় এ পুরুষ তার বিভিন্ন রচনায় কুয়াশার মতোই অজস্রবার অনুষঙ্গ করেছেন ঝরা শিশিরকেও।

জীবনানন্দ লেখেন, 'কুয়াশারে নিঙড়ায়ে উড়ে যাবে আরো দূর নীল কুয়াশায়,/কেউ তাহা দেখিবে না;—সেদিন এ পাড়াগাঁর পথের বিস্ময়'। আবার তার কলমেই ঝরে পড়ে, 'সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন/সন্ধ্যা আসে; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল;/'।

কুয়াশা
ছবি: হাবিবুর রহমান/স্টার

পৌষের ১২তম দিবস আজ। উত্তরাঞ্চলের কয়েকটি এলাকা বাদে এখন পর্যন্ত গ্রাম-শহর-জনপদে শীতের দাপুটে মেজাজ তেমন দেখা যায়নি। কিন্তু মাঠে-ঘাটে-পথে কুয়াশার মলিন আঁচল ভাসতে দেখা যাচ্ছে ছোট হয়ে আসা দিনের সকাল-সন্ধ্যায়। কখনো কখনো এই কুয়াশার হালকা স্তর গভীর ও ধূমায়িত হয়ে আচ্ছন্ন করে তুলছে চারপাশ।

এর পাশাপাশি রাতভর ঝরে পড়া শিশিরে ভিজে উঠছে ঘাস, লতাপাতা, ঘরের ছাউনি, রিক্ত মাঠ। ঘাসের ডগায়, পাতার কিনারে, ফুল-ফসল আর মাকড়শার জালে জমে থাকা স্বচ্ছ শিশিরবিন্দুতে ভোরের সোনালি রোদের স্পর্শ ছড়িয়ে দিচ্ছে মনোহর দ্যুতি; যেন তা মুক্তোদানা কিংবা হীরার কুচি।

কুয়াশা
ছবি: রাজীব রায়হান/স্টার

জীবনানন্দের মতোই কুয়াশা আর রহস্যের সম্পর্ক চিরকালের। অভিধানে কুহেলিকা কিংবা কুজ্ঝটিকার মতো কুয়াশার যে সমার্থক শব্দগুলো উল্লেখ আছে, সেগুলোর দিকে নজর দিলেই বিষয়টি খোলাসা হয়। আর যেহেতু কুয়াশা দৃষ্টিসীমাকে বাধাগ্রস্ত করে, আড়াল করে, তাই এর সঙ্গে রহস্যের যোগ খুঁজতে খুব একটা বেগ পেতে হয় না।

কিন্তু কুয়াশার বিষয়ে আবহাওয়াবিদরা যে ব্যাখ্যা দিয়ে থাকেন তা নিতান্তই সরল। এর সঙ্গে রহস্যের কোনো সম্পর্ক তখন আর পাওয়া যায় না। তাদের মতে, কুয়াশা হচ্ছে মেঘের ছোট ভাই; যেটাকে তারা ডাকছেন 'লো ক্লাউড' বলে।

কুয়াশা
ছবি: হাবিবুর রহমান/স্টার

শীতের সময় যেহেতু তাপমাত্রা কম থাকে, সেহেতু মাটিতে থাকা আর্দ্রতা উপরে উঠে গিয়ে কুয়াশা তৈরি করে।

বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক ও আবহাওয়াবিদ মোহাম্মদ শাহ আলম জানাচ্ছেন, কুয়াশা বরফের অতিক্ষুদ্র একটা অংশ। এটা আমাদের দেশে ছোট থাকে। কিন্তু যেসব দেশে তাপমাত্রা অনেক কমে যায়, সেখানে তা বড় আকার ধারণ করে ঝরে পড়ে। একেই বলে স্নো। বাংলাদেশে তাপমাত্রা কিছুটা বেশি থাকে বলে স্নো হয় না, তবে মাঝে মাঝে বৃষ্টির মতো ছোট ছোট ফোটা হয়ে ঝরে।

বাংলাদেশ ছাড়াও ভারতের বিস্তীর্ণ এলাকা এবং চীনেও কুয়াশা তৈরি হয়।

কুয়াশা
ছবি: হাবিবুর রহমান

এই কুয়াশা যখন একটু একটু করে নিচে পড়ে তখন তার নাম হয়ে যায় শিশির। বায়ুমণ্ডল অধিক পরিমাণ ঠাণ্ডা হয়ে গেলে এর জলীয় বাষ্প ধারণ করার ক্ষমতা কমে আসে। তখন কুয়াশা আরও বেশি ঘনীভূত হয়ে শিশির হয়ে নামে।

রূপসী বাংলার সনেটগুচ্ছে আবহমান বাংলার রূপ-বৈভবের এক অনন্য চিত্র এঁকেছিলেন জীবনানন্দ। এই কাব্যগ্রন্থে বাংলার বৃক্ষরাজি, ফুল, পাখি, লতা, ঘাস, নদীর মতো নানা কিছুর অনুপুঙ্খ বর্ণনা যেমন পাওয়া যায়, তেমন দেখা মেলে কুয়াশার রহস্যময়তার। তাই 'মৃত্যুর আগে' 'নির্জন খড়ের মাঠে পউষ সন্ধ্যায় নরম নদীর নারী'কে 'কুয়াশার ফুল' ছড়াতে দেখেন তিনি।

কুয়াশা
ছবি: রাজীব রায়হান/স্টার

অন্যদিকে প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে পৃথিবীর সব আয়োজন থেকে মানুষের বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার নিয়তিকে স্বাভাবিকভাবে নিয়েও দীর্ঘশ্বাস ফেলেন জীবনানন্দ। বলেন, 'আমি চলে যাব বলে/চালতা ফুল কি আর ভিজিবে না শিশিরের জলে/নরম গন্ধের ঢেউয়ে?'

আবার 'নির্জন স্বাক্ষর'-এ তিনি ঘোষণা দিয়ে যান, 'আমার বুকের 'পরে সেই রাতে জমেছে যে শিশিরের জল,/তুমিও কি চেয়েছিলে শুধু তাই;/শুধু তার স্বাদ/…আমি ঝ'রে যাবো—তবু জীবন অগাধ'।

Comments

The Daily Star  | English

Sagar-Runi murders: HC grants 6 more months to taskforce to end probe

Additional attorney general seeks nine-month time citing lost documents, staff transfers

17m ago