ইসির স্বাধীনতা ‘অস্পষ্ট’ যে ৩ কারণে
সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) সাধারণ মানুষ যে প্রত্যাশার জায়গায় দেখে, বাস্তবে তাদের কাজে তেমন প্রতিফলন না থাকার অভিযোগ প্রায়ই উঠে। বিশেষ করে জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ইসিকে ব্যাপক সমালোচনায় পড়তে হয়। সংবিধানে ইসিকে স্বাধীন প্রতিষ্ঠান বলা হয়েছে। তবে কিছু কারণে সেই স্বাধীনতায় অস্পষ্টতা থেকে যাচ্ছে। আর সেই কারণেই ইসি আস্থার প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড়াচ্ছে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সংবিধানের ১১৮(৪) অনুচ্ছেদে নির্বাচন কমিশনের 'স্বাধীন' প্রতিষ্ঠান হিসেবে দায়িত্ব পালনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। একই অনুচ্ছেদের (৫) দফায় 'আইনের বিধানাবলী ও রাষ্ট্রপতির আদেশ' অনুযায়ী নির্ধারিত দায়িত্ব পালন করতে বলা হয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, সংবিধানে ইসির স্বাধীনতার কথা উল্লেখ করা হলেও সেটির প্রয়োগ হবে সরকারের তৈরি আইনি কাঠামোতে। সব সরকারই ইসির স্বাধীনতার কথা মুখে স্বীকার করলেও বাস্তবে তা চায় না। তাই মোটা দাগে তিনটি কারণে নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা দৃশ্যমান নয়। এর মধ্যে আইনি অস্পষ্টতা, প্রশাসনিক স্বাধীনতা ও কমিশনের আগ্রহের অভাবকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনারদের শপথ নিতে হয়। রাষ্ট্রীয় এই প্রতিষ্ঠানটির শীর্ষ কর্তাদের জন্য নির্ধারিত শপথ বাক্যে নিজেদের কাজকে 'সরকারি' কাজ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
পর্যবেক্ষকদের অভিমত, ভুলবশত হোক আর ইচ্ছাকৃতভাবেই হোক, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে যারা শপথ নেন, তারা সরকারি কাজ করেন না। সংবিধানের তৃতীয় তফশিলে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়োগপ্রাপ্তদের শপথ বাক্য আলাদাভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার বা নির্বাচন কমিশনারদের শপথ বাক্যে বলা হয়েছে, '...আমি সংবিধানের রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তাবিধান করিব; এবং আমার সরকারী কার্য ও সরকারী সিদ্ধান্তকে ব্যক্তিগত স্বার্থের দ্বারা প্রভাবিত হতে দিব না।'
তবে এ বিষয়টিতে ভিন্নমত পোষণ করেছেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার। প্রয়াত এ নির্বাচন কমিশনারের 'নির্বাচননামা, নির্বাচন কমিশনে আমার দিনগুলো' শীর্ষক বইয়ে (প্রথম প্রকাশন, ২০২৩) এ বিষয়ে লিখেছেন, '... আমরা কী "সরকারি" কাজ করি? "সরকারি" সিদ্ধান্ত কি আমাদের সিদ্ধান্ত? সরকারি শব্দটি উল্লেখ করে নির্বাচন কমিশনকে সরকারের অধীন করা হয়েছে বলে আমি মনে করি। এখানে সরকার না বলে "রাষ্ট্র" বললে যথার্থ হতো।'
প্রশাসনিক স্বাধীনতার অভাব
নির্বাচন কমিশনের কাজই হচ্ছে নির্বাচন অনুষ্ঠান। কিন্তু স্বাধীনতার অর্ধশত বছরের বেশি সময় পার হলেও এখনো পর্যন্ত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জেলা পর্যায়ে নিজেদের রিটার্নিং কর্মকর্তার মাধ্যমে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি ইসি। যদিও জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে ইসির নিজস্ব কার্যালয় ও কর্মকর্তা আছে। উপনির্বাচন বা সিটি করপোরেশনের মতো নির্বাচনগুলোতে অনেক সময় ইসি কর্মকর্তারা রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু সংসদ নির্বাচনে তারা সেই ভূমিকায় থাকতে পারেন না।
ইসি সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ইসির জেলা পর্যায়ের বেশিরভাগ কর্মকর্তারই রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করার যোগ্যতা আছে। কিন্তু জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় এ দায়িত্ব ডিসিদের কাছে রাখতেই সরকার নির্ভরতা পায়। আর এই জায়গায় কমিশন শক্ত অবস্থান নিয়ে কোনো পরিবর্তন আনতে পারেনি।
অন্যদিকে একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হওয়া স্বত্বেও এখনো প্রশাসনিক পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ সচিব পদটিতে নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব কর্মকর্তারা ধারাবাহিকভাবে নেতৃত্ব দিতে পারছেন না। সচিব পদে এখনো প্রেষণে নিয়োগ হচ্ছে সরকারের কর্মকর্তারা।
২০০৯ সালে প্রণীত 'নির্বাচন কমিশন আইন' এর ৩(২) অনুযায়ী, 'নির্বাচন কমিশন সচিবালয় সরকারের কোনো মন্ত্রণালয়, বিভাগ বা দপ্তরের প্রশাসনিক আওতাধীন থাকিবে না।' কিন্তু কমিশন সচিবালয়ের সচিব হিসেবে বরাবরই নিয়োগ পাচ্ছেন সরকারের সচিব মর্যাদার একজনর অফিসার। কারণ 'নির্বাচন কমিশন নিয়োগ বিধিমালা-২০২৩' এ 'সচিব' পদটিতে কমিশনের কর্মকর্তাদের পদোন্নতির সুযোগ রাখা হয়নি। এখানে প্রেষণে 'সরকারের সচিব বা সচিব মর্যাদার কর্মকর্তাগণের মধ্য হইতে' নিয়োগের বিধান রাখা হয়েছে।
প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা এ পদে নিয়োগ পান। শুধু সচিব পদই নয়, কমিশন সচিবালয়ের আইন সংক্রান্ত কর্মকর্তার পদগুলোতে প্রেষণে নিম্ন আদালতের কর্মকর্তাদের নিয়োগের সুযোগ রাখা হয়েছে। যেমন: যুগ্মসচিব (আইন), উপসচিব (আইন), সহকারী সচিব (আইন)। এসব কর্মকর্তার বদলি, পদোন্নতি, ছুটি ও শৃঙ্খলা সংক্রান্ত বিষয় কার্যত সরকারের নিয়ন্ত্রণে।
আইন-বিধির দুর্বলতা
নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগ পর্যন্ত ইসি সচিবালয় সরকারের অধীনস্ত একটি প্রতিষ্ঠান ছিল। ২০০৯ সালে আইন সংশোধন করে ইসির অধীন করা হয়েছে। এভাবে আইন সংশোধনের মাধ্যমে ইসির স্বতন্ত্র সত্তা প্রতিষ্ঠার জন্য কিছু উদ্যোগ নেওয়ার চেষ্টা থাকলেও আইনের অধীনে প্রণীত বিধিতে সেই ধারাবাহিকতা রক্ষা করা হয়নি।
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নির্বাচন কমিশনের মধ্যম পর্যায়ের এক কর্মকর্তা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'রাজনৈতিক দলগুলো বিরোধী দলে যাওয়ার পর নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতার কথা বলেন। কিন্তু ক্ষমতায় থাকতে কোনো দলই সেই স্বাধীনতা দিতে রাজি হয় না।'
উদাহরণ দিয়ে এ কর্মকর্তা বলেন, 'কমিশন সচিবালয়ের প্রশাসনিক প্রধান হচ্ছেন সচিব। অর্থাৎ কমিশন সচিবালয়ের প্রধান ব্যক্তিই যদি সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন হন, তাহলে "স্বাধীন" সচিবালয় কীভাবে সম্ভব?'
নির্বাচন কমিশনের মাঠ পর্যায়ের এক কর্মকর্তা বলেন, 'নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা পূর্ণাঙ্গরূপে নিশ্চিত করতে হলে আইন-বিধির সংস্কার প্রয়োজন হয়। সরকার এই জায়গাতে তার নিয়ন্ত্রণাধীন কর্মকর্তাদের নিয়োগ নিশ্চিত করে রেখেছে।'
তবে এ বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করে সাবেক সচিব আবু আলম মো. শহিদ খান ডেইলি স্টারকে বলেন, নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব কর্মকর্তাদের মধ্য থেকেও সচিব পদে নিয়োগ পেয়েছিলেন। কিন্তু তাদের দায়িত্ব পালনের সময় বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। অন্যদিকে আইন সংক্রান্ত বিষয়গুলোতে জুডিশিয়ারির কর্মকর্তাদের নিয়োগও যুক্তিযুক্ত। তবে কমিশন যদি আইন ব্যাকগ্রাউন্ডের কর্মকর্তাদের আলাদাভাবে নিয়োগ দেয়, তাহলে ভবিষ্যতে হয়তো প্রয়োজন হবে না।
কমিশনের অনাগ্রহী মনোভাব
নির্বাচন কমিশনের বিষয়ে সংবিধানে পর্যাপ্ত স্বাধীনতার কথা বলা থাকলেও আইন ও বিধিতে গিয়ে অনেক কিছুই দুর্বল হওয়ার অভিযোগ আছে। আইনে ভোটারদের 'না ভোট' দেওয়ার ক্ষমতা ছিল, সেটা বাতিল করা হয়েছে। যেকোনো নির্বাচন চলাকালে পুরো আসনের বা পুরো নির্বাচন বাতিলের ক্ষমতা আইন থেকে বাদ দেওয়ার মতো বিষয়গুলো সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। অন্যদিকে ইসি ও সিইসি পদে সাবেক আমলাদের প্রাধান্যও নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা খর্ব হওয়ার অন্যতম কারণ বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার ডেইলি স্টারকে বলেন, নির্বাচন বাতিলে ইসির ক্ষমতা কমিয়ে গত ৪ জুলাই জাতীয় সংসদে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে (আরপিও) এ সংক্রান্ত সংশোধনী পাস হয়। এতে ভোটগ্রহণের দিনের আগে ইসি চাইলেও নির্বাচন বন্ধ করতে পারবে না। এ ছাড়া রিটার্নিং কর্মকর্তা ফলাফল ঘোষণা করার পর কোনো অনিয়মের অভিযোগ উঠলেও পুরো আসনের (সংসদীয়) ফলাফল স্থগিত বা ভোট বাতিল করতে পারবে না ইসি। শুধু যেসব ভোটকেন্দ্রে অনিয়মের অভিযোগ থাকবে, সেসব ভোটকেন্দ্রের ফলাফল চাইলে স্থগিত করতে পারবে ইসি। এর মাধ্যমে কার্যত ইসির ক্ষমতা খর্ব হয়েছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, আইনে এ সংক্রান্ত সংশোধনের প্রস্তাব নির্বাচন কমিশন থেকেই গিয়েছিল।
তবে কমিশনের কেউ কেউ পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতার মনোভাব দেখালেও সেটা বাস্তবায়ন সম্ভব হয় না, এমন উদাহরণও আছে। ২০১১ সালে ড. এটিএম শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে সেনা মোতায়েনে সহযোগিতা পায়নি কমিশন। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ড. এটিএম শামসুল হুদার এবং নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছিলেন।
এই ঘটনা 'নির্বাচন কমিশনে পাঁচ বছর' শীর্ষক বইয়ে (পৃষ্ঠা: ৫৫২ ও ৫৫৩) লিখেছেন ওই সময়কার নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন। এ ঘটনা প্রমাণ করে যে, নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতার কথা বলা হলেও, কার্যত স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে না সাংবিধানিক এ প্রতিষ্ঠানটি।
সংবিধান গবেষক ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আরিফ খান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়োগপ্রাপ্তরা অনেক সময় শপথের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকতে পারেন না। কেন পারেন না, তার বহুমুখী কারণ আছে। এর মধ্যে অন্যতম হতে পারে সরকারের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের নিয়োগ।'
'যে কর্মকর্তা তার সারাজীবন সরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে আদেশ-নির্দেশ মেনে চলে অভ্যস্ত, তিনি কীভাবে ৬০ বছর বয়সের পর সরকারের মতো শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করবেন? তবে সরকারি চাকরিজীবীদের মধ্যে ব্যতিক্রম ব্যক্তিরাও আছেন। তাদেরকে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে খুব বেশি নিয়োগ দিতে দেখা যায় না', যোগ করেন তিনি।
Comments