মার্কিন ভিসা নীতি: প্রশাসন-পুলিশ কর্মকর্তাদের একাংশে অস্বস্তি

মার্কিন ভিসা নীতি
প্রতীকী ছবি

মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞা নিয়ে অস্বস্তিতে ভুগছে প্রশাসন ও পুলিশ কর্মকর্তাদের একটি অংশ, যদিও তারা কেউই প্রকাশ্যে এটি স্বীকার করতে চাইছেন না।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা যাদের সন্তান বিদেশে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় পড়াশোনা করছে এবং মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা যারা পরবর্তী নির্বাচন পরিচালনার সঙ্গে সরাসরি জড়িত, মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞার ঘোষণার পর তারা অস্বস্তিতে ভুগছেন।

এ বিষয়ে প্রায় এক ডজন আমলা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যের সঙ্গে কথা বলেছে দ্য ডেইলি স্টার। তারা জানান, মার্কিন ভিসা নীতি সম্পর্কে তারা যত বেশি সম্ভব তথ্য পেতে চেষ্টা করছেন।

কয়েকজন কর্মকর্তা মনে করেন, ভিসা বিধিনিষেধ কিছু সিনিয়র কর্মকর্তাদের জন্য প্রযোজ্য হতে পারে। প্রায় ৬ হাজার আমলা এবং ২ লাখ ১২ হাজার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এ নিয়ে চিন্তার কারণ নেই।

বেশ কয়েকজন আমলা বলছেন, শুধু জনপ্রশাসন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা নির্বাচন প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত। তাই অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের ওপর মার্কিন ভিসা নীতির প্রয়োগ হওয়ার কথা না।

পুলিশ ও আমলাতন্ত্রের কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেছেন, তারা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের প্রতি অনুগত। মার্কিন ভিসা নীতি তাদের মনোবলকে প্রভাবিত করবে না।

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় সরাসরি সম্পৃক্ত কর্মকর্তা যাদের পরিবারের সদস্যরা বিদেশে আছে তাদেরকে দায়িত্ব না দিতে চেষ্টা করবে সরকার। আগের নির্বাচনে যেসব কর্মকর্তার তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল না তাদের আগামী নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেওয়া হতে পারে।

তারা বলেন, ২৪, ২৫ এবং ২৭ তম বিসিএস ব্যাচের মাঠ পর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তাদের পুলিশ সুপার নিযুক্ত করা হয়েছে। একেকটি জেলার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এসপির এখতিয়ারের অধীনে হওয়ায় এসব ব্যাচের কর্মকর্তারাই সরাসরি নির্বাচন প্রক্রিয়ায় জড়িত থাকবেন।

আগের ২ জাতীয় নির্বাচনের সময়, এই কর্মকর্তারা নিম্ন স্তরের পদে ছিলেন, তাদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা ছিল না। তাই তাদের মার্কিন ভিসা বিধিনিষেধের আওতায় আসার সম্ভাবনা কম বলে পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা ধারণা করছেন।

পরিচয় গোপন রাখার শর্তে এসপি র‍্যাংকের এক পুলিশ কর্মকর্তা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা ভিসা বিধিনিষেধ ঘোষণার পর একেবারেই উদ্বিগ্ন নই এমনটা বলছি না। তবে আমরা পুরোপুরি দমে গেছি তাও সত্য না।'

এসপি-র‍্যাংকের অন্য ২ কর্মকর্তা জানান, নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে বলে তারা মনে করেন। তবে সরকার পরিবর্তন হলে তাদের পরিবার ও কর্মজীবনে সেটির প্রভাব পড়বে।

মধ্যস্তরের ৩ জন বেসামরিক কর্মচারী বলেছেন, ভিসা নীতি নিয়ে আমলাদের মধ্যে অস্বস্তি রয়েছে। কিন্তু শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের প্রতি তাদের আনুগত্য অটুট। এর কোনো বিকল্প নেই বলেও জানান তারা।

৮৬ জন সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তার মধ্যে ২৯ জনের সন্তান বিদেশে পড়াশোনা করছে বলে সরকারের কাছে তথ্য রয়েছে। এছাড়া সরকার মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সন্তানদেরও তথ্য জানার চেষ্টা করছে।

দ্য ডেইলি স্টার যেসব কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেছে তাদের মধ্যে কয়েকজন বলেছেন, জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার মতো মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের অধিকাংশের সন্তানদের উচ্চ শিক্ষার জন্য বিদেশে যাওয়ার মতো বয়স হয়নি।

বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে জাতীয় নির্বাচন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে গত ২৪ মে বাংলাদেশের জন্য নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা করে যুক্তরাষ্ট্র। তাতে বলা হয়, বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িত ব্যক্তি ও তাদের পরিবারের সদস্যদের ভিসা দেবে না দেশটি। গত ২২ সেপ্টেম্বর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ শুরুর ঘোষণা দেওয়া হয়।

মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের ঘোষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল, বিরোধী দল, সাবেক ও বর্তমান সরকারি কর্মকর্তা, জুডিশিয়ারি ও সিকিউরিটি সার্ভিসের সদস্যরা ভিসা নিষেধাজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত হবে।

তবে যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে কর্মকর্তাদের কার্যকলাপ যাচাই করবে এ নিয়ে বিভ্রান্তির কথা জানিয়েছেন কয়েকজন আমলা।

তারা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র গত ২টি জাতীয় নির্বাচনকে বিবেচনায় নিলে বিপুল সংখ্যক আমলা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী ডিসিরা এখন সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তা। তাদের অনেকেই অবসরে চলে গেছেন। অন্যদিকে, ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে রিটার্নিং অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী ডিসিরা এখন যুগ্ম সচিব পর্যায়ের পদে রয়েছেন, যদিও তাদের মধ্যে কেউ কেউ অতিরিক্ত সচিব হয়েছেন।

মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু একটি টিভি চ্যানেলকে দেওয়া সাক্ষাত্কারে বলেছেন, অতীতে গণতান্ত্রিক নির্বাচনকে ক্ষুণ্ন করার জন্য কাজ করেছে বলে অভিযোগ থাকা ব্যক্তিদের ওপর মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞা প্রভাব ফেলবে না।

তিনি বলেন, 'এই নীতি আগামী দিনের জন্য, যার অর্থ আমরা আশা করছি যে এই নীতি সহিংসতা প্রতিরোধে এবং বাংলাদেশে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে সহায়তা করবে।'

কিন্তু ডোনাল্ড লুর এই বক্তব্য বাংলাদেশি কর্মকর্তাদের খুব একটা স্বস্তি দেয়নি, কারণ সর্বশেষ স্টেট ডিপার্টমেন্টের ঘোষণায়ও বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তাদের ওপর ভিসা নীতি আরোপের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

ইউরোপীয় ইউনিয়নও একই ধরনের ব্যবস্থা নেয় কি না এ নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছেন কয়েকজন আমলা।

আমলাদের প্রশিক্ষণ প্রোগ্রামের প্রায় অর্ধেক পরিচালিত হয় ইউরোপীয় দেশগুলোতে। যদি ইইউ যুক্তরাষ্ট্রের মতো ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় তবে তাদের প্রশিক্ষণ অনিশ্চিত হয়ে উঠতে পারে।

পুলিশের এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা জানেন যে বর্তমান সরকার আবার ক্ষমতায় আসতে ব্যর্থ হলে তারা সমস্যায় পড়বেন। এই কর্মকর্তারা সরকারের কাছ থেকে সুবিধা নিয়েছেন। মার্কিন নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। এই কর্মকর্তাদের নিজস্ব "এক্সিট প্ল্যান" আছে এবং তারা তাদের দায়িত্ব পালন করবেন।'

নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে আরেক পুলিশ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বলেন, 'কিছু কর্মকর্তা কাজ করছেন এবং পাবলিকের নজর এড়িয়ে চলছেন। তারা স্পটলাইটে আসতে চান না এবং পরিস্থিতি বুঝে তারা তাদের সিদ্ধান্ত নেবেন।'

ভিসা নিষেধাজ্ঞার ঘোষণার পরপরই ডিএমপির মুখপাত্র ফারুক হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, 'যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতিতে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর ওপর কোনো প্রভাব পড়বে না।'

'মার্কিন ভিসা নীতি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু সদস্যের ব্যাপারে অ্যাপ্লাই করা হয়েছে। যদি ভিসা নীতি আসে, তারা হয়তো যুক্তরাষ্ট্র যেতে পারবেন না। পুলিশ আইনের আওতার মধ্যে কাজ করে এবং ভিসা নীতি বাহিনীটির কর্মক্ষমতায় কোনো বাধা সৃষ্টি করবে না,' বলেন তিনি।

এ বিষয়ে বুধবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, আমেরিকার ভিসা নীতি নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনো কারণ নেই।

তিনি বলেন, 'তারা কাকে ভিসা দেবে, নাকি দেবে না, সেটা তাদের নিজস্ব এখতিয়ার। আমরা সংবিধান অনুযায়ী দেশ চালাব। সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন হবে।'

আমলাতন্ত্রে ভিসা নীতির প্রভাব সম্পর্কে জানতে চাইলে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এখনো এ ব্যাপারে চূড়ান্তভাবে কিছু বলার সময় আসেনি কারণ অনেক কিছুই এখনো পরিষ্কার নয়। নির্বাচন কীভাবে হবে, নির্বাচনের বিষয়ে বিএনপির সিদ্ধান্ত কী হবে—এসবের ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে।

'মধ্য ও জুনিয়র স্তরের পাশাপাশি মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা নির্বাচন পরিচালনা করেন। শিক্ষক এবং ব্যাংকররাও ভোটদান প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত। প্রধান শিক্ষক ও অধ্যক্ষরা প্রিজাইডিং অফিসার হিসেবে কাজ করেন। শিক্ষকরা পোলিং অফিসার হিসেবে কাজ করেন। সাধারণত, তারা অত ধনী হয় না, তারা আমেরিকা যায় না। তাই এটি নিয়ে তাদের মাথাব্যথা নাও হতে পারে,' বলেন তিনি।

তবে, কিছু ক্ষেত্রে, ডিসি ও এসপিরা মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞার কারণে প্রভাবিত হতে পারেন বলে তিনি মনে করেন।

Comments

The Daily Star  | English

Admin officers protest plan for more non-admin deputy secretaries

Non-admin officers announce strike tomorrow, demanding exam-based promotions

1h ago