একটি গাভী থেকে সফল খামারি রফিকুল-শিউলী দম্পতি

একটি গাভী থেকে সফল খামারি রফিকুল-শিউলী দম্পতি
বর্তমানে এই দম্পতির খামারে আছে ১৩টি গাভী ও ৫টি বাছুর। ছবি: সুজিত কুমার দাস/স্টার

অভাবের সংসারে দেড় বছরের ব্যবধানে জন্ম নেয় ২ সন্তান। তাদের দুধের চাহিদা মেটাতে ঋণ নিয়ে একটি গাভী কেনেন রফিকুল-শিউলি দম্পতি।

এখন তারা সফল খামারি। বর্তমানে এই দম্পতির খামারে আছে ১৩টি গাভী ও ৫টি বাছুর। প্রতিদিন দুধ বিক্রি করে আয় করেন ৪ হাজার টাকা।

রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি উপজেলার ইকরচর গ্রামের রফিকুল ইসলাম (৪০) ও শিউলি আক্তার (৩৮) দম্পতির এমন সাফল্য দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে অন্তত ২০ জন নতুন খামার গড়ে তুলেছেন।

অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জন করায় ২০১৬ সালে ঢাকা বিভাগীয় পর্যায়ে সেরা জয়িতার সম্মাননা পেয়েছেন শিউলী আক্তার।

এই দম্পতির বড় ছেলে তরিকুল বালিয়াকান্দি সরকারি কলেজের একাদশ শ্রেণি ও ছোট ছেলে তৌহিদুল বালিয়াকান্দি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী।

বালিয়াকান্দি-জামালপুর সড়কের শ্রীরামপুর বাজার থেকে একটি হেরিংবন্ড সড়ক হাতের দক্ষিণ দিকে চলে গেছে। রাস্তা দিয়ে কিছুদূর যাওয়ার পর রফিকুল ইসলামের বাড়ি।

বাড়ির প্রবেশপথের ডান দিকে বসবাসের একটি ঘর। এই ঘরের পাশে প্রায় ১০ শতাংশ জায়গার ওপর একটি গোয়াল ঘর। ইটের গাঁথুনির প্রাচীর। বাতাস আসার জন্য লোহার তারের জালি। উপরে টিন, মেঝে পাকা।

গোয়ালঘরে ফ্যান আছে, একপাশে রাখা আছে জেনোরেটর। 'এল' আকৃতির ঘরের একদিকে বাছুর রাখার স্থান।

১৯৯৮ সালে বিয়ে হয় রফিকুল ও শিউলীর। ৪ ভাইয়ের মধ্যে রফিকুল দ্বিতীয়। রফিকুল বাড়ির কৃষিকাজ দেখাশোনা করতেন।

তবে বড় ভাইয়ের আগে বিয়ে করায় পারিবারিকভাবে মনোমালিন্য হয় এবং প্রথম সন্তান জন্মের পর সংসার থেকে আলাদা করে দেওয়া হয় রফিকুলকে।

রফিকুল ইসলাম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমি যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর থেকে গাভী পালনের ওপর প্রশিক্ষণ নিয়েছিলাম। সেখান থেকে গাভী কেনার জন্য ১২ হাজার টাকা ঋণ নেই এবং নিজেদের জমানো টাকা দিয়ে মোট ১৮ হাজার টাকায় পাশের গ্রাম থেকে বাছুরসহ একটি গাভী কিনি।'

'গাভীটা ছিল কিছুটা রোগা। স্বামী-স্ত্রী দুজন মিলে গাভীর যত্ন করি। গাভীর স্বাস্থ্য ভালো হয়, কিছুদিন পর বাচ্চা জন্ম দেয়। এবার দুধের পরিমাণ আগের চেয়ে বেড়ে যায়। দিনে দিনে দুধের পরিমাণ বাড়তে থাকে। গরুর সংখ্যাও বাড়তে থাকে,' বলেন তিনি।

রফিকুল জানান, প্রথমে তাদের গোয়ালঘর তৈরির টাকা ছিল না। পলিথিন দিয়ে গোয়ালঘর ঘিরে রাখেন। কিন্তু যত্নের কোনো কমতি ছিল না। এরপর সেই গাভী ও গাভীর বাচ্চা থেকেও নতুন বাছুর জন্ম নেওয়া শুরু করে। দুধ বাজারে বিক্রি করে টাকা জমতে থাকে। এরপর পলিথিনের ঘরে টিন দিয়ে দোচালা ঘর দেন। মেঝে পাকা করে দেন।

এখনকার গোয়ালঘরের পেছনে প্রায় ৫ লাখ টাকা খরচ হয়েছে বলে জানান।

রফিকুল বলেন, 'খামারের পাশাপাশি চাষাবাদও করি। সাধারণত ২০টি গরু রাখি। বেশি হলে বিক্রি করে দেই। সকালে স্বামী-স্ত্রী দুজনই খামারে সময় দেই। ঘাস কাটার জন্য একজন স্থায়ী শ্রমিক আছে। আর বিশেষ সময়ে একাধিক শ্রমিক নিয়োগ দিই।'

এখন তারা প্রতিদিন ৫৮ টাকা দরে গড়ে ২০০ লিটার দুধ বিক্রি করেন।

এই দম্পতির সঙ্গে কথা বলে আরও জানা যায়, তারা রাজবাড়ীর বিভিন্ন এলাকা ছাড়াও কুষ্টিয়া, মাগুরা, যশোরের বিভিন্ন খামার বা কৃষকের বাড়ি থেকে গাভী কিনেছেন। বাড়িতে এনে কিছুদিন লালন-পালনের পর বিক্রি করে দেন।

এ বছর তারা ৬টি গাভী বিক্রি করেছেন। মোট সাড়ে ১৩ লাখ টাকায়। এই টাকার অর্ধেক দিয়ে জমি কিনেছেন।

তাদের এখন প্রায় ২ দশমিক ২ একর জমি। বাড়িতে ঘর দিয়েছেন। গোয়ালের সব গরুর দাম হবে অন্তত ৪৫-৫০ লাখ টাকা। ।

শিউলী আক্তার ডেইলি স্টারকে বলেন, 'নিজের সন্তানদের মতো করেই গরু পালি। কেউ গরু কিনতে এলে তাদের বিষয়ে খোঁজখবর নেই।'

এই দম্পতির সাফল্য দেখে খামার করেছেন একই গ্রামের গৃহবধূ সেলিনা খাতুন। তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমার ৫টি গাভী এবং ৩টি বাছুর। মাঠে ঘাস চাষ করেছি। দুধ বিক্রি করে সংসার চলে যায়। স্বামী বিদেশ থাকলেও, তার পাঠানো টাকার জন্য অপেক্ষা করতে হয় না।'

গ্রামের আরেক বাসিন্দা আব্দুল খালেক জানান, প্রায় ৫ বছর আগে রফিকুল-শিউলী দম্পতির খামারে কাজ করার সময় তাদের থেকে খামার করার পরামর্শ নেন। এখন তার ৮টি গাভী আছে। এগুলো থেকে প্রতিদিন প্রায় ৭০ লিটার দুধ পাওয়া যায়।

বালিয়াকান্দি উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মানবেন্দ্র মজুমদার ডেইলি স্টারকে বলেন, 'রফিকুল-শিউলী দম্পতি বর্তমান অবস্থানে আসতে অনেক কষ্ট করেছেন। এখন তারা আমাদের উপজেলায় দুগ্ধ খামারের রোল মডেল।'

Comments

The Daily Star  | English
Banking sector crisis

Why is the banking sector crisis so deep-rooted?

The regime-sponsored immorality to protect or pamper the financial gangsters not only eroded the future of the banking sector, but also made the wound too difficult to recover from.

5h ago