পরিসংখ্যানে বেকারত্ব কমলেও সংজ্ঞা নিয়ে প্রশ্ন

সিরাজগঞ্জ সরকারি কলেজ থেকে গত বছর অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন মাসুদুর রহমান।

তিনি তার ৬ সদস্যের পরিবারের খরচ চালাতে এখনো চাকরি খুঁজছেন। টিউশনি করে যা পান তাই দিয়ে চলার চেষ্টা করছেন তিনি।

মাসুদুর রহমান নিজেকে বেকার মনে করেন। কিন্তু, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) শ্রমশক্তি জরিপ ২০২২-এর সংজ্ঞা অনুযায়ী, তিনি বেকার নন বরং কর্মজীবী।

সংজ্ঞা অনুসারে, কেউ যদি সপ্তাহে এক ঘণ্টা কাজ করেন তিনি আর বেকার নন। সপ্তাহে এক ঘণ্টাও কাজের সুযোগ না পেলে সরকারি পরিসংখ্যানে তাদের বেকার হিসেবে ধরা হয়।

কর্মসংস্থানের মধ্যে রয়েছে খণ্ডকালীন, অনানুষ্ঠানিক, অস্থায়ী, মৌসুমি বা দেশের ভেতরে বা বিদেশে নৈমিত্তিক চাকরি।

শ্রমশক্তি জরিপ ২০২২ এর প্রকল্প পরিচালক আজিজা রহমান বলেন, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সংজ্ঞা অনুসারে বিবিএস জরিপটি করেছে।

বিবিএস গত সপ্তাহে জরিপের ফল প্রকাশ করেছে। জরিপে বলা হয়েছে, দেশে এখন মোট শ্রমশক্তির ৩ দশমিক ৬ শতাংশ মানুষ বেকার, যাদের সংখ্যা ২৬ লাখ ৩০ হাজার। বাংলাদেশে বেকারত্বের হার দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বনিম্ন।

বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বোচ্চ বেকারত্বের হার নেপালে ১২ দশমিক ২ শতাংশ। আফগানিস্তানে এটি ১১ দশমিক ৭ শতাংশ, ভারতে ৭ দশমিক ৭ শতাংশ এবং পাকিস্তানে ৬ দশমিক ৩ শতাংশ।

এর আগে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে দেশে শ্রমশক্তি জরিপ করেছিল বিবিএস। তখন দেশে বেকারত্বের হার ৪ দশমিক ২ শতাংশ ছিল বলে জানানো হয়েছিল। সংখ্যার হিসাবে বেকার ছিল ২৭ লাখ মানুষ। হিসাব অনুযায়ী ৫ বছরে দেশে বেকারের সংখ্যা কমেছে ৭০ হাজার।

বাংলাদেশের পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, 'বেকারত্বের এই সংজ্ঞা দেশের বাস্তবতাকে প্রতিফলিত করে না।'

তিনি বলেন, 'গ্রামীণ দরিদ্ররা বেকার থাকতে পারে না। জমিতে কাজ, রিকশা চালানো বা ফেরিওয়ালা হিসাবে হলেও তাদের কিছু করতে হয়। এগুলো মানসম্মত কাজ নয়। তারা কেবল চলার জন্য এগুলো করছে।'

এই অর্থনীতিবিদ বিবিএসের সংজ্ঞা অনুসারে বেকারত্ব হ্রাসকে অর্থহীন অভিহিত করেন।

বেকারের সংজ্ঞার পড়েন না এমন অনেকেই পছন্দমতো চাকরি না পেয়ে জীবনধারণের জন্য নানা ধরনের কাজ করেন। তাদের একটি বড় অংশ টিউশনি, বিক্রয়কর্মী বা মোটরসাইকেলে রাইড শেয়ারের মতো কাজ করেন। কিন্তু এসব কাজ নিয়ে তারা সন্তুষ্ট নন। তাদের ছদ্মবেকার হিসেবে ধরা হয়।

এ ব্যাপারে তিনি বলেন, আমাদের দেশে কর্মজীবীদের বড় একটি অংশই ছদ্মবেকার। তারা বেকারের মধ্যে না পড়লেও বাঁচার জন্য কাজ করছেন। তারা গুরুতরভাবেই ছদ্মবেকার।

তিনি দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বের করার ওপর জোর দিয়ে বলেন, বেকারদের শিক্ষাগত যোগ্যতা অনুযায়ী শ্রেণিবদ্ধ করতে হবে। এটা হলে আমরা দেখতে পাব দেশে বেকারত্বের হার ২৪-২৫ শতাংশ।

আইএলওর সংজ্ঞা সম্পর্কে আহসান এইচ মনসুর বলেন, 'এটি বিশ্বব্যাপী চলছে। কিন্তু শিল্পোন্নত বা উন্নত দেশগুলোর জন্য প্রযোজ্য হওয়ায় এটি আমাদের জন্য উপযোগী নয়।'

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ২০২২ সাল জুড়ে এই জরিপ চালিয়েছে। করোনাভাইরাস মহামারি থেকে তখনও দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। এর মধ্যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিভিন্ন পণ্যের দাম বাড়তে শুরু করে। এই দুই ঘটনাতেই দেশের ব্যবসাবাণিজ্য, অর্থনীতি ও কর্মসংস্থানের ওপর চাপ তৈরি হয়। এর মধ্যেই জরিপ চালিয়ে মধ্যেই দেশের বেকার সংখ্যা কমার তথ্য দিয়েছে বিবিএস।

এর মধ্যে মহামারির কারণে সৃষ্ট ক্ষতি প্রশমিত হয়ে এলেও শিগগির রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ হওয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সায়েমা হক বিদিশাও বলেন, দেশে বেকারত্বের প্রকৃত চিত্র সরকারের জরিপে উঠে আসছে না।

তার মতে, অন্যান্য দেশের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে আমরা আইএলওর সংজ্ঞা অনুসারে বেকারত্বের হিসাব করতেই পারি। তবে সরকারি নীতি নির্ধারণে শুধুমাত্র আইএলওর সংজ্ঞার ওপর নির্ভর না করা ঠিক হবে না। আমাদের নিজেদের পরিস্থিতি বিবেচনায় নেওয়া উচিত।

তার পরামর্শ, বেকারত্বের হিসাবের মধ্যে ছদ্মবেকারদেরকেও অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। এতে বেকারত্বের প্রকৃত চিত্র উঠে আসবে।

সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং-এর নির্বাহী পরিচালক প্রফেসর সেলিম রায়হান বলেন, আইএলওর সংজ্ঞা নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে এবং শিগগির এই বিতর্কের অবসান হবে না।

বিবিএসের মহাপরিচালক মো. মতিউর রহমান বলেন, এই সংজ্ঞা দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহার হচ্ছে। হঠাৎ করে এটা পরিবর্তন করা যাবে না। আমাদের উপাত্ত বিশ্বব্যাপী ব্যবহার করা হচ্ছে।

চূড়ান্ত প্রতিবেদনে ছদ্মবেকারদের সংখ্যাও তুলে ধরা হবে বলে জানান তিনি।

Comments

The Daily Star  | English

No justifiable reason to delay nat'l polls beyond Dec: Salahuddin

We have been able to make it clear that there is not even a single mentionable reason to hold the election after December, says the BNP leader

8h ago