ভার্চ্যুয়ালি যেমন দেখা গেল ১২০০ বছরের পুরনো সোমপুর মহাবিহার

ভার্চ্যুয়ালি সোমপুর বিহার। ছবি: সংগৃহীত

এ যেন মাটির তলায় চাপা পড়া কোনো সভ্যতার পুনরুত্থান; অতীতের বদ্ধ, অনড় ও স্তূপ হয়ে পড়ে থাকা অনুষঙ্গগুলোতে জীবন্ত প্রাণের স্রোত বয়ে যাওয়া।

নওগাঁর বদলগাছিতে প্রায় ১ হাজার ২০০ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন বিদ্যাপীঠ সোমপুর মহাবিহার। জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকো কর্তৃক 'ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট' হিসেবে ঘোষিত বাংলাদেশের সুপ্রাচীন এই প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনাটি সময়ের বিবর্তনে প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। এখন এর ভিত্তিভূমিটুকু টিকে আছে কেবল।

এটাকেই ভিত্তি করে ডিজিটাল রিস্টোরেশনের মাধ্যমে তৈরি সোমপুর মহাবিহার যেন আবার প্রাণ ফিরে পেল হাজার বছরেরও বেশি সময় পর। দৃশ্যমান হলো মহাবিহারের প্রধান মন্দিরের চারপাশের ভবন ও তার ভেতরের দৃশ্য, চারপাশের ৪ প্রবেশ ফটক, দেয়ালের টেরাকোটা।

গতকাল মঙ্গলবার 'ভার্চ্যুয়াল মিউজিয়াম বাংলাদেশ' আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করেছে সোমপুর মহাবিহারের বেটা ভার্সন। আগ্রহী দর্শকরা এখন ঘরে বসেই অনলাইনে কম্পিউটার, স্মার্টফোন ও ভিআর ব্যবহার করে সোমপুর মহাবিহারের ত্রিমাত্রিক আকৃতি দেখতে পারবেন।

এ বিষয়টি সম্ভব করেছেন ভার্চ্যুয়াল মিউজিয়ামের প্রতিষ্ঠাতা আহমেদ জামান সঞ্জীব এবং সহপ্রতিষ্ঠাতা ইয়াসমিন রত্না, আশেক-এ ইলাহী অনি, ওমর শরীফ ও ধীমান সাহা।

ভার্চ্যুয়াল মিউজিয়াম হচ্ছে ভার্চ্যুয়াল রিয়েলিটি (ভিআর) ব্যবহার করে তৈরি করা এমন এক প্ল্যাটফর্ম, যেখানে থ্রিডি কিংবা সিক্সডি ফ্রিডম ব্যবহার করে দেশের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো আগেরকার রূপে দেখা যাবে। ডিজিটাল মিউজিয়ামের এই অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য ভিআর হেডসেট পড়তে হবে। সিমুলেশনের মাধ্যমে পাওয়া যাবে সশরীরে জাদুঘর ঘুরে দেখার বাস্তব অভিজ্ঞতা।

ইতিহাস বলছে, সোমপুর মহাবিহার আনুমানিক ৩০০ বছর ধরে বৌদ্ধদের অন্যতম প্রসিদ্ধ ধর্ম শিক্ষাদান কেন্দ্র হিসেবে স্বীকৃত ছিল। এখানে কেবল এই উপমহাদেশের শিক্ষার্থীই নয়; চীন, তিব্বত, মায়ানমার, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়াসহ বিভিন্ন দেশের বৌদ্ধরা উচ্চতর ধর্মজ্ঞান চর্চা করতে আসতেন।

এর পুনর্নির্মাণের গল্প জানাতে গিয়ে আহমেদ জামান সঞ্জীব বললেন, 'বর্তমানে সোমপুর মহাবিহার একটি ধ্বংসস্তূপ। ফ্লোর প্ল্যান ও দেয়ালগুলো ছাড়া তেমন কিছু নেই। ছাদও নাই। এই স্থাপনাটি দেখতে ঠিক কেমন ছিল, কী দিয়ে তৈরি হয়েছিল এটি- এগুলোরও কোনো তথ্য-উপাত্ত নেই।'

'আমরা যেটা করেছি- ফ্লোর প্ল্যান অনুসারে দেয়ালগুলো আগে তৈরি করে ফেলেছি। দেয়াল তৈরি করার পর এটার সঙ্গে সর্বোচ্চ উচ্চতার যে ধরণের ছাদ মানায়, সেটা করার চেষ্টা করেছি। সে সময়কালে তখনকার স্থাপনাগুলোর নকশা কেমন ছিল সেগুলো বিবেচনায় নিয়ে, বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে পুরো জিনিসটা তৈরি করেছি। এজন্য প্রচুর পড়াশোনা ও গবেষণা করতে হয়েছে।'

ভার্চ্যুয়ালি সোমপুর বিহার। ছবি: সংগৃহীত

তিনি কোথা থেকে পেলেন এই অনুপ্রেরণা- এই প্রশ্নের জবাবও পাওয়া গেল সঞ্জীবের কথায়। তিনি বললেন, 'আমাদের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো যেভাবে সংরক্ষণ করা উচিত, সেভাবে আসলে হচ্ছে না। তখন মনে হলো, এটাকে যদি এখন ডিজিটালি সংরক্ষণ করে রাখা যায়, তাহলে পরে চাইলেও এগুলো যথাযথভাবে পুনরুদ্ধার করা যাবে। সেই ভাবনা থেকেই কাজ করে যাচ্ছি। এর আগে পানামনগর ও ষাটগম্বুজ মসজিদের মতো প্রাচীন নিদর্শনগুলো নিয়েও কাজ করেছি।'

গতকাল ঢাকায় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে ভার্চ্যুয়াল মিউজিয়াম বাংলাদেশের প্রথম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে 'সোমপুর মহাবিহারের থ্রি সিক্সটি ভার্চ্যুয়াল ট্যুর'- এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী।

বৌদ্ধ বিহারটির ভূমি-পরিকল্পনা চতুষ্কোণাকার। এর চারদিক চওড়া সীমানা প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। সীমানা দেয়াল বরাবর ভেতরের দিকে সারিবদ্ধ ছোট ছোট কক্ষ। উত্তর দিকের বাহুতে ৪৫টি এবং অন্য ৩ দিকের বাহুতে ৪৪টি করে কক্ষ। শেষ দিকে ৯২টি কক্ষের মেঝেতে বিভিন্ন আকারের বেদী নির্মাণ করা হয়।

এ থেকে অনুমান করা যায় যে, প্রথম যুগে সবগুলো কক্ষই ভিক্ষুদের আবাস কক্ষ হিসেবে ব্যবহৃত হলেও পরবর্তীকালে কিছু কক্ষকে প্রার্থনা কক্ষে রূপান্তর করা হয়েছিল।

চৈতী আহমেদ নামের একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী ভার্চ্যুয়ালি সোমপুর বিহার দেখার অভিজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, 'আমি বিহারটির এমন অবস্থা সম্পর্কে জানতে পেরেছি যা এখন আর নেই। কিন্তু একসময় এর অস্তিত্ব ছিল। এটা অনেকটা টাইম ট্রাভেলিংয়ের মতো। ওই সময়ে গিয়ে নিজেকে সেই সুদূর অতীতের অংশ বলেই মনে হয়েছে।'

এতে আরও দেখা যায়, বিহারের ভেতরে উন্মুক্ত চত্বরের মাঝে রয়েছে কেন্দ্রীয় মন্দির। মন্দিরের মাঝে বুদ্ধের বড় একটি ভাস্কর্য। ৩টি ভাসমান ধাপে ঊর্ধ্বগামী এ মন্দিরের স্থাপত্য নকশা ক্রুশাকার। ক্রুশের মাঝ বরাবর আরও কয়েকটি দেয়াল কোণাকুণিভাবে যুক্ত।

মূল ভবনটির কেন্দ্রে দরজা-জানালা বিহীন একটি শূন্যগর্ভ চারকোণা ঘরের দেখা পাওয়া যায়। এটি মন্দিরের তলদেশ থেকে চূড়া পর্যন্ত বিস্তৃত। মূলত এই শূন্যগর্ভ কক্ষটিকে কেন্দ্র করেই বিশাল এই মন্দিরের কাঠামো নির্মিত হয়েছিল। আর মন্দিরের সমান্তরালে ছিল একটি প্রদক্ষিণ পথ।

ক্রুশাকার নকশার বাইরের অংশগুলোর সংযোগস্থলে কার্নিশের প্রান্ত পর্যন্ত পানি নিষ্কাশন নালার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। পাথরের তৈরি এ নালাগুলোর মুখ গর্জনরত সিংহের মুখের অবয়বে নির্মিত। ভিত্তিভূমির দেয়ালের বাইরের অংশে মোট ৬৩টি কুলুঙ্গি ছিল, যার প্রতিটিতে ছিল একটি করে পাথরের ভাস্কর্য।

এই কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও প্রত্নতত্ত্ববিদ অধ্যাপক মোজাম্মেল হক। তিনি বলেন, 'ওই সময়ের সোমপুর বিহার কেমন ছিল সেটা তুলে আনতে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। যেহেতু তখনকার ছাদ কেমন ছিল, সেটার কোনো কাগজপত্র নেই, তাই এটাকে শতভাগ নিখুঁত বলা যাচ্ছে না।'

Comments

The Daily Star  | English
compensation for uprising martyrs families

Each martyr family to get Tk 30 lakh: Prof Yunus

Vows to rehabilitate them; govt to bear all expenses of uprising injured

3h ago