প্রেরণার দীঘি মুস্তাফা জামান আব্বাসী

ছবি: সংগৃহীত

নওগাঁর পত্নীতলার কাঞ্চনদীঘি দেখেছেন কেউ? আহ্, কি শান্ত, স্থির, টলমলে। এই দীঘির সামনে ১০ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকলে মনটা প্রশান্তিতে ভরে গেছে। শতবর্ষ তো হবেই এই জলমহালের বয়স, কিন্তু এর মধ্যে পতনের কোন অস্থিরতা নেই, কেবলই গৌরব এবং ঐতিহ্যের চিহ্ন নিয়ে পথিকের অপেক্ষা। মুস্তাফা জামান আব্বাসী, ঠিক এরকম দীঘির মতো। কোমল, অহংকারহীন, সতত, সজীব মানুষ। বৃক্ষহীন গাঁয়ের একমাত্র বটবৃক্ষের মতো।

অনেকে বলেন, ব্যক্তিজীবন এবং সংস্কৃতিজীবনকে সম্পূর্ণ আলাদা রাখাই ভালো। আমি এই বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করি। কারণ সংস্কৃতি বা সাহিত্য জীবনে আমি যে কথা বলছি বা করছি, তার সঙ্গে যদি আমি সত্যিকার অর্থে একমত থাকি, তাহলে ব্যক্তিজীবন, আমার সংস্কৃতির আদর্শের বাইরে যেতে পারে না। সুতরাং আমি মনে করি, যারা দুটো জীবনকে আলাদা রাখেন তারা মূলত পাঠক বা ভক্তকুলকে প্রতারিত করেন। আমি এ ধরনের মানুষকে দ্বিচারী বলি।

মুস্তাফা জামান আব্বাসী, দ্বিচারী মানুষ নন। তিনি তার সাহিত্যে, তার গানে যা বলেন, সেই পথেই সাহসী নাবিকের মতো জাহাজ চালিয়ে যান, গিয়েছেন।

মুস্তাফা জামান আব্বাসী উত্তরাধিকার সূত্রেই গানের নতিজা বহন করছেন তার রক্তে। কিন্তু শুধু উত্তরাধিকারের লেবেল দিয়ে কখনোই কেউ হয়ে উঠতে পারে না, যদি তিনি নিজে চেষ্টা না করেন বা নিজের নিজস্বতা প্রকাশ করতে না পারেন। আব্বাসী নানা বাঁক পেরিয়ে নিজেকে প্রমাণ করেছেন যে, তিনি সার্থকভাবেই বাংলাদেশের সোঁদা মাটির গন্ধওয়ালা সংস্কৃতির একজন প্রতিনিধি।

মুস্তাফা জামান আব্বাসী যখন ভরা নদীর বাঁকের সূত্রধর হন, তখনই কেবল আমাদের হৃদয়ের মৃত নদীগুলো ভরে উঠে। তাঁর জায়গায় অন্যরা হলে, সেটা শূন্য শূন্যই মনে হয়। তিনি যখন সুর-তাল ও লয়ে হাঁক ছাড়েন, তখনই সেটা গান হয়ে প্রকাশিত হয়, এখানেই বড় বিস্ময়!

কোন সংস্কৃতিকর্মী যদি ভাবেন, বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে আমার আদর্শ পুরুষ কে? তখন তিনি নিঃসন্দেহে মুস্তাফা জামান আব্বাসীকে সামনে রাখতে পারেন। কারণ তাঁর দীর্ঘ জীবনপথে প্রকাশিতভাবে কোন অন্ধকার বা পচা ও গলিত উদাহরণের চিহ্ন নেই। এজন্য সংযমবোধ, নিয়ন্ত্রণের লড়াইও করতে হয়েছে তাঁকে। সেদিক বিবেচনায় মুস্তাফা জামান আব্বাসীকে অন্ধকারের আলো উপমায় অভিষিক্ত করা যায়। কেউ কেউ বলেন, জনাব আব্বাসীকে দেখলে কুসংস্কার, অপসংস্কৃতি ও অন্ধকার পালিয়ে যায়!

প্রশ্ন জাগতে পারে, এই প্রজন্ম বাংলাদেশের মাটি ও মানুষের গানের সম্রাট আব্বাসউদ্দিনকে কিভাবে দেখেন? কিভাবে দেখেন তাঁরই রক্তবিধৌত মুস্তাফা জামান আব্বাসীকে। মন থেকে বলছি, এই প্রজন্ম, আব্বাসী পরিবারকে বাংলাদেশের হাজার বছরের সংস্কৃতির বটগাছ মনে করে। তারা মনে করে, এই বৃক্ষের শোভা ও সতেজতা আছে বলেই, এখনো আমাদের কাব্যে, গানে সোঁদা মাটির গন্ধ পাওয়া যায়। অনেক মঞ্চে যখন এই প্রজন্মের তরুণরা গেয়ে উঠেন-আমায় ভাসাইলি রে/ আমায় ডুবাইলি রে/ অকূল দরিয়ার মাঝে কূল নাইরে।

বড় ভাই বিচারপতি মোস্তফা কামাল (বসা), মুস্তাফা জামান আব্বাসী ও বোন ফেরদৌসী রহমান। ছবি: সংগৃহীত

তখন ঐতিহ্য প্রেমিকদের চোখে কান্না হয়ে ঝরে পড়ে অশ্রু। হয়ত এই প্রজন্মের জানার স্বল্পতা আছে কিন্তু আন্তরিকতার বিন্দু পরিমাণও ঘাটতি নেই। যারা বলেন, আব্বাসউদ্দিন, আব্দুল আলিম, মুস্তাফা জামান আব্বাসী, ফেরদৌসী রহমান হারিয়ে যাচ্ছেন, তারা ভুল বলেন। এঁরা আমাদের জন্য সংস্কৃতির সোনালি দীঘি রচনা করে গেছেন, সেই দীঘির জল কখনো ফুরাবার নয়।

মুস্তাফা জামান আব্বাসীর সঙ্গে একটা সকাল কাটাবার সৌভাগ্য হয়েছিলো আমার। বেসরকারি এক বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর পাঠআঙিনায়। আমার মনে হয়েছে, সঙ্গীতের সক্রেটিসের সামনে আমি বসে আছি। তিনি তাঁর মনন ও হৃদয়ে কাজী নজরুল ইসলাম ও আব্বাসউদ্দিনকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করে আছেন। দেশ-বিদেশের নানা অভিজ্ঞতা, কুচবিহার থেকে ঢাকার স্মৃতি, শূন্য হাতে আব্বাসউদ্দিনের বাংলা জয় করার গল্প আমাকে নির্ঘুম রেখেছে অনেক দিন। এখনো সেই একটা সকালের স্মৃতি হাতড়ালে আমি বুকের মধ্যে অন্যরকম এক ভালো লাগা অনুভব করি।

কুচবিহারের পৈত্রিক বাড়ি। ছবি: সংগৃহীত

আব্বাসী, এক শতাব্দী একজন মুস্তাফা জামান আব্বাসীর কাছে সামান্যই বটে। আপনার কর্ম শতবর্ষ ধরে আমাদেরকে আলো দেবে। আমরা আপনার আলোয় স্নান করে শুদ্ধ হয়ে উঠতে চাই। আপনার রেখে যাওয়া প্রেরণায় আমরা বুকে সাহস রেখে বলতে পারি- ডুবি ডুবি তবু অযুত সাহসে/ উজানে সাঁতার কাটি/ পায়ে নিয়ে আমি আগুনের জুতো/ বেহায়া বাতাসে হাঁটি।

উল্লেখ্য খ্যাতিমান সংগীতশিল্পী মুস্তাফা জামান আব্বাসী গত শনিবার মারা গেছেন। তিনি প্রখ্যাত সংগীত পরিবারের সন্তান। বাবা আব্বাসউদ্দীন আহমদ পল্লিগীতির কিংবদন্তি শিল্পী। চাচা আব্দুল করিম ছিলেন পল্লিগীতি, ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালির শিল্পী। বড় ভাই মোস্তফা কামাল আইনবিশারদ। মোস্তফা কামালের মেয়ে নাশিদ কামালও একজন কণ্ঠশিল্পী। বোন ফেরদৌসী রহমান দেশের প্রথিতযশা সংগীতজ্ঞ। ভারতের কোচবিহার জেলার বলরামপুর গ্রামে ১৯৩৬ সালের ৮ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তার শৈশব ও কৈশোরকাল কলকাতায় কাটে। 

Comments

The Daily Star  | English

Poll irregularities: Sedition among 3 new charges added against three ex-CECs

BNP filed a case against 24 individuals, including three former chief election commissioners, 10 election commissioners, and top government and police officials, for their alleged role in irregularities and biasness during the national elections in 2014, 2018, and 2024.

12m ago